• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৪ মে, ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ২৬, ২০১৯, ০৯:২৫ এএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ২৬, ২০১৯, ০৯:২৫ এএম

গরুর জন্য প্রাণ যাচ্ছে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে

গরুর জন্য প্রাণ যাচ্ছে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে


রাজশাহী অঞ্চলের বিস্তীর্ণ সীমান্ত যেন মৃত্যু উপত্যকা। কোনোভাবেই থামছে না মৃত্যুর মিছিল। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীর (বিএসএফ) গুলিতে কয়েক দিন পর পরই প্রাণ হারাচ্ছে বাংলাদেশি নাগরিক। বিশেষ করে গবাদি পশু আনতে যাওয়া রাখালরাই এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে। বিজিবি সীমান্তে নানা কৌশল গ্রহণ করলেও মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সীমান্তে হতাহতের ঘটনা ঠেকাতে রাখালদের অনুপ্রবেশ কঠোরভাবে বন্ধ করা দরকার। কিন্তু চোরাপথে আসা গবাদি পশু থেকে রাজস্ব আদায়ে ‘সীমান্ত খাটাল’ খোলায় কোনোভাবেই সেটা সম্ভব হচ্ছে না। তবে সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিনই এই অঞ্চলে ঢুকছে বড় বড় মাদকের চালান। এই কারবারে যুক্ত বিপুল সংখ্যক লোকজন। এদের নিয়ন্ত্রণে সীমান্তে কঠোর নজরদারি জরুরি।  

সর্বশেষ গত ২৩ মার্চ দিবাগত রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার জোহরপুর সাতরশিয়া সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিতে সাহাবুদ্দিনকে (২১) আহত হয়েছেন। ওই দিনই মধ্যরাতে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নেন স্বজনরা। বর্তমানে হাসপাতালের ৫নং ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন তিনি। গুলিবিদ্ধ সাহাবুদ্দিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নারায়নপুর সাতরশিয়া গ্রামে কামাল উদ্দিনের ছেলে।

হাসপাতালে সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে আসা স্বজনরা জানান, গত শনিবার রাতে সাহাবুদ্দিনসহ একদল বাংলাদেশি রাখাল গরু আনতে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতীয় সীমান্তের ভেতরে যায়। গরু নিয়ে ফেরার সময় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফের পাতলাটোলা বাহুড়া ক্যাম্পের জওয়ানরা তাদের ধাওয়া করে।

এসময় বিএসএফ বাংলাদেশি রাখালদের লক্ষ্য করে ২০ রাউন্ডের বেশি গুলি করে। এতে সাহাবুদ্দিন, মেসের আলী ও অজ্ঞাত আরও এক রাখাল গুলিবিদ্ধ হয়। সহযোগী রাখালরা সাহাবুদ্দিনকে উদ্ধার করে সীমান্তের এপারে নিয়ে আসে। সাহাবুদ্দিনের পায়ে গুলি লাগে। তবে এখন পর্যন্ত মেসের আলীসহ অজ্ঞাত আরও এক রাখালের খোঁজ মেলেনি।

এর আগে ১৯ মার্চ রাতে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর ভুবনপাড়া সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে আবদুস সালামের ছেলে আল্লাম হোসেন (৩৫) নিহত হন। ওই রাতে আল্লাম কয়েকজন সহযোগী নিয়ে সীমান্তের কাঁটাতারের কাছে গরু আনতে গেলে বিএসএফ গুলি করে। এতে ঘটনাস্থলে সে প্রাণ হারায়।

একই রাতে ওই সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে গোলাম মোস্তফার ছেলে জামাল উদ্দিন (৩৬) নিহত হন। এর আগে ৩ মার্চ রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের জোহরপুর সীমান্ত নিহত হন টিপু বিশ্বাস (২৭)। চরপশ্চিম পাঁকা বিশরশিয়া গ্রামের সরদারপাড়ার ফড়িং বিশ্বাসের ছেলে টিপুও গিয়েছিলেন সীমান্তে গরু আনতে।

২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে জোহরপুর সীমান্ত পথে গরু আনতে গিয়ে বিএসএফের গুলিতে চর পশ্চিম পাঁকা খিটকারিপাড়া গ্রামের মোজাম্মেল হক মোজামের ছেলে রুহুল হক (২৬) গুরুতর আহত হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রুহুল মারা যায়।

জানা গেছে, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হচ্ছে। এর মধ্যে সব চেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীর পদ্মার চর, সোনাইকান্দি, খরচাকা, প্রেমতলী, সাহেবনগর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফরিদপুর, বাগডাঙ্গা, হাকিমপুর, বাখের আলী, জোহরপুর ট্যাক, জোহরপুর, ওয়াহেদপুর, ফতেপুর, মাসুদপুরসহ ১২টি সীমান্ত পয়েন্টে খাটাল রয়েছে। এছাড়া নওগাঁর বিভিন্ন সীমান্তে রয়েছে বেশকিছু খাটাল। এরমধ্যে জোহরপুর ট্যাক ও জোহরপুর সীমান্ত পয়েন্টে বিএসএফের গুলিতে হতাহতের সংখ্যা সর্বাধিক।

সীমান্তের বাসিন্দা জানিয়েছেন, প্রায় প্রতি রাতেই জোহরপুর ও জোহরপুর ট্যাক সীমান্তের বিপরীতে বিএসএফ গুলিবর্ষণ করে। হত্যাকাণ্ড সীমান্তের কাছাকাছি হলে রাখালের মরদেহ এপারে ছুড়ে ফেলে বিএসএফ। সীমান্তের ভেতরে হলে বিএসএফ খোলা মাঠে রাখালদের মরদেহ মাটি খুঁড়ে পুঁতে দেয়। আইনি জটিলতা এড়াতে নিহতের স্বজনরাও আর লাশের সন্ধান করে না। তবে সীমান্তে মাদক আনতে গিয়ে হতাহতের খবর জানতে পারেননি বাসিন্দারা।

এদিকে, সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারানো রাখালদের পরিবার দুঃসহ জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। একাধিক ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এই তথ্য। তারা বলছেন, সরকার বা কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে তাদের কোনো ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেননা।  এমনকি হতাহতের ঘটনাগুলোর কোনো তদন্তও হচ্ছে না। বাংলাদেশি নাগরিককে গুলি করে মারার পরও বিজিবির পক্ষ থেকে বিএসএফের কাছে জোরালো কোনো প্রতিবাদও জানানো হচ্ছেনা।

দীর্ঘদিন ধরেই সীমান্তে প্রাণহানির ঘনিষ্ঠ ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট আশফাকুর রহমান। তার ভাষ্য, সীমান্তে সংঘটিত অধিকাংশ প্রাণহানির ঘটনা গরু পাচারকেন্দ্রিক। সীমান্তে গবাদি পশুর খাটাল বন্ধ করে এসব হত্যাকাণ্ড অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। খাটালের কারণে মাদক পাচারও বাড়ছে বলে জানান তিনি। তবে মাদক চোরাচালানে গিয়ে হতাহতের খবর নেই বললেই চলে। মাদক চোরাচালান রোধে বিএসএফএর অবস্থান ফলপ্রসুও নয়।

অবশ্য এ বিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ বিজিবির ব্যাটালিয়ন কমান্ডার ও রাজশাহী বিজিবির সেক্টর কমান্ডারের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের একমাত্র কারণ ‘খাটাল ব্যবস্থার’ কথা স্বীকার করেছেন রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার ও আঞ্চলিক টাস্কফোর্সের সভাপতি (অতিরিক্ত সচিব) নূর উর রহমান। তিনি বলেন, এ বিভাগের বিভিন্ন সীমান্তে খাটালের সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য বিজিবিকে বলা হয়েছে। সীমান্তে নিরীহ কোনো বাংলাদেশির প্রাণহানি কারও কাম্য নয়।

এফএস/টিএফ