• ঢাকা
  • সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ৬, ২০১৯, ১০:০০ এএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ৬, ২০১৯, ০৫:২৬ পিএম

মাছ শিকার বন্ধ থাকায় জেলে পরিবারে হাহাকার

মাছ শিকার বন্ধ থাকায় জেলে পরিবারে হাহাকার
জেলেদের মাছ শিকারের জাল -ছবি : জাগরণ

নীলকান্ত জলদাস (৬৬)। বিবেক বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে মাছ শিকার করে তার জীবনযাত্রা শুরু করেন। এ বয়স পর্যন্ত অন্য কোনো কাজ করেননি তিনি। শুধুমাত্র মাছ শিকারই তার নেশা ও পেশা। এই পেশাকে পুঁজি করেই সংসার চালাতেন। পরবর্তীতে বিয়ে করেন এবং ছেলে মেয়েকে বড় করে বিয়েও করান। কিন্তু হঠাৎ করে ২০১৭ সালের আগস্টের দিকে নাফ নদী মাছ শিকার বন্ধ হওয়ায় অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন নীলকান্ত। বর্তমানে শোকে দুঃখে মুহ্যমান। একবেলা খেতে পারলেও অপর বেলায় উপোস থাকতে হচ্ছে। নীলকান্ত টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের জেলাপাড়ার মহিন্দ্র জলদাসের ছেলে। শুধু তিনিই নন, তার পূর্বপুরুষও (বাপ দাদা) এ পেশায় থেকে মারা গেছেন। তাই এ পেশা ছাড়তে পারবেন না বলে জানান নীলকান্ত।

স্থানীয় পুলিন দাসের ছেলে বামহন্দ দাস (৫৫) বলেন, প্রায় ২ বছর সময় ধরে নাফ নদীতে মাছ শিকার করতে পারছি না। এতে হাজার টাকা ঋণ নিয়ে নৌকা ও জাল তৈরীতে ব্যয় করে তা পরিশোধ করা কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়ে। ছেলে মেয়েদের দু মুঠো ভাত পেট ভরে খাওয়া দূরহ হয়ে উঠেছে। ছেলেমেয়েদের লেখা পড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। পাশাপাশি নৌকা ও জাল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রুজি রোজগারের উপকরণ নষ্ট হলে আত্মহত্যা ছাড়া কোনো পথ থাকবে না। 

সত্য দাশের স্ত্রী জলদাস বলেন, রোহিঙ্গারা এ দেশে অবাধ বিচরণ করতে পারে। কিন্তু আমরা পারছি না। তাদের কারণে আমাদের মৌলিক অধিকার হরণ হচ্ছে। এটাতো হতে পারে না। আমরা এর সুষ্ঠু প্রতিকার চাই। শুধু এই তিনজনই নয়, নাফ নদীর ওপর হাজারো জেলের জীবিকা নির্ভর করে। প্রায় ২ বছর ধরে নাফ নদীতে মাছ শিকার বন্ধ থাকায় তাদের জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।

তারা বলেন, ভিক্ষা বা কারো দয়ায় নয়, নাফ নদীতে মাছ শিকার করে বাঁচতে চাই। বছরের পর বছর ধরে টেকনাফের নাফ নদীতে বিহিঙ্গি জাল পেতে জিবীকা নির্বাহ করে আসছি। কোনো কালেই এভাবে দীর্ঘদিন মাছ শিকার বন্ধ থাকেনি। বিগত আড়াই বছর ধরে নাফ নদে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। ফলে হাজার হাজার জেলে পরিবারে চলছে হাহাকার। অর্ধাহারে অনাহারে কোনোভাবে কেটে যাচ্ছে তাদের জীবন। বিশেষ করে শিক্ষা,  চিকিৎসা ও পারিবারিক আনুষঙ্গিক খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। অনেক পরিবার ছেলেমেয়েদের স্কুল পড়া বন্ধ রেখেছে। ঋনের টাকা শোধ করতে না পেরে অনেকেই স্ত্রীকে পিত্রালয়ে পাঠিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্য হিসেবে ২০ কেজি করে চাউল পেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য। কোথাও দিন মজুরের কাজও পাচ্ছি না। তাতে আবার রোহিঙ্গারা অল্প মজুরিতে শ্রম বাজার দখলে রেখেছে। যেখানে জনপ্রতি ৫শ টাকা সেখানে রোহিঙ্গারা ৩শ টাকায় কাজ করছে।

জেলেদের মাছ ধরার উপকরণ -ছবি : জাগরণ

সরেজমিনে জানা যায়, যুগ যুগ ধরে জেলে পেশায় নিয়োজিত থেকে নাফ নদে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। কিন্তু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও ইয়াবা পাচারের কারণে প্রায় আড়াই বছর ধরে মাছ শিকার বন্ধ রাখা হয়েছে। অথচ লাখ লাখ রোহিঙ্গা এরইমধ্যে আমাদের দেশে ঠাঁই করে নিয়েছে। জেলেদের মাধ্যমে যদি ইয়াবা পাচার হয়ে থাকে তাহলে রাতের বেলায় না হলেও অন্তত দিনের বেলায় নাফ নদে মাছ শিকারের অনুমতি দেয়া হলে জেলেরা খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারবো।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইয়াবা ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে টেকনাফের নাফ নদীতে মাছ শিকার বন্ধ থাকায় অর্ধাহারে অনাহারে জীবন কাটাচ্ছেন প্রায় ১০ হাজার জেলে। গত আড়াই বছর পূর্বে মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংসতার ফলে রোহিঙ্গারা দলে দলে এদেশে পালিয়ে আসার প্রেক্ষিতে অঘোষিতভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে জেলেদের মাছ শিকার। একটানা মাছ শিকার বন্ধ থাকায় নাফ নদ নির্ভর জেলে পরিবারগুলোতে নেমে এসেছে দুর্দশা। বিকল্প কোন আয়ের উৎস না থাকায় জেলে পরিবারের মধ্যে চলছে হাহাকার। 

টেকনাফে বেশ কয়েকটি জেলে পাড়া রয়েছে। এরমধ্যে হোয়াইক্যংয়ের, উত্তরপাড়া, খারাইংগ্যাঘোনা, বালুখালী লম্বাবিল, হ্নীলার হোয়াব্রাং, নাটমুড়া পাড়াস্থ জেলে পাড়া, জাদীমুরা, খারাংখালী, টেকনাফের জাইল্যাপাড়া, কায়ুকখালী পাড়া, নাজির পাড়া, সাবরাংয়ের চৌধুরীপাড়া, নয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপের জাইল্যা পাড়া, খারিয়াখালী, মাঝেরপাড়া অন্যতম।  

এ ব্যাপারে টেকনাফ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, জেলেদের পরিবারে গত নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ৪০ কেজি করে চাল দেয়া হয়েছে। এছাড়া জেলেদের জন্য ইকো ফিস নামে একটি সংস্থা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। 

২ ব্যাটালিয়নের বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্ণেল সরকার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, রাষ্ট্রের নির্দেশনার কারণে নাফ নদে কোন মতেই মাছ শিকার করতে দেয়া যাবে না। সরকারের নির্দেশ আগের মতোই বলবৎ থাকায় নাফ নদীতে মাছ শিকারের কোনো সুযোগ নেই। মাদক বা ইয়াবা পাচার প্রতিরোধে বিজিবি সর্বদা জিরো টলারেন্স নীতিতে রয়েছে। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল হাসান 
তিনি জানান, নাফ নদীতে বেশ কিছুদিন ধরে মাছ শিকার বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চিঠির উত্তরে দিনের যেকোনো সময় মাছ শিকারের ব্যবস্থা করে দেয়ার সুপারিশ করে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি মৎস্যজীবীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য এনজিওগুলোকেও প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

সনজু রাণী দাশ ও তার ছোট ছেলে - ছবি : জাগরণ

নাফ নদে মাছ শিকার করে স্ত্রী সন্জু দাসকে নিয়ে ভালই কেটে যাচ্ছিল সনজিৎ দাসের সংসার। তাদের সুখের পরিবারে এক সন্তান রয়েছে। এরই মধ্যে আরও একবার অন্তঃসত্তা হয়েছে সন্জু দাস। হঠাৎ করে নাফ নদে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। নদীতে মাছ শিকার বন্ধ থাকায় একমাত্র আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যায় সনজিৎ দাসের। ফলে সুখের সংসারে অশান্তির নেমে আসে। এনজিও থেকে নেয়া ঋণ শোধ করতে না পেরে এবং অভাবের তাড়নায় সুখের সংসার ফেলে উধাও হয়ে যায় সনজিৎ দাস। এরই মধ্যে জম্ম হয় সন্জুর ২য় সন্তান। তাও অপারেশনের মাধ্যমে। বর্তমানে শাশুড়ির সঙ্গে রয়েছে সন্জু। সন্জুর শাশুড়ি পার্শ্ববর্তী বৌদ্ধ পাড়ায় কাজ করে যা পায় তা দিয়ে কোনোভাবে তাদের দিন কেটে যাচ্ছে। তিনি বলেন, সরকার নাফ নদে মাছ শিকারে অনুমতি দিলে তবেই তার স্বামী আবারো ফিরবেন এই আশায় রয়েছেন। সেই অতীত সুখের দিনগুলোতে ফিরতে চাই সন্জু। 

নাফ নদীদে মাছ শিকার বন্ধ ঘোষণা করায শুধু সন্জুর পরিবার তছনছ হয়েছে এমন নয়। একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে টেকনাফের প্রায় ১০ হাজার জেলে পরিবারগুলোতে।

এএস/এএস