• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৪ মে, ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ১০, ২০১৯, ০৮:৩৯ এএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১০, ২০১৯, ০২:৫৯ পিএম

বৈশাখ ঘিরে কর্মব্যস্ত সারা বছর কর্মহীন বংশী তীরের কুমাররা

বৈশাখ ঘিরে কর্মব্যস্ত সারা বছর কর্মহীন বংশী তীরের কুমাররা

এক সময় মাটির তৈরি তৈজসপত্র ও ঐতিহ্যবাহী কারুকার্য মণ্ডিত উপকরণের চাহিদা ছিল নিত্য। হাড়ি, কলস, সানকি, ফুলদানি, মটকাসহ নানা তৈজসপত্র তৈরির পর ফেরি করে বিক্রির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত একটি গোষ্ঠী। মাটি দিয়ে হাতের সুনিপুণ কারুকাজে এসব তৈরি করত মৃৎশিল্পীরা। কিন্তু আধুনিকায়ন ও কালের বিবর্তণে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে মৃৎশিল্প নামের এই কর্ম। বর্তমানে অ্যালুমিনিয়াম, সিলভার ও প্লাস্টিকের তৈরি টেকসই আসবাবপত্রের জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা কমেছে মাটির তৈজসপত্রের। আর তাই পূর্বপুরুষদের কুমার পেশা ছেড়ে তাদের উত্তরসূরিরা ঝুঁকছেন অন্যান্য পেশায়। 

রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী সাভার ও ধামরাইয়ে বংশী নদীর তীর ঘেঁষা শিমুলিয়া, নলাম, হাজীপাড়া ও কাকরান এলাকার মৃৎশিল্পী তথা কুমাররা তৈজসপত্র তৈরিতে এক সময় ব্যাপক প্রসিদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন এসব এলাকায় হাতেগোনা কিছু সংখ্যক পরিবার এই শিল্পকে আঁকরে রেখেছে। কেউ পূর্ব পুরুষদের সম্মানার্থে আবার কেউ বা অন্য কোন কাজে পারদর্শী না হওয়ায়। তবে যারাও এই কাজ করছেন পুঁজির অভাব ও সীমিত লাভের কারণে বর্তমানে তারাও এই পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। 

ধামরাইয়ের হাজীপাড়া এলাকার বয়সের ভারে নতজানু মৃৎশিল্পী সুচিন্দ্র পাল বলেন, বাবা সুধির পাল তিনি ও তার ছোট দুই ভাই নিপিন্দ্র পাল ও দিজেন্দ্র পালকে মৃৎশিল্পের কাজ শিখিয়েছিলেন। বংশগতভাবে ছোট বেলা থেকেই তিনি এই পেশার সাথে জড়িত। আগের দিনে মাটি দিয়ে তৈরি হাতি, ঘোড়া, পাখি, পুতুল, হাড়ি, সানকি, কলস, ফুলদানিসহ নানা জিনিসপত্রের চাহিদ ছিল অনেক। সারা বছর তার বাবাকে এসব জিনিস তৈরিতে সাহায্য করতেন তিনি। এছাড়া ঐ সময় পহেলা বৈশাখে বিভিন্ন মেলাকে ঘিরে মাটির তৈরি খেলনা ও তৈজসপত্রের চাহিদার কারণে কথা বলার ফুরসত পেতেন না তারা। 

তিনি আরো বলেন, এখন আর আগের মত পহেলা বৈশাখে তাদের কাজের চাপ নেই। বাজারে বর্তমানে মাটির জিনিসের চাহিদা না থাকায় এখন কুমার পল্লীতে কেবল দইয়ের পাত্র বেশি তৈরি হয়। চৈত্র মাসে এই কাজের একটু চাপ থাকলেও সারা বছরেই প্রায় তাদের কর্মহীন থাকতে হয়। তাইতো তাদের পাড়ার অনেকেই ধীরে ধীরে এই পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। 

নিপিন্দ্র পাল বলেন, স্ত্রী ও তিনি বংশীয় এই পেশায় থাকলেও তার সন্তানেরা আর এই পেশায় থাকতে চায় না। পূর্বপুরুষদের সম্মানার্থে ও কোন রকম বেঁচে থাকার জন্য নিজেরা এই কাজ করছেন। তাদের এলাকার অনেক কুমার পরিবারের লোকজন এই পেশা ছেড়ে রাজমিস্ত্রী, দিনমজুর, গার্মেন্টসহ নানা কাজ করছেন। কেননা মাটি কেনার পর নানা প্রক্রিয়া শেষে একটি দইয়ে পাত্র তৈরি করতে যে খরচ তা লাভের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। আর বৈশাখ ঘিরে একটু কর্মব্যস্ততা থাকলেও সারা বছরই কাজ না থাকায় চরম দারিদ্রতার মধ্যে দিয়ে সময় কাটে তাদের। 

কুমারপাড়ার রবি পাল ও অখিল পাল বলেন, কুমারপাড়া থেকে কয়েক মাইল দূর থেকে ট্রলার প্রতি পাঁচ হাজার টাকা দরে মাটি কিনে আনতে হয় তাদের। তারপর সেই মাটি দিয়ে তৈরি দইয়ের পাত্র তৈরি করা হয়। প্রতিটি পাত্রের জন্য মজুরি হিসেবে তাদের সাত টাকা প্রদান করে থাকেন। আর বাজারে তা বিক্রি হয় দশ টাকার উপরে।

এদিকে, বিলুপ্ত প্রায় এই কুমার পেশা ছেড়ে কাঠমিস্ত্রির কাজ করছেন এই গ্রামের রামা সূত্রধর। তবে তার স্ত্রী সুমি সূত্রধর পুরো চৈত্র মাস অন্যের বাড়িতে চুক্তি ভিত্তিক দইয়ের পাত্র তৈরির কাজ করেন। একশ হাড়ি তৈরি করতে পারলে পঞ্চাশ টাকা পায় সুমি। তবে এই কাজে পা দিয়ে দীর্ঘক্ষণ হুইল মেশিন চালানোর কারণে পায়ে প্রচণ্ড পায়ে ব্যথা অনুভূত হয় তার। তাইতো ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বে সাংসারিক টানাপেড়নের কারণে সুমি বাধ্য হয়েই এই কাজ করছে।

আশুলিয়ার নলাম পাল পাড়া এলাকার সুচিত্র পাল কুমার পেশা ছেড়ে বর্তমানে রাজমিস্ত্রীর কাজ করছেন। তিনি বলেন, শুধু চৈত্র মাসে তাদের কুমারপাড়ায় ব্যস্ততা বাড়ে। তবে যাদের পুঁজি আছে তারাই কেবল দইয়ের পাত্র তৈরি করেন। কিন্তু তার মত কুমাররা কাজে পারদর্শী হলেও পুঁজির অভাবে অর্ডার পান না। তাই বাধ্য হয়ে সারা বছর রাজ মিস্ত্রীর কাজ করেন তিনি। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক ময়েজ উদ্দিন বলেন, আমাদের দেশের মৃৎশিল্প এক সময় অনেক সমৃদ্ধ ছিল। পূজা ও মেলাসহ যে কোন অনুষ্ঠান ঘিরে মাটির তৈরি গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র ও নানা প্রকার সৌখিন উপকরণ তৈরি করত কুমাররা। কিন্তু চাহিদা কমে যাওয়ায় এখন আর এসব তৈরি হচ্ছে না। সাভার ও ধামরাইয়ে বংশী নদীর তীরবর্তী কুমাড়পল্লীতেও এই পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অনেকেই। তবে সরকার ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মৃৎশিল্পসহ এ ধরনের শিল্প মাধ্যমগুলো টিকিয়ে রাখা সম্ভব বলেও জানান তিনি।  

কেএসটি