• ঢাকা
  • বুধবার, ১৫ মে, ২০২৪, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৭, ২০১৯, ০৮:৫৭ এএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৭, ২০১৯, ০৩:৪২ পিএম

সুনামগঞ্জে শিলাবৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত বোরোর মাঠ

সুনামগঞ্জে শিলাবৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত বোরোর মাঠ
কালবৈশাখী ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণ সুনামগঞ্জের বোরো ধানক্ষেতের মাঠ -ছবি : জাগরণ

আমি তিন হাল (৩৬) কেয়ার জমি করেছিলাম। এখন এক ছটাক জমির ধানও কাটতে পারছি না। কামলা বিদায় করে দিয়েছি। ক্ষেতের মধ্যে কাটার কিছু নেই, খালি ধান গাছগুলো ভঙ্গুর অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। পুরা তিন হাল জমির ধানের গাছ এখন গরুর খড়ে পরিণত হয়েছে। গরু-বাছুর বিক্রি করে কামলা বিদায় করতে হবে। এমনটি বলেছেন কালবৈশাখী ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা কৃষক আনফর আলী। 

আনফর আলী পরের জমি বর্গাচাষ করে। সেই আয় দিয়ে তার  সংসার চালান। এবার শিলা বৃষ্টিতে মাঠে ধান না থাকায় দুচিন্তায় পড়ে গেছেন। তিনি বলেন, আমার অখন কুস্তা নাই। পরিবারের ১২ জন লোক আছে। ধান ক্ষেতের এ অবস্থা দেখে আমার শরীর অবশ হইয়া গেছে। ঋণফিন করে গিরস্থি করছিলাম। অখন ঋণ দিমু কেমনে আর সংসার চালাইমু কেমনে। ৩৫ কেয়ার জমি করে একছটাক ধানও কাটতে পারিনি। সব শিলে নষ্ট করেছে। এখন আমার ভাত খাওয়ার ডেগের মধ্যে চাল নাই ,সংসার কি দিয়া চালাইতাম। সরকার যদি সাহায্য না করে তাইলে বাঁচার কোন উপায় নাই।

কালবৈশাখী ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণ সুনামগঞ্জের বোরো ধানক্ষেতের মাঠ -ছবি : জাগরণ

কালবৈশাখী ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলায় বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। কৃষকরা বলছেন তাদের জমি গুলো এখন কাটার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। এগুলো এখন গৌ খাদ্যে পরিণত হয়েছে। সোমবার (১৫ এপ্রিল) উপজেলার পাথারিয়া, শিমুলবাঁক, পূর্ব বীরগাঁও ও দরগাপাশা ইউনিয়নের ওপর দিয়ে দমকা বাতাসসহ কালবৈশাখী ঝড় ও শিলাবৃষ্টি হয়। এতে বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে শিমুলবাক গ্রামের কৃষকদের। শিমুলবা জামাইকাটা হাওরের ৩০০ হেক্টর জমির পাকা ধান সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সোমবার সকাল ৮ টার দিকে উপজেলার শিমুলবাক,পাথারিয়া,দরগাপাশা ও পূর্ব বীরগাওর ইউনিয়নের জামখোলা, গাজীনগর, আসামমোড়া, রাধারবাড়ি ও হলিদাকান্দা হাওরে ত্রিশ মিনিটেম মতো কালবৈশাখী ঝড় ও শিলাবৃষ্টি হয়। প্রচণ্ড বাতাস ও শিলাবৃষ্টির কারণে জমির পাকা ধানের (ব্রি ২৮ ধান ও হাইব্রিড) ব্যাপক ক্ষতি হয়। শিলাবৃষ্টিতে পাথারিয়া ইউনিয়নের ১৫০ হেক্টর, শিমুলবাঁক ইউনিয়নের ৪০০ হেক্টর, পূর্ব বীরগাঁও ইউনিয়নের ১০০ হেক্টর ও দরগাপাশা ইউনিয়নের ১০০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আক্রান্ত জমির শতভাগ ধান জমিতেই ঝরে পড়েছে। অথচ দুদিন আগেও এসব হাওরের জমিতে পাকা ধান দুলছিল। শিলাবৃষ্টির পর ধান গাছে আর কোনো ধান নেই। সব ধান ঝরে পড়েছে জমিতে। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিস জানায় ৪টি ইউনিয়নের সাড়ে ৭শ হেক্টর জমির বোরো ধান শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে গেছে। এতে সাড়ে ৪ হাজার মেট্রিকটন ধান নষ্ট হয়েছে। যার বাজারদর ৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

একই গ্রামের কৃষক এমদাদুল হক বলেন, তিনি ১৬ কেয়ার জমিতে ধান আবাদ করেছিলেন। দু’দিন আগেও জমিতে পাকা ধানের শীষ বাতাসে দোল খেয়েছে আর এখন শুধুমাত্র ধান গাছের কাণ্ড পড়ে আছে। ধান গাছে ১৫টি ডালের মধ্যে কোন ধান নেই, আছে শুধু মরা হলুদ রঙ্গের পাতা। সব ধান জমিতে ঝরে গেছে।  

জহুর আলী বলেন, আমার কোন নিজস্ব জমি সম্পত্তি নেই। তাই চুক্তিতে আমি ৫ লাখ টাকা খরচ করে ৪০ কেয়ার জমিতে ফসল ফলিয়ে ছিলাম। দুই দিন আগেও জমিগুলোতে পাকা ধানের হাসি ছিল আর আজ জমিতে শুধু ধান গাছ আছে কিন্তু ধান নেই। পুরো জমি শিলের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে হলুদ বর্ণ ধারণ করছে। কোন জমিই কাটার যোগ্য নেই। তাই এসব জমির ধান গাছ এখন গরুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হবে।

কৃষক নূর উদ্দিন বলেন আমি একজন বর্গাচাষি আমার নিজস্ব কোন জমি নেই। ৪২ হাজার টাকা খরচ করে ৪২ কেয়ার জমিতে ধান রোপণ করেছিলাম। ফলনও ভালো হয়ে ছিল। ফসল কেটে ঘরে তুলতে পারলে ২০০ মণ ধান পেতাম, এখন দুইমণ ধানও পাবো না। শিলাবৃষ্টিতে সব ফসল নষ্ট করে দিয়েছে। তেহকিয়া গ্রামের জহুর মিয়া বলেন, আমি ৬০ কেয়ার জমিতে ধান আবাদ করেছিলাম। কিছুদিন আগেও জমিতে ধান ছিল, আজ পুরো জমিতে শুধু ধানগাছ আছে। শিলা বৃষ্টিতে সবকিছু উজাড় করে নিয়ে গেছে। এখন গরু বিক্রি করে কামলাদের টাকা দিতে হবে। সরকারি সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া চলার কোন উপায় নেই।

ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা জানান, তারা জমিতে আর কাঁচি লাগাবেন না এগুলো এখন গো খাদ্যে পরিণত হয়েছে। শিমুলবাক  ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জুয়েল রানা বলেন, এখানকার শতভাগ ফসল শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হয়েছে। বিষয়টি তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। হাওরে এতো বেশি শিলাবৃষ্টি হয়েছে যে একটি ধানও জমি থেকে কৃষক সংগ্রহ করতে পারবেন না। অনেক কৃষক ঋণ করে জমিতে ধানচাষ করেছেন। তারা আরও বেশি বিপদে পড়েছেন। এই এলাকায় একমাত্র বোরো ফসল হয় অন্য কোন ফসল উৎপাদন হয় না। তাই কৃষকরা আরও বেশি বিপদে পড়েছেন। তবে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা তৈরি করে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। তারা
প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত দেবেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. বশির আহমেদ সরকার বলেন, ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ নির্ণয় করে ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা করবে সরকার। শিলাবৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ২৮, ২৮ ও জনকরাজের মতো হাইব্রিড ধান। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক সরকারি সাহায্য কামনা করেন। ৪টি ইউনিয়নের শিলাবৃষ্টিতে সাড়ে ৩ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

একেএস