কাঁচামালের অভাব ও প্লাস্টিকের চাহিদা বৃদ্ধিতে লক্ষ্মীপুরে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প। প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় মাটির তৈরি তৈজসপত্র আজ বিলুপ্তির পথে। এ শিল্পগুলো নিয়ে আকড়ে থাকা জেলার পাঁচটি উপজেলায় অবস্থিত কুমার পরিবারগুলোতে নেমে এসেছে দুর্দিনের ছায়া।
পূর্ব পুরুষের কাছ থেকে শেখা এই কর্মই কালের আবর্তে যেন মরণ বোঝা হয়ে চেপেছে তাদের ঘাড়ে। কোমলমতি ছেলে-মেয়ে নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত সহ তাদের এ শিল্পের চরম দুর্দিন যাচ্ছে এখন। দিন যতই যাচ্ছে ততই যেন ঘিরে আসছে ভয়ানক অন্ধকার। অথচ এক সময় লক্ষ্মীপুরের মৃৎশিল্প কারিগরদের এমন দূরাবস্থা ছিল না। সবসময়ে মৃৎশিল্পীরা কাজ আর কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করতো। মাটি সংগ্রহ এবং ওই মাটি দিয়ে খামির তৈরি এরপর খাঁছে বসিয়ে ইচ্ছেমত নানান রকম হাঁড়ি-পাতিল, কলস, বাসন, মাটির ব্যাংক, হান্ডি, বোটগা, শিশুদের নানান রকমের খেলনা থেকে শুরু করে পরিবারের প্রয়োজনীয় নুনের বাটিটি পর্যন্ত মাটি দিয়ে তৈরি হতো।
৮০ দশকে গ্রাম বাংলার বিশেষ করে বৃহত্তর নোয়াখালীজুড়ে ১৬ আনাই মাটির জিনিসপত্র ব্যবহার করা হতো। তৎকালীন সময়ে বিয়ে, কুলখানি, কাঙ্গালীভোজ, মসজিদের শিরনী থেকে শুরু করে সবপ্রকার সামাজিক অনুষ্ঠানেও এই মাটির জিনিসপত্রের ব্যবহার হতো।
এখন আর জেলায় কুমারদের খুঁজে পাওয়ায় মুশকিল হয়ে উঠেছে। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার তেওয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের কুমার বাড়িতে এক সময় ২৪ পরিবারের প্রায় ১৩০ জন কুমার এ পেশার সাথে জড়িত ছিল। বর্তমানে মাত্র ৪টি পরিবারের ১৮ জন কুমার পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য রক্ষায় এ পেশায় কাজ করছেন।
কুমার কুমদ চন্দ্র পাল ও তার স্ত্রী কাঞ্চন রাণী পাল জানান, আগে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ১৬ আনাই মাটির জিনিসপত্র তৈরি করতাম। তখন এই জিনিসগুলো বানাতে যে মাটি লাগতো তা আমাদের এই অঞ্চলে পাওয়া যেতো। এখন আর মাটি এই জেলায় পাওয়া যায় না। তাই এখন মাটি আনতে হয় নোয়াখালীর চৌশুহনীর জমিদার হাট এলাকা থেকে। এতে আমাদের খরচ আগের তুলনায় অনেক বেশি। আগে ১ পিক আপ এঁটেল মাটি পাওয়া যেতো ৫-৬ হাজার টাকায়। বর্তমানে ১০-১২ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে মাটি। তিনি বলেন আমাদের টাকা-পয়সা না থাকায় এখন আর তেমন মাটির পণ্য তৈরি করি না। এখন মাত্র ৪ পরিবার এ পেশায় জড়িত রয়েছি।
কুমার দিপক কুমার পাল ও তার স্ত্রী বিউটি রাণী পাল জানান, বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির প্লাস্টিকের কদর বাড়ায় আমরা এখন বানাচ্ছি মাত্র ১-২ রকম জিনিস। কালের আর্বতনে আর আধুনিকতার কারণে আমরা মৃৎশিল্পীরা যে স্বপ্ন দেখেছি, সেই স্বপ্নগুলো যেন স্বপ্নই থেকে গেল। আর সেই থেকে আমাদের মৃৎশিল্পীদের পরিবারে দুর্দিন শুরু হয়েছে। আগে কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকতাম কিন্তু এখন যে কাজ তা অতিসামান্য যা দিয়ে আমাদের জীবন চলাই দুষ্কর।
৮৫ বছর বয়সী শিপু রাণী পাল দৈনিক জাগরণকে বলেন, বর্তমান যুগে মৃৎশিল্পের পুনঃজাগরণ কিংবা এ পেশায় তাদের সুদিন ফিরে আর আসবে না। তবুও বাপ-দাদার এই শিল্পকেই আঁকড়ে ধরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চান তারা।
কুমার জনার্ধন পাল দৈনিক জাগরণকে বলেন, অর্থের অভাবে এ পেশা থেকে দিন দিন সবাই সরে যাচ্ছে। দেশের অন্যান্য জেলায় কুমারদের জন্য সরকার ভাতা দিচ্ছে। কিন্তু লক্ষ্মীপুরের কুমাররা কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাচ্ছে। দেশের ঐতিহ্য রক্ষায় সরকার কিছু সাহায্য সহযোগিতা করলে এ পেশাটাকে আখড়ে রাখা যেতো। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এ কুমার।
লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক অঞ্জন চন্দ্র পাল দৈনিক জাগরণকে বলেন, প্লাস্টিকের চাহিদা বৃদ্ধিতে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প। প্লাস্টিক ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় দিন দিন মাটির তৈরি তৈজসপত্র আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলায় মৃৎশিল্পগুলো ব্যবহার হচ্ছে না বলে জানান তিনি।
কেএসটি