• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৭ মে, ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ১৭, ২০১৯, ১০:৪৮ এএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ১৭, ২০১৯, ১০:৪৮ এএম

নড়াইলে দেশের বৃহৎ ব্যাটারি রিসাইকেল প্লান্ট 

নড়াইলে দেশের বৃহৎ ব্যাটারি রিসাইকেল প্লান্ট 
নড়াইলে পরিবেশ বান্ধব ব্যাটারি রিসাইকেল প্লান্ট কারখানার দৃশ্য- ছবি: জাগরণ

নড়াইলে প্রথম ব্যক্তিগত উদ্দ্যোগে পরিবেশ বান্ধব ব্যাটারি রিসাইকেল প্লান্ট তৈরির কারখানা নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে এলাকার শতাধিকসহ দেড় শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। এর আগে এখানে কোন শিল্প-কলকারখানা ছিল না। তবে এত বছরেও এ জেলায় শিল্প কলকারখানা নির্মাণ না হলেও পদ্মা সেতু, কালনা সেতু, ঢাকা-নড়াইল-বেনাপোল-কোলকাতা হাইওয়ে এবং রেল লাইনের কাজ শুরু হওয়ায় শিল্প উদ্দ্যোগতাদের কাছে ভৌগোলিকভাবে নড়াইলের গুরুত্ব অনেক বেড়েছে। ইতোমধ্যে নড়াইলে শিল্পকলকারখানা তৈরি করার জন্য জমি কেনাসহ কার্যক্রম শুরু করেছে ব্যবসায়ীরা। 

জানা গেছে, চিটাগাং, সিলেট, বরিশাল, খুলনা, কুমিল্লা, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পুরাতন ব্যাটারি ক্রয় করে সম্পূর্ণ মেশিনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট স্থান থেকে কেটে পুরাতন ব্যাটারির সিসা আলাদা করা হয়। পরে সিসাকে গলিয়ে বর্জ্য আলাদা করে বিশুদ্ধ সিসা বের করা হয়। বিশুদ্ধ সিসাকে গ্রে-অক্সাইড ও রেড-অক্সাইড দুইটা ভাগে ভাগ করে লুকাস, নাভানা, সাইফ পাওয়ার টেকসহ দেশের শীর্ষ স্থানীয় ব্যাটারি কারখানাতে সেই সিসা বিক্রি করা হয়। বাংলাদেশে মোট তিনটি ব্যাটারি রিসাইকেল প্লান্ট রয়েছে। মধুখালি ও গাজীপুরে আলাদা দুটি ব্যাটারি রিসাইকেল প্লান্ট আছে। দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন ক্ষমতা সম্পূর্ণ নড়াইল পৌর এলাকার উজিরপুর গ্রামের এই পরিবেশ বান্ধব ব্যাটারি রিসাইকেল প্লান্ট। পুরাতন অব্যবহৃত ব্যাটারি থেকে এখানে মাসে ৫’শ মেট্রিক টন সিসা উৎপাদন করার ক্ষমতা রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পরিবেশের কথা চিন্তা করে কারখানাটিতে রয়েছে নিজস্ব ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ও বায়ু ট্রিটমেন্ট প্লান্টের ব্যবস্থা। এই কারখানার সব বর্জ্য পানি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের মাধ্যমে ফিলটারিং হয়ে কারখানার মধ্যেই নির্দিষ্ট পুকুরে যায়। সেই পুকুরে মাছের চাষ করা হয়। বায়ু দূষণ রোধ করার জন্য এখানে বায়ু ট্রিটমেন্ট প্লান্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেশিনের মাধ্যমে বায়ু পরিশাধিত হয়ে উঁচু পাইপের মাধ্যমে বের হচ্ছে ফলে পরিবেশের কোন ক্ষতি হয় না।

কারখানার কর্মকর্তারা জানান, সিসা পরিবেশের জন্য মারাত্নক ক্ষতিকর। যেখানে সেখানে পুরাতন ব্যাটারি দীর্ঘদিন পড়ে থাকলে সেই ব্যাটারির সিসায় পরিবেশের অনেক ক্ষতি হয়। এই কারখানায় পুরাতন ব্যাটারি সংগ্রহ করে অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে সিসা সংগ্রহ করা হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পুরাতন ব্যাটারি সংগ্রহ করায় পরিবেশের অনেক উপকার হচ্ছে। এই কারখানায় দেড় শতাধিক শ্রমিক কাজ করে।  এখানে স্থানীয় শ্রমিক রয়েছে অন্তত ১শ’ জন। কারখানাটিতে এক তৃতীয়াংশ রয়েছে নারী শ্রমিক। এখানের নারী  শ্রমিক ও পুরুষ শ্রমিকদের কোন বেতন বৈষম্য নেয়। প্রতিটা শ্রমিককে প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজ করতে হয়। আট ঘণ্টার বেশি কাজ করলে সেই অতিরিক্ত সময়ে মজুরি পান শ্রমিকরা। একই কাজে প্রতিটা নারী-পুরুষ সমান মজুরি পান। একজন শ্রমিক মাসে অন্তত ১২-১৩ হাজার টাকা আয় করে থাকেন। কোম্পানির পক্ষ থেকে প্রতিটা শ্রমিককে তিন বেলা খেতে দেয়া হয়। শ্রমিকদের জন্য বিনা মূল্যে নির্দিষ্ট পোশাক রয়েছে। প্রতিটা শ্রমিককে মাসে একরাব করে কোম্পানির পক্ষ থেকে বিনামূল্যে ডাক্তার দেখিয়ে শরীর পরীক্ষা করানো হয়।

এই কারখানায় কর্মরত শ্রমিকরা জানান, এই কারখানায় যারা কর্মরত আছে তারা অধিকাংশ স্থানীয়। বাড়ি থেকে প্রতিদিন কারখানায় এসে কাজ করতে পেরে তারা খুব খুশি। 

শ্রমিক রহমত কাজি জানান, বাড়ির পাশে এমন একটি কারখানা হওয়ায় আমরা অনেক বেশি লাভবান হচ্ছি। চাকরি করে বেতনের পাশাপাশি বছরে ২টা ঈদে বোনাস পাই এতে আমরা অনেক খুশি।

শ্রমিক রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন মূল ডিউটি করার পরে দিনে ৪-৬ ঘণ্টা পর্যন্ত অভার টাইম করতে পারে তারা। প্রতিমাসে ৫-৬ তারিখের মধ্যে তারা বেতন পান। 

নারী শ্রমিক লাবনি জানান, কোম্পানি থেকে তিন বেলা খেতে দেয়ায় তাদের নিজেদের খাবারের জন্য কোন খরচ হয়না। বাড়ি থেকে তাদের কোন খাবার আনা লাগেনা এতে তাদের অনেক সুবিধা হয়েছে।

নারী শ্রমিক আসমা জানান, আগে ঢাকায় একটি ফ্যাক্টারিতে কাজ করতেন। সেখানে তার সাথে যে পুরুষরা কাজ করতো একই কাজ করে তার থেকে বেশি বেতন পেত তারা (পুরুষরা)। এই কারখানায় নারী পুরুষ কোন ভেদাভেদ নেয়। প্রতিটা নারী ও পুরুষ শ্রমিকের মুজুরি সমান। তাই তার মত সব নারীরা আনন্দের সাথে এখানে কাজ করে। 

নড়াইল চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি হাসানুজ্জামান বলেন, এই কারখানাটি নির্মাণের ফলে নড়াইলের বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, নড়াইলে অনেক শিল্পপতি আছে যারা জেলার বাইরে বিভিন্ন ভাবে প্রতিষ্ঠিত। তার দাবি, নড়াইল জেলা একটি শিল্প কলকারখানা গড়ে তোলারমত সম্ভাবনাময় জেলা। নড়াইলের মানুষের কথা চিন্তা করে এ সকল শিল্পপতিরা নড়াইলে বিভিন্ন কলকারখানা গড়ে তুলবেন এবং এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবেন এমনটায় প্রত্যাশা এই ব্যবসায়ী নেতার।

কারখানার নির্বাহী পরিচালক সুরুজ্জামান জানান, এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী ইঞ্জিনিয়র কালামের বাড়ি নড়াইল জেলায়। মূলত নড়াইলের মানুষের কর্মসংস্থানের কথা চিন্তা করে নড়াইলে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান (কলকারখানা) তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। এই প্রতিষ্ঠানটিতে সম্পূর্ণ আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করা হয়। যাতে এখানে কাজ করা শ্রমিকদের কোন রকমের শারীরিক ও মানসিক ভাবে ক্ষতি না হয়। নড়াইলে মানুষের কর্মসংস্থানে কথা চিন্তা করে আরও কয়েটি প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ কাজ চলছে।

তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে ব্যক্তিগত উদ্দ্যোগে দেশের সর্ববৃহত পরিবেশ বান্ধব ব্যাটারি রিসাইকেল প্লান্ট “কিষাণ অ্যাকুমুলেটরস্ লিমিটেড” এর একটি প্রতিষ্ঠান। ২০১৮ সালের প্রথম দিকে সফলতার সাথে উৎপাদন শুরু করেছে। এই কারখানার সিসা জায়গা করে নিয়েছে লুকাস, নাভানা, সাইফ পাওয়ার টেকসহ দেশের শীর্ষ স্থানীয় ব্যাটারি কারখানাতে। শ্রমিক বান্ধব এই কারখানায় কাজ করে খুশি এখানে কর্মরত শ্রমিকরা।

জেলা প্রশাসক আনজুমান আরা বলেন, সিসা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হলেও কারখানাটিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে পরিবেশের উপর কোন প্রভাব পড়ছেনা। জেলায় আগামীতে যারা কলকারখানা নির্মাণ করতে চান, তাদেরকে পরিবেশের কথা চিন্তা করে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার অনুরোধ জানান তিনি।

টিএফ