• ঢাকা
  • বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ২২, ২০১৯, ০৯:২৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ২২, ২০১৯, ০৯:২৮ পিএম

ছেলের অট্টালিকায় ঠাঁই হলো না শতবর্ষী মায়ের

ছেলের অট্টালিকায় ঠাঁই হলো না শতবর্ষী মায়ের
ছেলেমেয়ে ভালো অবস্থায় থাকার পরও এভাবেই অন্ধকারাচ্ছন্ন ভাঙা এক ঘরে একা একা দিন কাটে শতবর্ষী মরিয়ম বেগমের  ছবি : জাগরণ

স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নিজ মালিকানাধীন তিনতলা ভবনে বসবাস একমাত্র ছেলে কিরণ শিকদারের। আর স্ত্রীর বাধায় সেই অট্টালিকায় ঠাঁই হলো না শতবর্ষী বৃদ্ধ মা মরিয়ম বেগমের। তার ঠাঁই হলো পার্শ্ববর্তী মহল্লায় ভাড়া করা একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ভাঙা ঘরে।

শতবর্ষী মরিয়ম বেগম নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার পলাশ বাজার এলাকার মৃত মজনু মিয়ার স্ত্রী। ২০ বছর আগে মারা যান স্বামী মজনু মিয়া। তার একমাত্র ছেলে কিরণ শিকদার স্থানীয় ডেকোরেটর ব্যবসায়ী ও ঘোড়াশাল পৌর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি।

স্ত্রীর কথায় গত রমজান মাসে বৃদ্ধ মাকে পার্শ্ববর্তী নতুন বাজার এলাকার জনৈক গফুর মিয়ার একটি ভাঙা অন্ধকারাচ্ছন্ন টিনের ঘরে রেখে গেছেন একমাত্র ছেলে কিরণ শিকদার। সেখানে গিয়ে ছেলে মাঝেমধ্যে কিছু বাজার সওদা করে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করলেও বৃদ্ধা মরিয়মের দেখাশোনা করছেন প্রতিবেশী ভাড়াটিয়ারা।

স্থানীয়রা এ সংবাদদাতাকে জানান, বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন শতবর্ষী মরিয়ম বেগম। লাঠিতে ভর দিয়ে কোনো রকমে হাঁটতে পারেন। এই হাতের লাঠিই যেন তার হাঁটাচলার সম্বল। একমাত্র ছেলে কিরণ শিকদার তার স্ত্রী লিপির কথায় গত রোজার মাসে মাকে রেখে গেছেন পলাশ নতুন বাজার এলাকার গফুর মিয়ার মালিকানাধীন অন্ধকারচ্ছন্ন একটি টিনের ভাঙা ঘরে। অথচ ওই ঘরের কিছু দূরেই রয়েছে ছেলের একটি তিনতলা ভবন, যেখানে কিরণ শিকদার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বসবাস করেন। মা মরিয়ম বেগমের ভাঙা ঘরের ভেতর একটি পুরোনো তোশক আর থালা-বাসন ছাড়া কিছুই নেই। এই অন্ধকার ঘরেই একা একা দিন পার করছেন এই বৃদ্ধা। মনের ইচ্ছে ছিল ছেলেমেয়ে আর নাতি-নাতনি নিয়ে জীবনের বাকিটা সময় সুখে-শান্তিতে পার করবেন। কিন্তু এমন ভাগ্য হলো না এই হতভাগিনী মায়ের।

মরিয়ম বেগমের এক ছেলে ও এক মেয়ে। মরিয়ম বেগমের সাথে কথা বললে তিনি জানান, ‘ছেলের বউ আমাকে তাদের সাথে রাখতে চায় না। তাই ছেলে আমাকে এখানে রেখে গেছে। ছেলে মাঝেমধ্যে এসে আমাকে বাজার-সওদা করে দিয়ে যায়। আর এভাবেই দিন পার করতে হচ্ছে।’

একা একা এখানে থাকতে কেমন লাগে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে অনেক কিছু চাওয়া-পাওয়ার থাকলেও কিছুই করার নেই। আমার অনেক ইচ্ছে ছিল জীবনের শেষ সময়ে ছেলেসন্তান, নাতি-নাতনিকে নিয়ে হাসি-খুশিতে দিনগুলো পার করব। কিন্তু কী করার আছে, আমার কপালে সেই সুখ নাই। আমার ছেলের ইচ্ছা থাকলেও সে তার স্ত্রীর জন্য পারছে না। আমাকে তাদের সাথে রাখার কথা শুনলে তার স্ত্রী লিপি আক্তার ছেলের সাথে ঝগড়া করে। এখানে আসার আগে চলনা এলাকার গ্রামের বাড়িতে একা একা দিন পার করেছি। তারপর ছেলে বলল আমাকে তার কাছে নিয়ে আসবে। ভাবছিলাম তার বাড়িতে তুলবে। পরে দেখি সে আমাকে এখানে ঘর ভাড়া করে দিয়েছে। এখানে ছেলে এসে খোঁজখবর নিলেও ছেলের বউ, নাতি-নাতনিরা কেউই আসে না। কোনো খোঁজখবরও নেয় না। মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর সেও তেমন কোনো খোঁজখবর রাখতে পারে না। আমি এখন সন্তানদের বোঝা হয়ে গেছি। মাঝেমধ্যে অনেক একাকিত্ব লাগলে পাশের ভাড়াটিয়াদের সাথে কথা বলে সময় পার করি।’

মরিয়ম বেগম আরো বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে চোখের সমস্যায় ভুগছি। চিকিৎসা না করায় প্রায় ১০ বছর আগে বাম পাশের চোখটি নষ্ট হয়ে যায়। এখন ডান পাশের চোখটিতেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। হয়তো এটিও নষ্ট হয়ে যাবে।’
 
দিনা বেগম নামের পাশের এক ভাড়াটিয়া জানান, রমজান মাসে বৃদ্ধা মাকে তার ছেলে এখানে রেখে গেছেন। রাতযাপনের জন্য ঘরে ছোট একটি চৌকি দিয়েছিলেন। সেটিও ছারপোকায় খাওয়া। তাই এটিও নাই এখন। মরিয়ম বেগম এখন মাটিতে বিছানা করে ঘুমান। এমন একজন বৃদ্ধা মাকে এভাবে একা এই অন্ধকার ঘরে রাখা খুবই অমানবিক। শুনেছি ছেলের বউ নাকি তাদের কাছে রাখতে চায় না। বউয়ের কথায় এখানে বৃদ্ধা মাকে ফেলে গেছে। মরিয়ম বেগমের রান্নাবান্না, কাপড়চোপড় ধোয়া এসব আমরাই করে দিই।’

এ ব্যাপারে ফোনে যোগাযোগ করা হলে কিরণ শিকদার বিষয়টি ব্যক্তিগত জানিয়ে বলেন, ‘ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে মাকে আমার দোকানের পাশে একটি ঘর ভাড়া করে সেখানে রেখেছি। যে মায়ের জন্য আমি পৃথিবীর মুখ দেখেছি, সেই মায়ের প্রতি আমার দায়িত্ব আছে। যেখানে রেখেছি সেখানে মায়ের খাবারদাবারসহ সব দেখাশোনা আমি নিজেই করছি। কিছুদিনের মধ্যে আমার বোন চলে আসবে। তখন আর এ সমস্যা থাকবে না।’

এনআই