• ঢাকা
  • বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ৫, ২০২১, ১১:৫০ এএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ৫, ২০২১, ১১:৫৪ এএম

প্রযুক্তির দাপটে বিলুপ্তির পথে ঘানিশিল্প

প্রযুক্তির দাপটে বিলুপ্তির পথে ঘানিশিল্প

সভ্যতার ক্রমবিকাশে প্রাচীন ঐতিহ্যের তেলের ঘানি, কলুর বলদ, কলু সম্প্রদায় আজ নতুন প্রজন্মের কাছে অচেনা ও অজানা। কালের পরিবর্তনে মেশিন চালিত কম খরচে তেল উৎপাদন এবং সয়াবিন, পাম অয়েল, কলের সরিষা তেল ব্যবহারের কারণে ঘানি সরিষা তেলের চাহিদা দিনে দিনে কমতে থাকে। দেশে সরিষার আবাদ কমে যাওয়া ও সরিষার তেলের দাম অধিক হওয়ায় ঘানি শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে।  

কলু হলো তেলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও বলদ হচ্ছে গরু। সরিষা বা তেলবীজ পেষার জন্য পশু দ্বারা চালিত যে দেশীয় যন্ত্রটি কলুরা ব্যবহার করেন সেটিই ‘ঘানি’ নামে পরিচিত। ঘানি টানবার জন্য কলু মূলত গরু কিংবা ঘোড়া ব্যবহার করেন। ঘানি তৈরি হয় কাঠ দিয়ে, যেখানে এক বিন্দু লোহা নেই। এটা তৈরি করতে রীতিমতো একটা গাছ লেগে যায়। একেকটি অংশ তৈরিতে লাগে একেক ধরনের কাঠ। প্রতিটি অংশের নামও ভিন্ন ভিন্ন। আট থেকে দশ ফুট লম্বা একটা কাণ্ডের অর্ধেকের বেশি থাকে মটিতে পোঁতা। ঘানির এটাই হলো প্রধান অংশ। এই অংশের নাম ‘গাছ’। পাকা কড়ই কাঠ এর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। গাছের ওপরে বেড় দেওয়া কাঠের একটা অংশ থাকে, যা ‘ওড়া’ নামে পরিচিত। সরিষা পেষার জন্য কাঠের লম্বা একটা দণ্ড লাগে, এটা দেখতে অনেকটা ঢেঁকির ওঁচা বা থারি মুগুরের মতো। এর নাম ‘জাইট’। বেল গাছের কাঠ এ ক্ষেত্রে বেশি উপযোগী।

জাইটকে চাপ দেওয়ার জন্য এক-দেড় হাত লম্বা এক প্রান্ত বাঁকা একটা কাঠ লাগে-এর নাম ‘ডেকা’। ডেকার বাঁকানো মাথা টুপির মতো বসে যায় জাইটের মাথায়। অন্য প্রান্ত বাঁধা থাকে একটা ভারী মোটা তক্তার এক প্রান্তের সঙ্গে। এই তক্তার নাম ‘কাতাড়ি’। গাছের নিচের অংশে একটি ছিদ্র করা হয় এবং এই ছিদ্রের লাগানো থাকে কাঠির মতো একটা চিকন কাঠ। এর নাম ‘পাতাড়ি’। এটা দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় তেল গিয়ে পড়ে নিচে রাখা পত্রে। কাতাড়ির ওপর রাখা হয় ভারি কোন জিনিস যেন সরিষা পিষে তেল বের করা যায়। কাতাড়ির সঙ্গে গরু বা ঘোড়া জুড়ে চালাতে শুরু করলেই কাতাড়ির বোঝার চাপ গিয়ে পড়ে জাইটের ওপর আর তখন জাইটের পেষণে সরিষা থেকে তেল নির্গত হয়ে পাতাড়ি বেয়ে জমা হয় পাত্রে।

কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার জিনারী ইউনিয়নের হোগলাকান্দি গ্রামের হারুন জানান, খুব কষ্ট করে বাপ-দাদার এ পেশাটি ধরে রেখেছি। তার বাড়িতে ১টি ঘানি রয়েছে। দৈনিক  থেকে ৬ কেজি সরিষার তৈল উৎপাদন হয়। তবে বর্তমান বাজারমূল্যে কোনোরকম খেয়ে পরে পেশাটি ধরে রেখেছেন তিনি। তার পরিবারের আর কেউ এ পেশার সাথে জড়িত নয়। সবাই অন্য পেশা বেছে নিয়েছে।

সিদলা ইউনিয়নের নামা সিদলা গ্রামের ছয়েদ, ধুলিহর গ্রামের সবুরসহ অসংখ্য লোকের ঘানি ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তণে সব হারিয়ে গেছে। বর্তমানে  উপজেলার কয়েকজন তাদের বাপ-দাদার এ ব্যবসা ধরে রেখেছেন।

ঘানির মালিক হারুন আরও বলেন, অন্যান্য তেলের থেকে ঘানিভাঙা তেলের দাম বেশি। এই তেলের চাহিদাও বেশি। জেলার ‌বিভিন্ন ‌এলাকার দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এখানে ছুটে আসেন ঘানির তেল কিনতে। অনেকে অগ্রিম অর্ডার দিয়ে রাখে। বিদেশেও তার এখান থেকে তেল নিয়ে যায় অনেক প্রবাসী। আচারের জন্য ঘানির তেল বেশি ব্যবহার হয়। তবে ঘানিশিল্পে লোকসানের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “এ ব্যবসায় এখন আর লাভ নেই। ঘানির তেল বিক্রিতেই যা লাভ। আর ২-১ বছরের মধ্যে এ পেশা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে বলে তিনি ধারণা করছেন।”

বর্তমান সময়েও অনেকে লাভক্ষতির হিসাব না কষে সন্ধান করেন শতভাগ প্রাকৃতিক বিশুদ্ধতার। কাঠের ঘানির খাঁটি সরিষার তেলের চাহিদা অনেক বেশি হলেও কলুদের তা উৎপাদন করে পুষিয়ে উঠা কঠিন। আধুনিক প্রযুক্তির কাছে হেরে কলুর ঘানি বই-পুস্তকে ও জাদুঘরে ঠাঁই হবে এমন মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।