• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ২৪, ২০১৯, ০৮:৪৭ এএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ২৪, ২০১৯, ০৮:৫৬ এএম

পানগাঁও কাস্টমস হাউস,পর্ব-২

উৎকোচ ছাড়া নড়ে না ফাইল, ঘুষই যেখানে শেষ কথা!

উৎকোচ ছাড়া নড়ে না ফাইল, ঘুষই যেখানে শেষ কথা!
পানগাঁও বন্দর- ছবি: সংগৃহীত

পানগাঁও বন্দরের কাস্টম কর্মকর্তাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে পোর্ট ব্যবহারকারী আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ ব্যবসায়ীরা। পিয়ন-দারোয়ান থেকে শুরু করে এসি-ডিসি-এডি পর্যন্ত ঘুষের টাকা লেনদেনের বিষয়টি অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’। ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই হচ্ছে না এখানে। অনেক সময় ঘুষ দেয়ার পরেও কাস্টম কর্মকর্তাদের হাতে লাঞ্ছনার শিকার হতে হচ্ছে তাদের। পছন্দের সিএন্ডএফ এর মাধ্যমে পণ্য খালাসের জন্য চাপ দিচ্ছেন স্বয়ং অতিরিক্ত কমিশনার। এমন অভিযোগ ভুক্তভোগী আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্টদের। সরেজমিন পরিদর্শনে এসব চিত্র উঠে এসেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, পানগাঁও পোর্টে বছরান্তে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ নেমে এসেছে অর্ধেকে। সেই সঙ্গে কমেছে কন্টেইনারের পরিমাণ। ভুক্তভোগীরা বলছেন, এইচএস কোডের সামান্য টেকনিক্যাল ভুল কিংবা অনিচ্ছাকৃত ভুলের বিষয়গুলোও সহজভাবে না দেখে চালান খালাস প্রক্রিয়া জটিল করে দেয়া হয় বিরূপ মন্তব্য লিখে। আবার দেখা যায়, তাদের সঙ্গে চালান ছাড়ে উৎকোচ প্রদানের চুক্তি হলে সেক্ষেত্রে সব ভুল মাফ হয়ে যায়। সব জটিলতা দূর হয়ে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতিটি চালান শুল্কায়নে উৎকোচ আদায় করতেই ইচ্ছাকৃতভাবে সমস্যা ও জটিলতা সৃষ্টি করা হয় বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। এসব সমস্যা করেন মূলত একজন পদোন্নতিপ্রাপ্ত সহকারী কমিশনার। যিনি এর আগে পানগাঁও টার্মিনালে রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে ছিলেন। যার কারণে লাইন-ঘাট তার সবই চেনা। ঐ কর্মকর্তা পণ্যের চালান খালাসে নির্ধারিত অঙ্কের বিনিময়ে চুক্তিবদ্ধ হন। ঘুষের দেখা না পেলে এ ধরনের চালান খালাস প্রক্রিয়া নানা কৌশলে দীর্ঘায়িত করে দেন তিনি। 

সম্প্রতি রাজধানীর নবাবপুরের এক আমদানিকারকের বেয়ারিং আসে পানগাঁও পোর্টে। উৎকোচ প্রদানের শর্তে এই কন্টেইনারে মিথ্যা ঘোষণার সব বন্দোবস্ত হয়। এই বিষয়টি জানাজানি হলে কমিশনার দুটি কন্টেইনার আটকে দেন। এখানেই শেষ নয়, কাস্টমসের একজন সহকারী কমিশনার ও অতিরিক্ত কমিশনারের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বের ফলে সম্প্রতি ৮৮টি কন্টেইনার আটকে দেয়া হয়। পরে তারা দফায় দফায় মিটিং করেন। এরপর তাদের সমোঝতা হলে রাত সাড়ে ১১টায় সেই কন্টেইনারগুলো ছেড়ে দেয়। এতে ভোগান্তিতে পড়ে আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্টরা।

বন্দরের একাধিক সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী জানান, আমদানিকারকদের পছন্দের সিএন্ডএফ এর মাধ্যমে পণ্য খালাসের চাপ দেন কাস্টম অতিরিক্ত কমিশনার সৈয়দ আতিকুর রহমান। এতে আমদানিকারক রাজী না হলে তাদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করেন। কখনও ল্যাব টেস্টের কথা লিখে দেয়া হয়, কখনও শতভাগ কায়িক পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয় অথবা এইচএস কোডের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে চালান আটকে দেয়া হয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কম শুল্কের পণ্য বাড়তি শুল্ক দিয়ে ছাড় করতে হয়। এক্ষেত্রে পোর্ট ও শিপিং লাইনের ডেমারেজ দিয়ে চড়া মাশুল গুনতে হয় আমদানিকারকদের।

আমদানিকারক ও তাদের প্রতিনিধিদের অভিযোগ, কাস্টমস কর্মকর্তারা কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। কাস্টম সরকার বা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিনিধিদের সঙ্গে ব্যবহার করেন চাকর-বাকরের মতো। কাজ হোক বা না হোক, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভালো ব্যবহারটিও পান না তারা। একাধিক ব্যবসায়ীকে তার কক্ষ থেকে বের করে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী সিএন্ডএফ এজেন্ট দৈনিক জাগরণকে বলেন, ঘুষ না দিলে পানগাঁও পণ্য খালাস হয় না। আপনারা এসব বিষয়ে এনবিআরে অভিযোগ করেন না কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের তো ব্যবসা করে খেতে হবে। অভিযোগের করলেই এসব কর্মকর্তাদের কাছে খবর চলে যায়। আর নানা অজুহাতে পণ্য আটকে দেয়া হয়। নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়।

পানগাঁও পোর্টের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, অসাধু আমদানিকারকরা সিন্ডিকেটবদ্ধ হয়ে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে পণ্যের চালান খালাস করে নিলেও প্রকৃত ও সৎ ব্যবসায়ীরা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তারা ঘুষও দিতে পারছেন না, পণ্যও ছাড়াতে পারছেন না। নানা অজুহাতে আটকে দেয়া হচ্ছে তাদের পণ্য। এতে অহেতুক অন্তহীন হয়রানির শিকার হচ্ছেন এসব ব্যবসায়ী। আর কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এই অন্তহীন হয়রানি ও অনিয়ম-দুর্নীতি থেকে উত্তরণে উপায় কী- সেই প্রশ্নের উত্তরও খুঁজে পাচ্ছেন না তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পানগাঁও কাস্টমস হাউজের কমিশনার ইসমাঈল হোসেন সিরাজীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কোন কথা বলতে রাজী হননি। পরবর্তীতে কাস্টমস হাউসের অতিরিক্ত কমিশনার সৈয়দ আতিকুর রহমানের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তারা প্রতিবেদকের ফোন রিসিভ করেননি। মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা পাঠানোর পরও কোন প্রতিউত্তর দেন নাই। 

সর্বশেষ এ বিষয়ে এনবিআরের শুল্ক নীতির দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য সৈয়দ গোলাম কিবরিয়ার সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘শুল্ক স্টেশনগুলোতে আমরা মনিটরিং অব্যাহত রেখেছি। যে কোন কাস্টমস হাউসে ব্যবসায়ীদের সমস্যা তৈরি হলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব’।

প্রসঙ্গত, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের পানগাঁও পোর্টে কন্টেইনার এসেছিলো ১ হাজার ২২৩টি। অথচ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসেছে ৯২৪ কন্টেইনার পণ্য।  এক অর্থ বছরের ব্যবধানে এখানে কন্টেইনার আমদানি কমেছে ২৯৯টি। এই কারণে রাজস্ব আদায়ও কমে গেছে। 
এদিকে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের এনবিআরের বেঁধে দেয়া লক্ষ্যমাত্রা ৯৮০ কোটি টাকার মধ্যে আদায় হয়েছে ৮৬০ কোটি টাকা। আর সদ্য বিদায়ী অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ১ হাজার ১০২ কোটি টাকার মধ্যে আদায় হয়েছে মাত্র ৫৬০ কোটি টাকা।

এআই/টিএফ/আরআই
 

আরও পড়ুন