জনতা ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক দুই অর্থ বছরে প্রায় ১৯০ কোটি টাকার মন্দ ঋণ দিয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি আগামী তিন মাসের মধ্যে আপত্তিগুলো নিষ্পত্তির সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। আপত্তি নিষ্পত্তি হল কি-না তাও জানাতে বলেছে কমিটি।
বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত সরকারী হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠক অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ২০১২-১৩ অর্থ বছরের হিসাব সম্পর্কিত মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের বার্ষিক অডিট রিপোর্ট ২০১৩-১৪ এর অডিট আপত্তির অনুচ্ছেদ ১, ২, ৩, ৪, ৫ ও ১৩ নিয়ে আলোচনা হয় এবং অডিট আপত্তিগুলো কমিটি কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশনার আলোকে নিষ্পত্তির সুপারিশ করা হয়।
কমিটির কাছে উপস্থাপিত কার্যপত্রে বলা হয়, জনতা ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক দুই অর্থ বছরে প্রায় ১৯০ কোটি টাকার মন্দ ঋণ দিয়েছে। এসব ব্যাংকের গ্রাহকের কারো কারো ব্যবসায়িক লেনদেন সন্তোষজনক না হলেও ঋণ দেয়া হয়েছে। আবার কারো কারো ব্যবসার অস্থিত্ব না থাকলেও ঋণ দেয়া হয়েছে। কেউবা একই ব্যবসার নামে একাধিকবার ঋণ নিয়েছেন। আর এসব ঘটেছে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজছে।
বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে গ্রাহকের ব্যবসায়িক লেনদেন সন্তোষজনক না। তবুও সীমাতিরিক্ত দায় রেখে সিসি (হাইপে) ঋণ নবায়ণ এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও গ্রাহকের অনুকূলে বিতরণকৃত সিসি (হাইপো) ঋণের সীমাতিরিক্ত দায় স্থিতি রেখে এলটিআর (লোন অ্যাগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিট) ঋণ সৃষ্টি করায় মেয়াদোত্তীর্ণ ও ক্ষতি হিসেবে শ্রেণীবিন্যাসিত হওয়ায় ব্যাংকের অনাদায়ী ১৩ কোটি ৯৫ লাখ ৭০ হাজার ৭ শত ৬০ টাকা মর্মে উত্থাপিত অডিট আপত্তি পেয়েছে কমিটি। আর এ কাজটি করেছে রাজধানীর মতিঝিলের জনতা ব্যাংকের করপোরেট শাখা। মেসার্স কোয়ালিটি টিম্বার ইন্ড্রান্ট্রিজকে এই ঋণ দেয়া হয়। এই ঋনের শর্ত অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে টাকা পরিশোধ করার কথা থাকলেও ওইসব টাকা এখনও পরিশোধ করা হয়নি।
কমিটি চেক ক্যাশ না হওয়াকে প্রতারণা হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং দুই মাসের মধ্যে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং অনধিক তিন মাসের মধ্যে অনাদায়ী টাকা আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে।
বৈঠক সূত্র আরো জানায়, দ্বিতীয় ঘটনাটিও জনতা ব্যাংকের। তবে ব্যাংকের শাখাটি বরিশাল। আর অপরাধী মাহদী এন্টারপ্রাইজ। রড, সিমেন্ট ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে সিসি (হাইপো) ঋণ প্রদান করা হলেও বর্তমানে ব্যবসা বন্ধ এবং প্রতিষ্ঠানটির কোন অস্তিত্ব নেই। তাই ঋণটি কু-ঋণে পরিণত হয়েছে। আর এতে ক্ষতি হয়েছে ৯২ লাখ ২৬ হাজার ৫ শত ২৭ টাকা। মেসার্স মাহদী এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স কালাম এন্টারপ্রাইজকে রড, সিমেন্ট ব্যবসার জন্য সিসি (হাইপো) ঋণ দেয়া হলেও বর্তমানে ব্যবসা বন্ধ। দোকানপাটের কোনো অস্থিত্ব নাই।
এই অডিট আপত্তির প্রেক্ষিতে কমিটি চলমান মামলা নিবিড় তদারকীর সুপারিশ করেছে কমিটি। আর প্রতিষ্ঠানটি জামানতকৃত সম্পদ বিক্রয় করে অনাদায়ী টাকা আদায়ের সুপারিশ করেছে।
সূত্র আরো জানায়, জনতা ব্যাংকের খুলনার খান-এ-সবুর করপোরেট শাখা। ঋণ দেয়ার সময় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ঋণ গ্রহীতা ও প্রকল্প নির্বাচনে অদূরদর্শিতার কারণে গ্রাহকের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন এবং ঋণটি দীর্ঘদিন যাবৎ অনাদায়ী থাকায় শ্রেণিকৃত ঋণে পরিণত হয়। এতে ক্ষতি হয় ৪ কোটি ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ২ শত ৫৭ টাকা। ঋণ নিয়েছিল জাহান জুট মিল। ঋণ দেয়ার সময় কোনো জামানতও রাখা হয়নি। জানা যায়, এদের বিরুদ্ধে এখনও কোনো মামলা হয়নি। তবে প্রস্ততি চলছে।
এ বিষয়ে কমিটির সভাপতি মোঃ রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, কত বছর কেটে গেছে এখনও মামলা হয়নি। এতেই বোঝা যায় কর্মকর্তারাও চান না দোষীদের শাস্তি হোক।
অন্যদিকে, রাজশাহীর জনতা করপোরেট শাখা থেকে একই মালিকানাধীন একাধিক প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ঋণ দেয়া হয়েছে। চলতি মূলধন ঋণ মঞ্জুর ও বিতরণের পর ঋণের টাকা পরিশোধ না করা সত্ত্বেও বারবার পুনঃতফসিল সুবিধা দেয়া হয়েছে। ঋণের টাকা আদায় না হওয়ায় খেলাপী ঋণে পরিণত ৮ কোটি ৯৭ লাখ ৬ হাজার টাকা। নিউ উত্তরা ও আসমা কোন্ড স্টোরেজ এর অনুকূলে একই ব্যক্তি বার বার ঋণ নিয়েছেন।
চট্টগ্রামের লালদীঘি জনতা ব্যাংকের ইস্ট করপোরেট শাখা। এলসির মাধ্যমে আমদানীকৃত ক্রুড পাম ওয়েল এর জাহাজী দলিলপত্র ছাড় করানোর জন্য সহায়ক জামানত ছাড়াই তিনটি বিশ্বাসের ঋণ বা লোন অ্যাগেইনেস্ট ট্রাস্ট রিসিপ্টের (এলটিআর) ঋণ মঞ্জুর করা হয় সেখান থেকে। মঞ্জুরকৃত ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ, অনাদায়ী এবং মন্দ ঋণে পরিণত হয়। এজন্য ক্ষতি হয় ৮৬ কোটি ৬৮ লাখ ৮৬ হাজার ৬৩ টাকা। নুর জাহান সুপার অয়েল লি. এই ঋণ নেয়।
অন্যদিকে, বাংলাদেশে ডেপেলপমেন্ট ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় হতে যাচাই-বাছাই না করে এমএম ভেজিটেবল অয়েল প্রোডাক্টকে এলটিআর সুবিধা দেয়। এটিও এক সময় মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। এতে ব্যাংকটির ক্ষতি হয়েছে ৭৫ কোটি ৭৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
এসব বিষয়ে কমিটির সভাপতি মো. রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। তাই ঘটনার সময় যারা দায়িত্বে ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
কমিটির সভাপতি মো. রুস্তম আলী ফরাজীর সভাপতিত্বে বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন- কমিটির সদস্য ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, আবুল কালাম আজাদ, মোঃ আব্দুস শহীদ, র,আ,ম, উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, সালমান ফজলুর রহমান, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, মনজুর হোসেন, আহসানুল ইসলাম (টিটু), বেগম ওয়াসিকা আয়েশা খান এবং মোঃ জাহিদুর রহমান।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন- সিএন্ড এজি মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, অর্থ্ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মোঃ আসাদুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংক, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক, অডিট অফিস এবং বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এইচএস/টিএফ