• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ২৮, ২০১৯, ০৯:০৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ২৮, ২০১৯, ০৯:১৪ পিএম

পুরান ঢাকার বানর

পুরান ঢাকার বানর

 পুরানো ঢাকার  বলধা গার্ডেন পেরিয়ে বেশ কিছুদূর হেঁটে গেলে  মৈশুন্ডি ভগবতী মন্দির।  সেখানে যেতেই চোখে পড়লো একদল নারী পুরুষ ছুটছে বানরের পিছনে। নতুন দুটি শাড়ি নিয়ে চলে গেছে  বানর। সবাই বলছে মধু দিয়ে দে, মধু দিয়ে দে ( বানরকে আদর করে মধু ডাকে) অনেক দূর লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে কাপড় পেচিয়ে হাতের নাগালে রেখে বানর  কাছে এসে বসে। আমি ছবি তুলতে গেলে মহিলা নিষেধ করে। তার ধারনা ক্যামেরা দেখলে বানরটা ভয় পেয়ে দূরে সরে যাবে ।

মহিলা কাপড় পাবে না। আমি ছবি তোলা থেকে বিরত হই। এরপরে মহিলা কলা বিস্কুট বানরটার কাছাকাছি  রেখে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ান। সবাইকে সরে যেতে বলেন। সবাই দূরে সরে গেলে বানর কাপড় রেখে, খাবার নিয়ে ছুটে পালায়।  মহিলার নাম চন্দনা চক্রবর্তী (৩৫)। বানরের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব বাসাগুলো দেখেন জানালায় নেট লাগানো। নেটও কখনো দুর্বল হয়ে গেলে তা ছুটিয়ে ভেতরে ঢুকে খাবার নিয়ে দে ছুট। একটু বাইরে গেলে ঘরে ঢুকে ফ্রিজের কোক পর্যন্ত খেয়ে শেষ করে বানরে।

জানালায়র পাশে দড়িতে কাপড় শুকাতে দিয়েও শান্তি নেই। তিন তলা থেকে সব কাপড়-চোপড় নীচে ফেলে দেয় বানরে। কখনো শাড়ি ছিড়েও ফেলে। কিচ্বাছু করার থাকে না। বাচ্চাদের দিয়ে কিছু বাজার থেকে আনানোই যায় না। কোন রকম খাবার জিনিস দেখলেই হলো -অমনি এ্যাটাক। খাবার ফেলে সবাই দৌড়ে পালায়। এটা যে শুধু ছোটদের হয় তা নয়, বড়দের ব্যাপারেও একই ঘটনা ঘটে। মৈশুন্ডির বিপ্লব আচার্য বলেন, চাল -চলন দেখেই বুঝে নিতে হবে এরা বানর।এখনো পুরান ঢাকার কিছু কিছু এলাকায় চোখে পড়ে বানরের লাফালাফি-ছোটাছুটি। বাড়ির দেয়াল, ছাদ এমনি কি গাছের মগডাল। পুরানো ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় চোখে পড়ে দুষ্টু বানর দলের প্রাণচঞ্চলতা ।এক দালান থেকে অন্য দালানে লাফিয়ে বেড়ানোর দৃশ্য নান্দনিকই বটে।

গেন্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোডের বাসিন্দা লিমা রেজোয়ান তিনি বলেন, পুরানো ঢাকার মানুষ পশু,পাখি প্রানীদের বেলায় অনেক মানবিক।  এখানেই বেশ কয়েকজন মানুষ আছেন যারা প্রতিদিন বানরকে খাওয়ায়।  আরো পেছনের দিকে তাকালে আমরা দেখি - সেই ১৯১৪ সাল। তখোন ঢাকার লোক সংখ্যা অনেক কম। তখোন মানুষেরা নিজের বাসভবনে বানর কেন বিভিন্ন পশু-পাখি লালন-পালন করতেন। গেণ্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোডের সাধনা ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তার যোগেশ চন্দ্র ঘোষতো প্রানী বলতেই তাকে আতিথেয়তা করাকেই সেরা কর্ম হিসাবে বিবেচনা করতেন। তিনি নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আঙিনায় বানরদের নিয়ম করে খাবার দিতেন । এমনকি একটি কক্ষও ছেড়ে দিয়েছিলেন বানরের বিশ্রামের জন্য। সেই থেকে আজ অবধি আদর, মমতা আর ভালোবাসায় বানরদের আগলে রেখেছেন তার বংশধররা। সেখানে গেলে মনে হবে জায়গাটা যেন বানরের রাজত্ব।

এটা যেন মিনি চিড়িয়াখানা। যে যেভাবে পারছে ছুটে বেড়াচ্ছে। একে অন্যের সঙ্গে খাবার নিয়ে খুনসুটি আর মারামরিতে মেতে থাকছে সরাটি দিন। তবে এ চিত্র খালি সাধনা ঔষধালয়ের। পুরানো ঢাকার এসব চিরচেনা দৃশ্য আজ খুবই কম দেখা যায়। দিনে দিনে কমছে বানরের সংখ্যা। সাধনার কর্মচারীরা বলেন, বর্তমানে আমাদের তরফ থেকে দশ কেজি বুট প্রতিদিন দেয়া হয়। বানরের তুলনায় এ পরিমান বুট খুবই কম। কিন্তু কিছুই করার নেইা

পুরান ঢাকার বাসিন্দা শ্রীকান্ত সাহা জানান, ‘একসময় স্বামীবাগের শক্তি ঔষধালয়, সাধনা ঔষধালয়সহ বেশকিছু মঠ-মন্দির-আশ্রম কর্তৃপক্ষ বানরের জন্য নিয়মিত খাবার সরবরাহ করত। এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। তবে এ এক্ষেত্রে সাধনা ঔষধালয় আজও ব্যতিক্রম। তারা এই মহৎ কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে।’ গেন্ডারিয়ার লতিফুল বারী বলেন, চিড়িয়াখানায় বানর থাকে খাঁচার ভেতরে । খাচার ভেতরে কোন প্রানীকে রাখলে তার স্বাভাবিক জীবন থাকে না। চিড়িয়াখানার বানরগলো কত স্বাস্থ্যহীন । সে তুলনায় ঢাকার বানর অনেক স্বাস্থ্যবান। খাবার সংকট না থাকলে আারো স্বাস্থ্যবান থাকতো।

 চিড়িয়াখানার বানর খাঁচার ভিতর থাকে কিন্তু এখানে তো সব খোলামেলা। একারণে দেখাও যায়। লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চলে বেঁচে থাকে বানরেরা। আগে অনেক গাছ ছিল তাতে তারা খাবার পেতো এখন তা নেই তাতে তাদের সমস্যা হচ্ছে।ক্ষুধার্ত বানর কখনো কখনো খাবারের সন্ধানে হানা দেয় আশপাশের বাড়িঘরে। যা কিছুটা ক্ষতির কারণ হলেও অনেকেই মেনে নেন তা। আবার অনেক সময় মানুষের নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছে বানর।

  বৃদ্ধ শাহজাহান মিয়া । বয়স হয়েছে ৮০ । তিনি বানর নিয়ে স্মৃতিচারন করে বলেন, সাধনা ঔষধালয় সব সময় মানুষসহ প্রানীদেরও সেবা করে। এক সময় সাধনা ঔষধালয়ে মৃতসঞ্জীবনী নামে একটা ওষুধ বানাতো। সেটা খেলে নেশা হতো। বানর ওর ফেলে দেয়া কাচামাল খেয়ে আসক্ত হযে পড়তো। তাই সাধনার সানে দেখা যেত অনেক বানর বসে ঝিমাচ্ছে।  যেই মৃতসঞ্জীবনী তৈরী বন্ধ হলো। বানরের নেশা বন্ধ হলো। এখন  নাকি পোলাপানেরা নেশা করে। এসব কথা শুনে ভাবি নেশাতো বানরের জন্য । মানুষগলো ওগুলো খেয়ে ধংস হয় কেন? জীবন অনেক ব্যস্ত হয়ে গেছে।

মানুষের এখন পশু-পাখির দিকে খেয়াল দেয়ার সময় কোথায় ? বাচ্চাদের এরকম পশু- পাখি দেখানোর মত সময় হয়না। বানর আসলে আমাদের কখনো কোন ক্ষতি করে না । বড় পোষ মানা এবং বুদ্ধিদীপ্ত  প্রানী মনে হয় বানরকে । আমরা একসঙ্গে মিলেমিশে থাকি। আমরা খাবার দিলে ওরা খেয়ে চলে যায়।
লক্ষী বাজারের বাচ্চু মিয়া বয়স সত্তোরোর্ধ বয়স। বানর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বহু সম্প্রদায়ের মানুষ ও অনেক প্রানী ছাড়া জীবন চলে না। প্রকৃতির প্রয়োজনে লাগবে না  এমন কোন প্রানীকে আল্লাহ পয়দা করে নাই।

বানর সব প্রানীর চেয়ে মানুষকে বেশী কনট্রাকট করতে পারে। আগে আমাদের পুরানো  ঢাকার মহরম বা জন্মাষ্টমীতে ঘুড়ি ওড়ানো হতো, ঘুড়ি কাটাকাটি চলতো। সেসব দিয়ে এক মহল্লার ছেলে-ছোকড়াদের সাথে প্রতিযোগিতা হতো। কখনও এই প্রতিযোগিতা আবার ধাওয়া -পাল্টা ধাওয়ায় রূপ নিতো। বানররাও তখন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে বিবাদে জড়িয়ে যেত। বাড়িরছাদ, দেয়াল, কার্নিশ, বিদ্যুতের খুঁটি, টেলিফোন বা ডিশের তার আর গাছের মগডালে দিনভর চলে তাদের বাঁদরামো।
পুরান ঢাকার কলতাবাজার এলাকার একটা বাসার ছাদে দেখা গেলো কয়েকটা বানর রুটি আর বিস্কুট খাচ্ছে। বাসার মালিক দিলীপ সরকার। জানালেন প্রায় ১৫ বছর ধরে এভাবেই খাবার দিয়ে আসছেন বানরদের। তার এই উদ্বাস্তু প্রতিবেশীরাও জানে একথা। তাই যখন যেখানেই থাকুক না কেন, খাবার দিয়ে ডাক দিলে ঠিকই ছুটে চলে আসে খেতে।


 ঢাকা শহরের বয়স চারশ বছর পূরণ করেছে আরো আগে । ঢাকা শহরের গোড়া পত্তনের সঙ্গে যেসব অনুষঙ্গ টিকে আছে থার মধ্যে বানর অন্যতম। অনুমান করা হয় ঢাকা মহরের গোড়া পত্তনের বেশ আগে থেকেই এ শহরের অন্যান্য প্রানীর মতো বানরও  ছিলো। ধীরে ধীরে শহর বর্ধিত হয়েছে বানরও সেই সাথে রয়ে গেছে। কিন্তু ঢাকা শহরের বিকাশ চুড়ান্ত আকার ধারন করলে বানরও  কমে আসেতে থাকে। তবে পুরানো ঢাকার বানরের সাথে মানুষের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলো। কিন্তু পুরানো ঢাকায় নতুন লোকজনের আগমন, ফ্ল্যাট বাড়ির আধিক্য পুরানো ঢাকার পরিবেশের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে ।

 বিশেষত ঢাকার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বানরের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। পুরানো ঢাকায় ৫  বছর আগেও যে পরিমান বানরের স্বর্গরাজ্য ছিলো  পুরানো ঢাকাএখন তা আর নেই। বানরের সংখ্যা অনেক কমে এসেছে; খাবার আর থাকার জায়গার অভাব, সেই সঙ্গে মানুষের বৈরী আচরণে পুরান ঢাকার বানরেরা এখন সঙ্কটে।
    পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়া, মিল ব্যারাক,বনগ্রাম,জনসন রোড,নবাবপুর, শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, টিপু সুলতান রোড, নারিন্দা, সূত্রাপুর, রায় সাহেব বাজার, লক্ষ্মীবাজার, রোকনপুর এলাকায় এখনও কিছু বানরের দেখা মেলে।

   জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের তথ্য অনুযায়ী, পুরান ঢাকায় চারটি গ্রুপে শ দেড়েক বানরের বসবাস রয়েছে এখন। । তবে, বৃক্ষহীনতা আর সুউচ্চ ভবনের আড়ালে প্রতিনিয়ত কমতে কমতে এখন হারিয়ে যেতে বসেছে বানর। প্রকৃতিপ্রেমীদের আশঙ্কা, এভাবে অবহেলা আর অনাদর চলতে থাকলে এক সময় পুরানো ঢাকা থেকে হারিয়ে যাবে বানর প্রজাতি। প্রাণ ও প্রকৃতির অন্যতম অনুষজ্ঞ বানর রক্ষায় ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান তাদের।