১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন দেশের বৃহত্তম গণহত্যাটি সংঘটিত হয় খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার চুকনগর বাজারে। যে দৃশ্য প্রত্যক্ষদর্শীদের মানুষপটে ভেসে উঠলে আজও শিহরিত হয়ে উঠে তাঁরা। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে ভীত, সন্তস্ত্র হয়ে ওঠে তারা। চুকনগরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ কালে পাকিস্তানী বর্বরবাহিনীর যে নৃশংসতা দেখেছে তা বর্ণানাতীত। দেখেছে প্রকাশ্যে ধর্ষনের দৃশ্য। দেখেছে প্রাণে বাঁচার তাগিদে কালীমন্দিরের পেছনে নদীর লাগোয়া ঘাটের কাছে বটগাছের শিকড় ধরে কেবল নাক বের করে থাকা সুবোল নন্দী পরিবারের নয়জনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড। পাকিস্তানি বর্বরেরা সেদিন খুনের হোলি খেলায় মেতে উঠেছিল।
তাই পানির মধ্যে লুকিয়ে থাকা মানুষদেরও নির্বিচারে হত্যা করে। ৫৬টি আর্মি ভ্যানে প্রায় একহাজার পাকিসেনা চার- পাঁচ ঘন্টা জুরে চালায় তাণ্ডব। অবিরাম এলোপাতাড়িভাবে চলতে থাকে গুলি। একদিনে তারা হত্যা করেছিলো প্রায় ত্রিশহাজার মানুষকে। যার মধ্যে এক চতুর্থাংশ ছিল শিশু কিশোর এবং বৃদ্ধা। ১৯৭১ সালের ২০ মে বাংলা ৫ জৈষ্ঠ্য বৃহস্পতিবার নৃশংস ঘটনা ঘটেছিলে ডুমুরিয়া থানার চুকনগর বাজারে।
বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হল নমশুদ্র সম্প্রদায়। বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জোয়ার-ভাটা অঞ্চলে এদের একচেটিয়া বসবাস। এরা নোনাপানি দেশের মানুষ। উত্তরে যশোরের নিম্নাংশ, নড়াইল ও গোপালগঞ্জ এবং দক্ষিণে সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্মৃত সীমানায় এদের বসবাসের হার বেশি। পেশা কৃষি কাজ, মৎস্য আহরণ, মাদুর বোনা এবং সুন্দরবন থেকে বিভিন্ন ধরনের সম্পদ আহরনের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন। বাংলাদেশের আর কোথাও এক এলাকায় এত হিন্দু জনগোষ্ঠির বসবাস দেখা যায়না। ফলে এই এলাকাটিই পাকিস্তানী শাসক ও তাদের দোসরদের কাছে উপযুক্ত টার্গেটে পরিণত হয়। খুলনার মুসলীম লীগ নেতৃবৃন্দ ছিল খুবই শক্তিশালী। সবুর খাঁন ছিলেন পাকিস্তান মুসলিম লীগের জাঁদরেল নেতা। কিন্তু নিম্নবর্গের হিন্দুদেরও তিনি তার বশ্যতা স্বীকা্র করাতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন।
যুদ্ধের শুরু থেকেই রাজাকার বাহিনী এবং শান্তি কমিটির সহায়তায় খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় শুরু হয় গণহত্যা, লুটপাট, ধর্ষন ও অগ্নি সংযোগ। ১৪ এপ্রিল পাকসেনারা প্রথম বটিয়াঘাটার চক্রাখালী স্কুলের সামনে অবস্থান নেয় এবং গানবোট থেকে সেল নিক্ষেপ করে নমশুদ্র পাড়াগুলো লক্ষ্য করে। পাকসেনাদের গণহত্যা, স্থানীয় মানুষদের লুটপাট প্রকট আকার ধারণ করে । এমতাবস্থায় কালবিলম্ব না করে ১৭ মে তারিখের পর থেকে বিভিন্ন এলাকার মানুষ বাড়ি -ঘরে টিকতে না পেরে তারা ভারতের যাওয়ার উদ্যোগ নেয়। সোনাদানা টাকা পয়সা এবং প্রয়োজনীয় কিছু খাদ্য সামগ্রী পাথেয় করে জীবন বাঁচাতে অজস্র মানুষ এসে জড়ো হয় চুকনগরে।
এর আগেও কয়েক হাজার মানুষ এই পথ দিয়েই ভারতে ঢুকেছিল। দিন যত যাচ্ছিল জীবন বাঁচাতে মানুষের দীর্ঘ সারি ছুটছিলো ভারতের উদ্দেশে। ১৯-২০ মে দিন রাত ধরে মানুষের যেন ঢল নেমেছিল। রাত- দিন দরে চলছিলো বিরামহীন জনস্রোত। বাজার এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় তিল ধারনের ঠাঁই ছিল না। চুকনগর এবং মালতিয়া ও চাকুন্দিয়া গ্রামে প্রায় ৩/৪ কি. মি. এলাকা জুড়ে সমাগম হয়েছিল প্রায় ২ লাখ লোক।
সবার মধ্যেই তখন ভারতে পৌছানোর আকুলতা। চুকনগর থেকে ২৫-৩০ কি. মি. পথ পাড়ি দিতে পারলেই ভারতের সীমান্ত । পার হতে বেশি সময়ের ব্যাপার না। কিছুদিন আগেও সাতক্ষীরা পর্যন্ত বাস-ট্রাক চলাচল করতো। পাকবাহিনীর অত্যাচারে সব বন্ধ। পায়ে হেঁটে পার হতে হয় দূরের পথ। পাকিসেনাদের চোখ এড়িয়ে পথ পাড়ি দেয়া ছিলো কষ্ট সাধ্য। স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ সাংগঠনিকভাবে যতটা সম্ভব শরনার্থীদের সহযোগীতা দানে হয়েছিল তৎপর। গ্রুপ তৈরী করে পাহারা দিয়ে সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেবার প্রস্তুতিও নিয়েছিল ১৯ মে।
ভৌগলিক দিক থেকে চুকনগর বাজারের অবস্থান ভারতে যাওয়ার জন্য ছিলো খুবই সুবিধাজনক। একারনেই যশোর, খুলনা এবং সাতক্ষীরার সংযোগস্থল হওয়ায় প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বটিয়াঘাটা, দাকোপ, ডুমুরিয়া, ফুলতলা, তেরখাদা, দিঘলিয়া, দৌলতপুর, সহ পাশ্ববর্তী এলাকার প্রায় দুলাখ মানুষ সড়ক এবং নৌপথে জীবন রক্ষার্থে ভারতে যাবার উদ্দেশ্যে এখানে সমবেত হয়। এখান থেকে সীমান্ত এলাকার দূরত্ব মাত্র ত্রিশ কিলোমিটার এবং চুকনগর বাজার অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। সে সময় সড়কপথ দুর্গম হওয়ায় অধিকাংশ পরিবারই ঘ্যাংরাইল এবং ভদ্রানদী পথে সমবেত হয়েছিল এখানে। চুকনগর হাইস্কুল, ডাকবাংলো বাজারের চাঁদনী, বটতলা মন্দির, গরুহাট, ফুটবল মাঠে তিল ধারনের ঠাঁই ছিল না। মানুষ আর মানুষ। আর নদীতে বেঁধে রাখা শত শত পরিত্যক্ত নৌকা।
চুকনগরে আসা দুলক্ষাধিক লোকের অধিকাংশই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। কিন্তু বিধিবাম। কিভাবে যেন খবর পেয়ে যায় পাকি হার্মাদ বাহিনী। ২০ মে বেলা বারোটার দিকে যশোর এবং সাতক্ষীরা সাব ক্যান্টনমেন্ট আসা গাড়ি থেকে নিরস্ত্র মানুষকে তাক করে দ্বিমুখী আক্রমন চালায় বর্বর পাকি সেনারা। পাক সেনারা হত্যা লুট করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি। ধরে নিয়ে যায় অসংখ্য যুবতী সুন্দরী মেয়েদের। যাদের খোঁজ আজও মেলেনি। হত্যাকান্ডের পর চুকনগর সংলগ্ন ঘ্যাংরাইল এবং ভদ্রানদী ছিল লাশের নদী। জোয়ারের সময় বুড়িভদ্রা এবং হরিহর নদীতে ভেসে উঠতো লাশের বহর। আবার ভাটায় নেমে যেতো।
ইতিহাসের বর্বরোচিত এ হত্যাযজ্ঞের পর এলাকার ৪২ জন মানুষ দুদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে এ সব মৃতদের গণ কবর দেয়।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক সেদিন বাংলাদেশের বৃহত্তম গণহত্যাটি সংঘটিত হয়েছিল চুকনগরের পবিত্র মাটিতে।
এটি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম গণহত্যা কিনা সে বিষয়টি অনুসন্ধানের দাবি রাখে। যে গণহত্যার শিকার হয়েছিল দশ সহস্রাধিক মানুষ। স্মরণ কালের সাড়াজাগানো এতবড়ো ভয়াবহ একটি ঘটনা ১৯৯০ দশকের পূর্ব পর্যন্ত দেশ বাসীর কাছে ছিল অজানা। আমাদের দূর্ভাগ্য যে, পনেরো খন্ড সম্মলিত স্বাধীনতা যুদ্ধের মুদ্রিত দলিল এবং প্রকাশিত গণহত্যা বিষয়ক পুস্তকে চুকনগরে সংঘটিত গণহত্যার বিষয়টি স্থান পায়নি। ১৯৯৩ সালে গঠিত হয় চুকনগর গণহত্যা ’৭১ স্মৃতি রক্ষা পরিষদ। সেই থেকে প্রতি বছর এই ব্যানারের আওতায় পালিত হচ্ছে ২০ মে চুকনগর গণহত্যা দিবস।
২০০৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠা করা হয় “চুকনগর গণহত্যা-৭১ স্মৃতিস্তম্ভ” চুকনগরেও প্রতিবছর পালিত হয় “গণহত্যা দিবস”।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জন্ম জরুল, আমাদের অহংকার। চুকনগরে সংঘটিত গণহত্যা বাংলাদেশের বৃহত্তম গণহত্যা এমনকি পৃথিবীর অন্যতম গণহত্যার এটা একটি । যে মূল্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি তাকে ভুলে গেলে চলবে না। তাই তরুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করতে চুকনগর গণহত্যাকে পাঠ্যসুচীর অন্তর্ভূক্তি করা উচিত।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট