• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৪, ২০১৯, ০২:৪৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ২৪, ২০১৯, ০৪:০৫ পিএম

নুসরাত হত্যাকাণ্ড

 ‘দোষীদের শাস্তি হওয়া আমাদের কাজের সফলতা’

 ‘দোষীদের শাস্তি হওয়া আমাদের কাজের সফলতা’
বনজ কুমার মজুমদার -ফাইল ছবি

ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা মামলায় ১৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন আদালত। এতে অনেকটা গর্ববোধ করছেন মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআইর প্রধান বনজ কুমার মজুমদার।

তিনি বলেছেন, বিচারকের এ রায়ে ন্যায্য বিচার ও অপরাধীদের শাস্তি প্রতিফলিত হয়েছে। দোষী সকলের শাস্তি হওয়ায় আমরা আমাদের কাজের সফলতা পেয়েছি।

বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) দুপুরে পিবিআইয়ের প্রধান বনজ কুমার মজুমদার তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।

গত ২৮ মে এক সচিত্র প্রতিবেদনে নুসরাত হত্যাকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা তুলে ধরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এতে বলা হয়, গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের দায়ে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাকে গ্রেফতার করায় তার অনুগত লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

গত ১ এপ্রিল জেলাখানায় সিরাজ উদ দৌলার সঙ্গে আসামি শামীম, নুরু উদ্দিন, ইমরান, হাফেজ আব্দুল কাদের ও রানা দেখা করে। সেখানে সিরাজ উদ দৌলা তার মুক্তির বিষয়ে জোর প্রচেষ্টা চালাতে ও মামলা তুলে নিতে নুসরাতের পরিবারকে চাপ দেয়ার নির্দেশনা দেন।
চাপ দেয়ার পরও মামলা তুলে না নিলে নুসরাতের ওপর ক্ষুব্ধ হয় আসামিরা। এছাড়া আসামি শাহাদাত হোসেন শামীম নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় ক্ষুব্ধ ছিল। ফলে শামীম, কাউন্সিলর মাকসুদ ও রুহুল আমিনের সঙ্গে আলোচনা করে নুসরাতকে ভয়ভীতি দেখানো ও প্রয়োজনে যেকোনো কিছু করার পরিকল্পনা করে। এ কাজে শামীমকে ১০ হাজার টাকা দেন কাউন্সিলর মাকসুদ। ওই টাকা দিয়ে শামীম পরিকল্পনা মোতাবেক তার দূর সম্পর্কের ভাগ্নি কামরুন্নাহার মনিকে দিয়ে দুটি বোরখা ও চার জোড়া হাতমোজা কেনায়। পরে ৩ এপ্রিল অধ্যক্ষ সিরাজের সঙ্গে আবারও জেলখানায় দেখা করে আসামি শামীম, নুরু ও কাদেরসহ কয়েকজন। এই সাক্ষাৎকারে নুসরাতকে ভয়ভীতি দেখানো ও প্রয়োজনে পুড়িয়ে হত্যা এবং হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন তিনি। পরদিন বিকালে মাদ্রাসার পাশের টিনশেড কক্ষে আসামি শামীম, নুরু, জোবায়ের, জাবেদ, পপি ও মনিসহ আরও কয়েকজন নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করে। একই দিন রাত সাড়ে ৯টায় পুনরায় মাদ্রাসার ছাত্র হোস্টেলে নুসরাত হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ৫ এপ্রিল বিকালল ৫টায় ভূঁইয়া বাজার থেকে এক লিটার কেরোসিন তেল কিনে নিজের কাছে রেখে দেয় শামীম।

পরদিন সকাল ৭টার দিকে শামীম, নুরু, কাদের মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে আসে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী ৮টা থেকে ৯টা ২০ মিনিটের মধ্যে আসামিরা যার যার অবস্থানে চলে যায়। শামীম পলিথিনে নিয়ে আসা কেরোসিন ও অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে থেকে একটি কাঁচের গ্লাস নিয়ে ছাদের বাথরুমের পাশে রেখে আসে। এ সময় মোট ৩টি বোরকা ও ৪জোড়া হাত মোজা নিয়ে সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় রাখা হয়। শামীম, জাবেদ ও জোবায়ের সাড়ে ৯টার দিকে ওই বোরখা ও হাত মোজা পরে তৃতীয় তলায় অবস্থান নেয়।

৬ এপ্রিল সকালে পরীক্ষা দিতে আসলে পরিকল্পনা মাফিক উম্মে সুলতানা পপি নুসরাতকে তার বান্ধবীকে মারধরের কথা বলে। এ কথা শুনে দৌঁড়ে ছাদে যেতে থাকে নুসরাত। দ্বিতীয় তলায় পৌঁছালে তাকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে বলে ও ভয় দেখায় পপি।
মামলা তুলে নিতে অসম্মতি জানিয়ে পপির সঙ্গে ছাদে উঠলে মনি, শামীম, জোবায়ের ও জাবেদ নুসরাতের পেছনে ছাদে যায়। ছাদে তারা নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে হুমকি দিয়ে কয়েকটি কাগজে স্বাক্ষর দিতে বলে। সেখানে তারা একটি কাগজে স্বাক্ষর দিতে বললে অস্বীকৃতি জানায় নুসরাত।

এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বাম হাত দিয়ে নুসরাতের মুখ চেপে ধরে ডান হাত দিয়ে তাকে পেছন দিকে নিয়ে আসে শামীম। পপি নুসরাতের গায়ের ওড়না খুলে জোবায়েরকে দিলে জোবায়ের ওড়না দুভাগ করে ফেলে। ওড়নার এক অংশ দিয়ে পপি ও মনি নুসরাতের হাত পেছনে বেঁধে ফেলে, অন্য অংশ দিয়ে জোবায়ের পা পেঁচিয়ে ফেলে। জাবেদ পায়ে গিট দেয়। সবাই মিলে নুসরাতকে ছাদের মেঝেতে ফেলে দিলে শাহাদাত নুসরাতের মুখ ও গলা চেপে রাখে। মনি নুসরাতের বুকের ওপর চাপ দিয়ে ধরে এবং পা চেপে ধরে পপি ও জোবায়ের। জাবেদ পাশের বাথরুমে লুকানো কেরোসিনের পলিথিন থেকে কাঁচের গ্লাসে কেরোসিন নিয়ে নুসরাতের পুরো গায়ে ঢেলে দেয়। শামীমের ইশারায় ম্যাচ দিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় জোবায়ের।

নুসরাতের আগুন লাগিয়ে জোবায়ের প্রথমে ছাদ থেকে নামে। এরপর পপি ছাদ থেকে নেমে যেতে থাকে। এ সময় মনি পপিকে ‘কাম কাম চম্পা/শম্পা’ বলে ডেকে নিচে নেমে যায়। মনি ও পপি নিচে নেমে পরীক্ষার হলে ঢুকে যায়। সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় গিয়ে বোরখা খুলে ফেলে জাবেদ ও শামীম। জাবেদ শাহাদাতকে তার বোরখা দিয়ে দ্রুত নেমে পরীক্ষার হলে ঢোকে। শামীম নেমে মাদ্রাসার বাথরুমের পাশ দিয়ে চলে যায় এবং মাদ্রাসার পুকুরে বোরখা ফেলে দেয়।

সাইক্লোন সেন্টার থেকে নেমে মাদ্রাসার মূল গেট দিয়ে বের হয়ে যায় জোবায়ের। বোরখা ও হাতমোজা সোনাগাজী কলেজের ডাঙ্গি খালে ফেলে দেয় সে। নুরু সাইক্লোন সেন্টারের নিচে থেকে পুরো ঘটনার তদারকির দায়িত্ব পালন করে। এছাড়া আসামি মহিউদ্দীন শাকিল ও মোহাম্মদ শামীম সাইক্লোন সেন্টারের দুই সিঁড়ির সামনে পাহারায় থাকে। মাদ্রাসার মূল গেটের পাশে পাহারায় থাকে ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, আব্দুর রহিম শরীফ ও হাফেজ আব্দুল কাদের। হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার পর আসামিরা নিরাপদ স্থানে সরে গিয়ে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে বিভিন্নভাবে প্রচারণা চালায়।

অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় নুসরাত নিচে নেমে আসতে থাকলে কর্তব্যরত পুলিশ কনস্টেবল ও নাইটগার্ড আগুন নেভায়। এ সময় নুরও নুসরাতের গায়ে পানি দেয় এবং কাদের নুসরাতের ভাই নোমানকে ফোনে সংবাদ দেয়। পরে নুসরাতকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেয়া হয়। ১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুসরাতের মৃত্যু হয়।

এইচএম/একেএস

আরও পড়ুন