• ঢাকা
  • রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ৩১, ২০১৯, ১০:০৬ পিএম

২৩ বদলি 

স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে সরকার 

স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে সরকার 
স্বাস্থ্য অধিদফতরের লোগো

 

স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। খোদ প্রধানমন্ত্রী এবিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, কর্তব্য অবহেলা ও দুর্নীতিবাজদের কোনো ক্রমেই ছাড় দেয়া হবে না।প্রমাণ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের ওএসডি করা হবে।প্রধানমন্ত্রীর  এ ঘোষণার দু’দিন পরই স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীনে একাধিক হাসপাতাল ও ক্লিনিকে দুদক অনুসন্ধান করে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দাখিল করে দুদক। এরপরই দুদকের প্রতিবেদনের সুপারিশক্রমে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীনে ২৩ কর্মকর্তা ও কর্মচারিকে বদলি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। 

এদিকে দুদকের দেয়া তথ্য মতে, স্বাস্থ্য খাতের সর্বত্রই দুর্নীতি। দুর্নীতি আর অনিয়ম বেড়েই চলছে। নির্মাণ, সরবরাহ, কেনাকাটা, নিয়োগ, বদলি সবক্ষেত্রেই চলে ঘুষ লেনদেন। রাজধানীর স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবরক্ষক আবজাল মিয়া শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। দুর্নীতি সংক্রান্তে আজও আবজালের ভাই এবং শ্যালকসহ ৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। শুধু তাই নয়, তার এক ডজন নিকটাত্মীয় স্বাস্থ্য বিভাগে দুর্নীতির মাধ্যমে কোটিপতি বনে গেছেন।পাশাপাশি ভুয়া টেন্ডারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বাজেট বিভাগের সহকারী পরিচালক ডা. আনিসুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতোমধ্যে দুদক স্বাস্থ্য বিভাগে দুর্নীতি সংক্রান্ত একটি তদন্ত প্রতিবেদন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মন্ত্রী বরাবরে দাখিল করেছেন। 

দুদকের আংশিক তথ্য থেকে জানা যায়, বিশ্বখ্যাত জাপান ব্র্যান্ড ক্যাননের অথরাইজেশন লেটার জালিয়াতি করে ৮০ কোটি টাকার মেডিকেল যন্ত্রপাতি সরবরাহের টেন্ডার বাগানোর চেষ্টা চালাচ্ছে স্বাস্থ্য খাতের একটি চক্র। এই চক্রের অন্যতম হোতা এএসএল নামে একটি প্রতিষ্ঠান জাপানি ক্যাননের ভুয়া অথরাইজেশন লেটার দিয়ে এমআরআই ও সিটি স্ক্যান মেশিনসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য টেন্ডার দাখিল করেছে। মানিকগঞ্জের কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ ও ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল স্থাপন শীর্ষক প্রকল্পের ভারী যন্ত্রপাতি ক্রয়ে দাখিল করা টেন্ডার যাচাই-বাছাইয়ে ভয়াবহ এ জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে। 

জানা গেছে, অথরাইজেশন জালিয়াতি করে পুরনো মেশিন দিয়ে নতুনের দামে ৮০ কোটি টাকা বাগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত মেডিকেল কলেজের জন্য চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার টেন্ডারে এ ধরনের জালিয়াতি ধরা পড়ার পর নড়েচরে বসে স্বাস্থ্য বিভাগের প্রশাসন। দেশের স্বাস্থ্য খাতের বেহাল পরিস্থিতি নিয়ে টিআইবির অনুসন্ধানেও উঠে আসে দুর্নীতির চিত্র। এছাড়া টিআইবি প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের স্বাস্থ্য খাতের নিয়োগ, বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতি সর্বত্রই অনিয়ম-দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। এছাড়া যে কোনো টেন্ডার বা ছোটখাটো যে কোনো কাজের জন্যও গুনতে হয় ঘুষ। এক্ষেত্রে সর্বনিম্ম ১০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয় ভুক্তভোগীদের। স্বাস্থ্য অধিদফতর, সিভিল সার্জন কার্যালয় ও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীরা এ অর্থ নিয়ে থাকেন। এছাড়া বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে চিকিৎসকরা ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কমিশন নিয়ে থাকেন। আর দালালরা নিয়ে থাকেন ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। ওই প্রতিবেদনের তথ্যমতে, এ খাতে এডহক চিকিৎসক ও তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে ১ থেকে ৬৫ লাখ টাকা, বদলির ক্ষেত্রে ১০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা এবং পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেন হয়। এসব ঘুষ লেনদেনের সঙ্গে মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সিভিল সার্জন কার্যালয়সহ স্বাস্থ্য খাতের প্রতিটি বিভাগের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়। 

জানা গেছে, হাসপাতাল থেকে শুরু করে ডায়াগনস্টিক সেন্টার সর্বত্রই দালালদের উৎপাত। হাসপাতালে ভর্তি করতে দালাল, ওয়ার্ডে বেড পাওয়া নিশ্চিত করতে দালাল, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেও দালালদের সাহায্য নেয়া ছাড়া উপায় থাকে না। পঙ্গু ও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে রোগীর জন্য ট্রলি ব্যবহার করতেও গুনতে হয় টাকা। রোগীদের জন্য বরাদ্দ থাকা ট্রলি নিয়ন্ত্রণে রেখে মিটফোর্ড হাসপাতালেও বাড়তি টাকা কামান বহিরাগতরা। ছুটির দিন আর রাতে হাসপাতালগুলোর চেহারা পাল্টে যায়। বহু খোঁজাখুঁজি করেও কর্মরত ডাক্তারদের সন্ধান মেলে না। দরজা আটকে বিশ্রামে থাকা নার্সদের ডাকলে রীতিমতো ক্ষ্যাপে যান। সরকারি হাসপাতালে নানা পরীক্ষার যন্ত্রপাতিগুলো হয় অকেজো, নয় তো খোলাই হয় না বছরের পর বছর। আবার সচল যন্ত্রপাতির সংযোজন থাকলেও তা চালানোর মতো টেকনিশিয়ান নেই সেখানে। এসব কারণে ঢাকার প্রায় সব সরকারি বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্রসহ সারা দেশের মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জামাদির সুযোগ-সুবিধা রোগীদের ভাগ্যে জুটছে না। ফলে ন্যূনতম রক্ত পরীক্ষা থেকে শুরু করে ক্যান্সার নির্ণয় পর্যন্ত যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রোগীরা বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে। 

অন্যদিকে কানে মোবাইলফোন লাগিয়ে খোশগল্প করার ফাঁকে ফাঁকে রোগী দেখা ডাক্তারদের দুর্ব্যবহারের শেষ নেই। অতি সম্প্রতি এক নারী-ডাক্তারকে আপা বলার কারণে রোগী ও তার স্বজনদের লাঠিপেটা পর্যন্ত খেতে হয়েছে। কোনো রোগীর খারাপ পরিস্থিতি জানাতে গেলেও তেড়ে আসেন ডাক্তার। এক রোগী জানান, একটা ইনজেকশন পুশ করার নামে তার ডান হাতের ১৮টি স্থানে ফুটো করা হয়েছে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেজ অ্যান্ড ইউরোলজি, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) ও হাসপাতালে স্টোরকিপার ও ওয়ার্ড মাস্টার পদে ১৯৯৩ ও ১৯৯৭ সাল থেকে একই ডেস্কে কাজ করছেন। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। 

জানা গেছে, হাসপাতালে কর্মরত হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, স্টোরকিপার ও অফিস সহকারীরা ঠিকাদারদের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি, ওষুধ ও পথ্যবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে। অনেকে সরকারি হাসপাতালের ওষুধ চুরি করে বিক্রির সঙ্গেও জড়িত। স্থানীয় সন্ত্রাসী, দলবাজ ও প্রভাবশালী ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশ করে তারা হাসপাতালগুলোকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলেছেন। অপরদিকে সিট বাণিজ্য, রোগী বাগিয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে পাঠানো, পথ্যবাণিজ্য থেকে শুরু করে ছোট ও মাঝারি পর্যায়ে হাসপাতালের অনিয়ম-দুর্নীতির আগে থাকেন ওয়ার্ড মাস্টাররা। তাদের নেতৃত্বেই হাসপাতাল ও এরপর পার্শ্ববর্তী এলাকায় গড়ে উঠেছে শক্তিশালী চক্র। চিকিৎসক-কর্মকর্তারাও তাদের সমীহ করে চলেন। দালাল চক্রের কাছ থেকে কমিশন নিয়ে ওয়ার্ড মাস্টাররা প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকের জন্য রোগী বাগানোর কাজ করেন। দরিদ্র রোগীরা এসব দালাল চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। 

এইচ এম/বিএস