• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ৫, ২০১৯, ০৯:১০ এএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ৫, ২০১৯, ০১:৩৮ পিএম

পাল্টে গেলো ইরানের রাজ্য ফার্মগেট

পাল্টে গেলো ইরানের রাজ্য ফার্মগেট
কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান ওরফে ইরান

‘ক্যাসুনু, ক্যাসুনু’ (ক্যাসিনো)। কানেকানে বলার মতো করে এভাবে মাত্র দুটি শব্দে জবাব দিলেন পান - সিগারেট ফেরিওয়ালা খায়রুল ইসলাম। কিন্তু প্রশ্নের সঙ্গে জবাব মেলাতে না পেরে আরও কিছু জানতে চাইলে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আর কোনো কথা না বলে স্থান ত্যাগ করেন তিনি।শুক্রবার (০৪ অক্টোবর)বিকেলে কথা হয় তার সঙ্গে।     

ফার্মগেট ওভারব্রিজ থেকে তেজগাঁও কলেজের সামনে দিয়ে কুতুববাগ দরবার শরীফ পেরিয়ে পুরো ফুটপাতে জুড়ে নেই কোনো হকার। অথচ এখানকার পরিবেশ থাকতো লোকে লোকারণ্য, ফুটপাতসহ দুইপাশে রাস্তার অনেকখানি বেদখল করে কয়েক সারিতে বসে হকার। আজ হঠাৎ করে ফুটপাত হকারমুক্ত কেন?

এই প্রশ্নের জবাবে খায়রুল ইসলাম এমন জবাব দিলেন। বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন মার্কেটের এক ব্যবসায়ী। তার নাম, কোন মার্কেটের বা কিসের ব্যাবসায়ী - এসব কিছুই লেখা যাবে না, এমন শর্তে তিনি বলেন, সম্প্রতি ক্যাসিনো জুয়ার বিরুদ্ধে চলা অভিযানের মধ্যেই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এই (২৭ নম্বর) ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান ওরফে ইরানের বিরুদ্ধে বেদখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও সশস্ত্র মহড়া দেয়াসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তুলে ধরে ৫ - ৬ দিন আগে একটি পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।এরপর পুলিশ এই ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ করেছে।

হকারমুক্ত ফার্মগেট- ছবি: মাহমুদুল আলম

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শের ই বাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জানে আলম মুনশী দৈনিক জাগরণকে বলেন, ঢাকা সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে গত ৪-৫ দিন আগে একটি অভিযানে এই ফুটপাত হকারমুক্ত করা হয়। অভিযানে সহযোগিতা করে পুলিশ।'

হঠাৎ এই অভিযানের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফুটপাতের মালিক হচ্ছে সিটি করপোরেশন। আমরা তাদের সব সময় বলি উচ্ছেদ অভিযান চালাতে, আমরা সহযোগিতা করবো। সিটি করপোরেশনের স্থানীয় কাউন্সিলর কোনও কারণে বর্তমানে বাধা দিতে পারবেন না বা দিবেন না - এমন অনুমান করে অভিযান চালিয়েছেন কিনা। এর জবাবে ওসি বলেন, স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সহযোগিতা ছাড়া ফুটপাত দখলমুক্ত রাখা সম্ভব না। এখন দখলমুক্ত করেছি, কতদিন এভাবে দখল মুক্ত রাখতে পারবো, জানি না। 
      
অভিযানের পর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ফুটপাত দখলমুক্ত হওয়ার পর এক বৃদ্ধ ফোন করে আমাকে বলেছেন, একাত্তরের পর কখনো ফুটপাত এতো ভালো পাননি। এভাবে  অনেকেই  ধন্যবাদ দিচ্ছেন।                                     
              
উল্লেখ্য, প্রতিবেদনে ভুক্তভোগীদের বরাত দিয়ে ইরানের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, তিনি এই ওয়ার্ডের ফার্মগেট, খামারবাড়ী, রাজাবাজার ও আশপাশের এলাকার ‘অঘোষিত রাজা’। তার কথাই যেন সেখানে আইন। ফুটপাতের দোকান থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবখানেই চলে ইরান বাহিনীর চাঁদাবাজি। ইরান নিজেও সবসময় চলেন সশস্ত্র ক্যাডার বেষ্টিত হয়ে। ভয়ে এলাকার কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পান না। সম্প্রতি তার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি তামিল মুভির নায়কদের মতো সশস্ত্র ক্যাডারবেষ্টিত অবস্থায় গাড়ি থেকে নামছেন। ১ মিনিট ৩১ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে তার বহরে প্রায় ২০টি মোটরসাইকেল ও ৮টি গাড়ি দেখা যায়। ফিল্মি স্টাইলে একটি পাজেরো থেকে নামেন তিনি।

তবে সব অভিযোগই অস্বীকার করেছেন রাজধানীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকার এই কাউন্সিলর। ভাইরাল হওয়া ভিডিওর বিষয়ে জানতে চাইলে গত রোববার গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, এটা কিছুদিন আগে ‘লিডার’ নামে একটি নাটকের শ্যুটিংয়ের অংশ হিসেবে তিনি ওই ভিডিও তৈরি করেন।

হকারমুক্ত ফার্মগেট- ছবি: মাহমুদুল আলম

ইরান এক সময় তেজগাঁও কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবক লীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক। অনুসন্ধানে জানা গেছে, কলেজ জীবন থেকেই সশস্ত্র ক্যাডার পরিবেষ্টিত হয়ে চলাফেরা করেন ইরান। এক সময় এলাকাটি ছিল শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম ও তার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। সুইডেন আসলামের পর এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয় ইরান ও তার বাহিনী। তার অধীনে বেশ কয়েকজন সশস্ত্র ক্যাডার রয়েছে। তাদের কয়েকজনের হাতে লাইসেন্স করা অস্ত্রও রয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক এক সভাপতির ছত্রছায়ায় ইরান খামারবাড়ী এলাকার একক নিয়ন্ত্রণ নেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরসহ আশপাশের সরকারি দপ্তরগুলোর ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করে ইরানের ক্যাডার বাহিনী। বিভিন্ন ‘ঘুপচি’ কাজও দিতে হয় তার লোকদের। টেন্ডারবাজির পাশাপাশি ইরান দখল বাণিজ্যেও সিদ্ধহস্ত বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থানীয় বাসিন্দাদের কয়েকজন অভিযোগ করে জানান, ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে কোনো বাড়ি করতে হলে আগে কাউন্সিলর ইরানকে বড় অঙ্কের টাকা দিতে হয়। টাকা দিয়ে তার ‘ক্লিয়ারেন্স’ নিয়ে বাড়ি কাজে হাত দিতে হয়। অন্যথায় বাড়ি তৈরি করা অসম্ভব।

তারা জানান, ইন্দিরা রোডের মাহবুব প্লাজার অনেকটাই দখল করে নিয়েছেন কাউন্সিলর ইরান। এই ভবনের নবমতলায় তার ব্যক্তিগত অফিস। ইরান ও তার ক্যাডার বাহিনী এই ভবনে নিয়মিত আড্ডা দেয়। প্রকৃত মালিক অনেক চেষ্টায়ও ভবনটি ফিরে পাননি, অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মারা যান তিনি। 

স্থানীয় বাসিন্দারা আরও জানান, ইন্দিরা রোডের গ্লোব সেন্টারের কয়েকটি দোকান ইরান তার ক্যাডার চুন্নুর মাধ্যমে দখল করে রেখেছেন। প্রকৃত মালিকরা দোকানগুলো দখলমুক্ত করার জন্য অনেকবার ইরানের কাছে ধরনা দিলেও কোনো লাভ হয়নি।

অভিযোগ রয়েছে, ইরানের শাশুড়ি মনোয়ারা বেগম ২২ ইন্দিরা রোডের বাণিজ্যিক কাম আবাসিক ভবনের মালিক। তিনি কিছু দোকানের পজিশন বিক্রি করে টাকা নিয়েছেন, কিন্তু ইরান ক্ষমতা দেখিয়ে ওইসব দোকান ফের দখলে নিয়েছেন। ভুক্তভোগীদের মধ্যে এক মুক্তিযোদ্ধার পরিবারও রয়েছে। বিগত সিটি নির্বাচনের মাত্র দুদিন পর ছয় দোকানের মালিককে উচ্ছেদ করে তালা ঝুলিয়ে দেয় ইরানের বাহিনী। পাঁচতলা ওই ভবনের নিচতলায় ভাগ্যকূল মিষ্টান্ন ভান্ডার, মিতা কনফেকশনারি, ডাক্তারের চেম্বার, সেলুন, বইয়ের গোডাউন ও ফার্মেসি ছিল। ওইসব দোকানের সাইনবোর্ড খুলে ফেলা হয়।

হকারমুক্ত ফার্মগেট- ছবি: মাহমুদুল আলম

প্রতিবেদনে অনুসন্ধান থেকে বলা হয়, জানা গেছে ফার্মগেটের লেগুনা স্ট্যান্ড থেকে ইরান ও তার ক্যাডার বাহিনীর আয় প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ টাকা। লেগুনাচালকরা জানান, সম্প্রতি ডিএমপি কমিশনার ঘোষণা দেন ঢাকায় লেগুনা চলবে না। পরে ইরান ‘ওপরে’ আলোচনা করে লেগুনা চালানোর ব্যবস্থা করে দেন। কারণ এখান থেকে লেগুনাচালকরা দিনে প্রায় ২ লাখ টাকা ইরানকে দেন চাঁদা হিসেবে।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ফার্মগেটের সেজান পয়েন্ট থেকে শুরু করে পুরো ইন্দিরা রোডের ফুটপাতে তিন স্তরে দোকান বসিয়েছে ইরানের লোকজন। সেখানে জামা-জুতা, কসমেটিকস থেকে শুরু করে কাঁচাবাজার সবই আছে। সিটি করপোরেশনও কখনো সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালায় না। এসব দোকান থেকে দৈনিক ৮০-২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হয় ইরানের নামে। লাইনম্যানের মাধ্যমে এসব দোকান থেকে চাঁদা তোলা হয়। ইরানের নাম বলে শ্রমিক লীগ নেতা চুন্নু ও লাইনম্যান আনোয়ার ফুটপাত থেকে চাঁদা আদায় করেন। ব্যবসা হোক বা না হোক, ফুটপাত থেকে ইরানকে চাঁদা দিতেই হয়। আল-রাজি হাসপাতাল ও আশপাশের এলাকায় ইরানের নামে চাঁদা আদায় করে লাইনম্যান রিপনসহ ছাত্রলীগ নামধারী কয়েকজন।
   
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের কয়েকজনের আক্ষেপ থেকে প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানের কাছে আওয়ামী লীগের লোকদের কোনো জায়গাই নেই, তিনি শুধু ক্যাডার টাইপের লোকদের মাধ্যমে তার সাম্রাজ্যের রাজত্ব করতে চান। তার সঙ্গের বেশিরভাগ লোকই এক সময় বিএনপির ক্যাডার ছিল। এখন তারা আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের ওই নেতারা জানান, ইরান ও তার বাহিনী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে তেজগাঁও কলেজকেন্দ্রিক। কলেজের ভেতর শহীদ মিনার ও শহীদ মিনারের পাশে একটি কক্ষে তারা নিয়মিত আড্ডা দেয়। ওই সময় ইরান সশস্ত্র ক্যাডার পরিবেষ্টিত থাকেন। কেউ কেউ বলেন, ইরানের বেশ কয়েকটি লাইসেন্স করা অস্ত্র রয়েছে। এর বাইরেও তার কাছে বিপুল অবৈধ অস্ত্র রয়েছে।

চাঁদাবাজি ও অবৈধ দখল সম্পর্কে জানতে চাইলে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন ইরান। শাশুড়ির বিক্রি করা দোকান দখল প্রসঙ্গে ওই প্রতিবেদনে তার বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি কোনো দোকান দখল করিনি। অস্ত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে এই কাউন্সিলর বলেন, আমার সব অস্ত্রই লাইসেন্স করা। একটাও অবৈধ অস্ত্র নয়। কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন বলেও দাবি করেন তিনি।’

এমএ/বিএস 
 

আরও পড়ুন