• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৯, ২০১৯, ০৯:১৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ১৯, ২০১৯, ০৯:১৫ পিএম

গুজবকারীসহ অর্ধশত গ্রেফতার, সিন্ডিকেটের কারণেই অস্থিরতা 

গুজবকারীসহ অর্ধশত গ্রেফতার, সিন্ডিকেটের কারণেই অস্থিরতা 
কারওয়ান বাজারে শত শত লবণ ক্রেতার কারণে এলাকার পরিবেশ বিশৃঙ্খল হয়ে উঠলে একপর্যায়ে পুলিশ আসে -ছবি : জাগরণ
অরাজকতা বন্ধে কঠোর অবস্থানে আইন শৃংখলা বাহিনী

লবণ সংকট হয়েছে, এমন গুজবকে পুঁজি করে একটি মহল রাজধানীসহ সারাদেশের বিভাগীয় শহরে অরাজকতা সৃষ্টি করছে। শুধু তাই নয়, পেঁয়াজের সংকট সৃষ্টির মতো লবণের ক্ষেত্রেও ওই সিন্ডিকেট মানুষকে আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এ সকল গুজবে কান না দিতে, পাশাপাশি অস্থিরতার জবাব দিকে এরইমধ্যে আইনশৃংখলা বাহিনীকে মাঠে নামানো হয়েছে। রাজধানীসহ সারাদেশের কাঁচাবাজারে পুলিশ র‌্যাবসহ গোয়েন্দারা নজরদারি শুরু করেছে। গুজব ঠেকাতে এবং মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফেরাতে তারা কাজ করে যাচ্ছে। গুজবে জড়িত থাকার অভিযোগে রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলো থেকে ব্যবসায়ীসহ প্রায় অর্ধশত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পাশাপাশি কয়েকজনের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় তাদেরকে স্বল্প মেয়াদে সাজাও দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।    

পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা বলেছেন, দেশে লবণের কোনো ঘাটতি নেই। বরং বাড়তি লবণ নিয়ে কোম্পানিগুলো ও চাষিরা বিপাকে আছেন। দাম বাড়ার আশঙ্কা পুরোটাই গুজব। এমতাবস্থায় লবণের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে যাতে কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে তাই পুলিশ সদস্যদের দোকানে দোকানে গিয়ে তল্লাশি চালানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

আজ মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) দুপুরে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন) মনিরুল ইসলাম ওয়ারলেসে পুলিশ সদস্যদের এই নির্দেশ দেন। ডিএমপির একাধিক ওসি বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। নির্দেশনা পেয়ে থানা এলাকার পুলিশ সদস্যরা নজরদারির পাশাপাশি বিভিন্ন দোকানে গিয়ে লবণের মজুদের খোঁজখবর নিচ্ছেন।

দেশে লবণের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অতিরিক্ত দামে বিক্রির বিষয়ে বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সোচ্চার হয়েছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স। দেশের কোথাও লবণের অতিরিক্ত দাম চাইলে জরুরি সেবা ৯৯৯ এ কল দিয়ে তা জানানোর আহ্বান জানিয়েছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স। সন্ধ্যায় এক প্রেসনোটে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) মো. সোহেল রানা।

তিনি বলেন, লবণের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে এমন একটি গুজব ছড়িয়ে একটি স্বার্থান্বেষী মহল জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে যে, দেশে ৬ লাখ টন লবণ মজুদ রয়েছে, যা আমাদের চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। তাই, লবণের মূল্যবৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনা নেই। দেশের জনসাধারণকে গুজবে কান না দিতে ও বিভ্রান্তি না হতে অনুরোধ করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, দেশের কোথাও লবণের অতিরিক্ত দাম চাওয়া হলে তাৎক্ষণিকভাবে জরুরি সেবা ৯৯৯ এ ফোন করে অথবা নিকটস্থ পুলিশকে জানান।

রাজধানীর মুগদা থানার ওসি প্রলয় কুমার বলেন, লবণ নিয়ে যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা না হয় সেজন্য পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে প্রচারণা চালাচ্ছি। এ ছাড়াও কেউ অতিরিক্ত দামে লবণ বিক্রি করছে কি না, সে বিষয়ে নজর রাখছি।

ধানমণ্ডি থানা পুলিশ জানায়, ঊর্ধ্বতনের নির্দেশ পেয়ে ধানমণ্ডি ও হাজারীবাগ এলাকার সুপারশপ এবং দোকানগুলোতে লবণের খোঁজে পুলিশ যায়। গিয়ে দেখে অনেক দোকানে লবণ শেষ। কী কারণে তাদের লবণ নেই, চালানের সঙ্গে মজুদের পরিমাণ দেখা হচ্ছে। তবে বেশিরভাগ দোকানে গিয়ে লবণ পাওয়া যায়নি।

সন্ধ্যায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পুরান ঢাকার নয়াবাজারে অভিযান চালাচ্ছিল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রিট আবদুল্লাহ আল মামুন। অভিযানের শুরুতে তিনি বাজারের পাইকারি দোকানগুলোয় লবণের মজুদ নজরদারি করেন। ব্যবসায়ীদের কাছে লবণের দাম বৃদ্ধি ও সংকটের কারণ জানতে চান। 

সকাল থেকে দেশের বিভিন্ন জেলার বাজার ও খুচরা দোকানে লবণের সংকট লক্ষ করা গেছে। অনেকে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি লবণ কিনছেন বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।

ভোলায় বেশি দামে বিক্রির সময় ট্রাক ভর্তি লবণ জব্দ করা হয়েছে। সন্ধ্যায় ভোলা শহরের মহাজনপট্টির খালপাড় এলাকা থেকে লবণের ট্রাকটি জব্দ করেন ভোলা সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. কাওছার হোসেন। এসময় মো. হাসান নামের এক ব্যবসায়ীকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

দিনাজপুরে দাম বাড়ানোর পাশাপাশি মজুদ করার অভিযোগে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে বাক-বিতণ্ড, সংঘর্ষ ও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। ১৫ টাকার খোলা লবণ প্রতি কেজি ৫০ টাকা এবং প্যাকেটজাত ৩৫ টাকার লবণ একশ থেকে দেড়শ টাকা কেজি দরেও বিক্রি হয়েছে। প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি লবণ মজুদ করছে কোনো কোনো পরিবার। ৫ থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত লবণ কিনেছেন কেউ কেউ। শহরের বিভিন্ন দোকানে লবণ কিনতে উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। ভিড়ের কারণে যানজট লেগে ছিল শহরের বিভিন্ন রাস্তায়। একাধিক স্থানে মারামারি, ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটছে। গুজব এড়াতে জেলা প্রশাসন মাইকে প্রচারের পাশাপাশি বাজার মনিটরিং সেল গঠন করেছে। অতিরিক্ত মূল্যে লবণ বিক্রির অভিযোগে স্থানীয় প্রশাসন ৬ জনকে আটক করেছে বলে দিনাজপুর জেলা প্রশাসক মো. মাহমুদুল আলম জানিয়েছেন।

সন্ধ্যায় সরকারি এক প্রেস নোটে বলা হয়েছে, দেশে লবণের কোনো সংকট নেই বা এমন কোনো সম্ভাবনাও নেই। লবণ নিয়ে কিংবা অন্য কোনো বিষয়ে কোনো ব্যক্তি বা মহল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্য কোনোভাবে গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। লবণ নিয়ে কারসাজি দমনে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর মাঠে নেমেছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। মন্ত্রী বলেন, তারা বাজার মনিটর করে যাকে জেল দেয়া দরকার, তাকে জেল-জরিমানা করবে। বর্তমানে দেশে সাড়ে ৬ লাখ টন লবণ মজুদ রয়েছে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, একটি স্বার্থান্বেষী মহল লবণের সংকট রয়েছে মর্মে গুজব রটনা করে অধিক মুনাফা লাভের আশায় লবণের দাম অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এ ধরনের গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।

লবণের মজুদের কোনো সংকট নেই জানিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে প্রতি মাসে ভোজ্য লবণের চাহিদা কম-বেশি ১ লাখ মেট্রিক টন। অন্যদিকে লবণের মজুদ আছে সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিক টন। সেই হিসাবে লবণের কোনো ধরনের ঘাটতি বা সংকট হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। লবণ সংক্রান্ত বিষয়ে তদারকির জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) প্রধান কার্যালয়ে একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। কন্ট্রোল রুমের নম্বর- ০২-৯৫৭৩৫০৫ এবং ০১৭১৫-২২৩৯৪৯। 

গুজব ছড়িয়ে বেশি দামে লবণ বিক্রি করায় নেত্রকোনায় তিন ব্যবসায়ীর অর্থদণ্ড হয়েছে, হবিগঞ্জে সাজা দেয়া হয়েছে ৪ জনকে। ঠাকুরগাঁও ও গোপালগঞ্জে দুজনকে আটক করা হয়েছে।

রাজধানীর একাধিক এলাকার কাঁচাবাজারে টহল দিয়ে অর্ধশত ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। 

শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেছেন, একটি স্বার্থান্বেষী মহল লবণের সংকট রয়েছে বলে গুজব রটাচ্ছে। তারা অধিক মুনাফা লাভের আশায় লবণের দাম অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আর অসাধু ব্যবসায়ীদের হুঁশিয়ারি করে দিতে চাই, সরকারের পক্ষ থেকে আজকে জিরো টলারেন্স আমরা। যেকোনো পর্যায়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে আমরা বাধ্য হব।

এইচ এম/ এফসি

আরও পড়ুন