• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৪, ২০১৯, ০৫:৪৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ২৪, ২০১৯, ০৫:৪৬ পিএম

আওয়ামী লীগ : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি 

আওয়ামী লীগ : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি 

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল। শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের সফল রাজনৈতিক দলের তুলনায় এ দলটির অবদান কোনো অংশে কম নয়। দলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সময়ের চাহিদা পূরণে ইতিহাসে অনন্য ভ‚মিকা পালন করে চলেছে। দলটির গোড়াপত্তন ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। আওয়ামী লীগের আওয়ামী শব্দটি এসেছে উর্দু শব্দ ‘আওয়াম’ থেকে, যার অর্থ ‘জনগণ’ বা ‘জনসাধারণ’; আর লীগ (League) হলো ইংলিশ শব্দ। এর অর্থ পারস্পরিক কল্যাণসাধনের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি, গোত্র বা জাতির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সংঘ বা সংগঠন। সুতরাং আওয়ামী লীগ অর্থ জনসাধারণ-সংশ্লিষ্ট সংগঠন বা সংঘ। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র সৃষ্টির সঙ্গে যার রয়েছে নাড়ির যোগ।

প্রতিষ্ঠার পরপরই এ অঞ্চলের জনগণের প্রত্যাশা পূরণে নামের প্রতি সুবিচার করে চলেছে সংগঠনটি। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন এবং ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়সহ বিভিন্ন ঘটনায় ভূমিকা রাখার মধ্য দিয়ে ৫০-এর দশকেই আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানের অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক শক্তি। শেখ মুজিবুর রহমানসহ একঝাঁক প্রবীণ-নবীন নেতৃত্বে দীর্ঘসময় সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করে দলটি জনগণের মধ্যে আস্থার জায়গা তৈরি করে নেয়। ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ- ছয় দফার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মূলত ছয় দফার ভিত্তিতেই ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। ভোটের ফলাফল পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী মেনে নিতে গড়িমসি শুরু করলে শুরু হয় স্বাধীনতাযুদ্ধ। সে যুদ্ধেও নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে যোগ্যতার পরিচয় দেয় জনগণের সংগঠন আওয়ামী লীগ।

কিন্তু সদ্য স্বাধীন দেশে কাঙ্ক্ষিত যাত্রাপথে কাঁটা বিছিয়ে দেয়া হয়। কতিপয় বিপথগামী সেনাসদস্যের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করে সে কণ্টকাকীর্ণ পথ প্রশস্ত করা হয়। চেষ্টা করা হয় জনসাধারণের প্রত্যাশার অনেক কিছুই মুছে ফেলার। বাংলাদেশের এই সংকটকালীন সময়ে ভাগ্যগুণে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা মাঝিবিহীন নৌকার হাল ধরেন। ঈশান কোণে গর্জনরত মেঘ ধীরে ধীরে কেটে যেতে থাকে। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা আর লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ২১ বছর পর স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী সংগঠন আওয়ামী লীগ ক্ষমতা লাভ করে। কিন্তু চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র থেমে থাকে না। আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। কিন্তু এত চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ও বিপর্যয় সত্ত্বেও ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোট ভোটে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। 

সে সময় থেকেই ক্ষমতায় আসীন আওয়ামী লীগ সংগঠনটির সরকার। দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকায় দলে অনেক সুযোগসন্ধানীর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এসব নব্য অনুপ্রবেশকারীর লুটপাট-দখলবাজিতে সাধারণ মানুষ আজ অতিষ্ঠ। এদের লুটপাট-দখলবাজিতে মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার শেষ নেই। সম্প্রতি ‘ক্যাসিনোকাণ্ডের মধ্য দিয়ে লুটপাট, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নের যে ভয়াবহ চিত্র দেখা গেল, তা আমাদের অনেকের ধারণাতেই ছিল না। তাদের এসব কর্মকাণ্ডে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও ক্ষুব্ধ ।

দেশের সচেতন ও অভিজ্ঞ মহলের বিচার-বিবেচনায় আওয়ামী লীগ এ মুহূর্তে একটি বিশেষ সময়  অতিক্রম করছে। এ রকম দুঃসহ সময় আওয়ামী লীগ এর আগেও বারবার কাটিয়ে উঠেছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিব যখন জেলখানায় বন্দি, তখন জনগণকে সাথে নিয়ে আওয়ামী লীগ সে সময়ের সংকটকে অতিক্রম করেছে। দেশের মানুষ বুকের তাজার রক্ত দিয়ে শেখ মুজিবকে মুক্ত করেছে। পাকিরা জনগণের রায় মেনে না নেয়ায় ’৭১-এ স্বাধীনতার বিজয় পতাকা ছিনিয়ে এনেছে। এ পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই ’৭৫ সালে পাকিরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করায়। সে সময়ের দুঃসহ পরিস্থিতিও সামাল দিয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু সেই দুঃসময়ে যারা জান-প্রাণ দিয়ে আওয়ামী লীগকে বাঁচিয়েছিলেন, তারাই আজ দলে কোণঠাসা; পদপদবি বঞ্চিত তারা। তারা নীরব-নিশ্চুপ হাইব্রিড নেতাদের দাপটে। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগকে এসব হাইব্রিড নেতা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। বর্তমানে জনগণের সাথে তাদের সম্পর্ক খুব সামান্যই। তাদের দখল, টেন্ডার ও চাঁদাবাজিতে সাধারণ মানুষ আজ অতিষ্ঠ।

 

দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকায় দলে অনেক সুযোগসন্ধানীর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এসব নব্য অনুপ্রবেশকারীর লুটপাট-দখলবাজিতে সাধারণ মানুষ আজ অতিষ্ঠ। এদের লুটপাট-দখলবাজিতে মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার শেষ নেই। সম্প্রতি ‘ক্যাসিনোকাণ্ডের মধ্য দিয়ে লুটপাট, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নের যে ভয়াবহ চিত্র দেখা গেল, তা আমাদের অনেকের ধারণাতেই ছিল না। তাদের এসব কর্মকাণ্ডে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও ক্ষুব্ধ ।
 
আশার কথা, শেখ হাসিনা এই বিশেষ পরিস্থিতিটা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে সক্ষম হয়েছেন। তাই তিনি রাজনীতিতে নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার পর উন্নয়নের প্রতিবন্ধক এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় মনোযোগ দিয়েছেন। শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন নিজের ঘর থেকেই। চাঁদাবাজির অভিযোগে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অব্যাহতি দেয়ার মাধ্যমে তিনি যে অভিযান শুরু করেছেন, তা আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে আওয়ামী লীগে নব্য অনুপ্রবেশকারীদের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের লোকজনই  এখন যমের মতো ভয় করছে। ছাত্রলীগ দিয়ে যে অভিযান শুরু, সে অভিযান থেকে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আওয়ামী লীগের কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। দুর্নীতিবাজ দলীয় এসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি নেয়া হচ্ছে প্রশাসনিক ব্যবস্থাও। এতে সন্দেহ-অবিশ্বাস থাকলেও মানুষের মনে আশার সঞ্চার হচ্ছে।

আগামী ২০-২১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের কাউন্সিল। দলে আসবে নতুন নেতৃত্ব। ইতোমধ্যে হয়ে গেছে কৃষকলীগ, জাতীয় শ্রমিকলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং যুবলীগের সম্মেলন। সামনে আছে ছাত্রলীগের সম্মেলন। আশার কথা হলো, এবারের সম্মেলন আগের মতো গড়পরতা নয়। স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন ইমেজের নেতাদের সংগঠনের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। কৃষকলীগ, শ্রমিকলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুবলীগের নেতৃত্বেও তাই এসেছে স্বচ্ছ ইমেজের নতুন মুখ। যারা ছিলেন অনালোচিত অথচ সৎ ও ত্যাগী, তারাই আজ দায়িত্ব পেয়েছেন এসব সংগঠনের। নিশ্চিত করেই বলা যায়, সম্মেলনপর্ব শেষে আওয়ামী লীগের নবযাত্রা শুরু হবে। আওয়ামী লীগ এখন দাঁড়িয়ে আছে এক টার্নিং পয়েন্টে।

এ লড়াই কেবল একজন শেখ হাসিনা, একটি সরকার বা একটি দলের নয়। এ লড়াই আজ ১৭ কোটি মানুষের কল্যাণের জন্য, তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য। দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য এ লড়াই। অসহনীয় এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতেই দলের অস্তিত্ব-সংকট সত্ত্বেও তার কঠোর এ পদক্ষেপ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান সাধারণ মানুষকে আশান্বিত করলেও সামগ্রিকভাবে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের বদলে শুধু কয়েকজন নেতা, ঠিকাদার, কমিশনার বা চাঁদাবাজকে আটকেই কিন্তু দুর্নীতির অবসান ঘটবে না। ব্যাংকের টাকা নয়ছয়, শেয়ারবাজার লুটপাট, জমি দখল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ওয়াসা, নদী দখল, কমিশন বাণিজ্য- এ ধরনের হাজারো বিষয়ে এখনও কোনো অভিযান দৃষ্টিগোচর নয়। 

দেশের জনগণ দুর্নীতি এবং নানা ধরনের অপরাধ দমনের চটকদার অভিযান এর আগেও কম-বেশি প্রত্যক্ষ করেছে। সদ্য স্বাধীন দেশে দুর্নীতর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও নিজ দলের ২৩ গণপরিষদ সদস্যকে বহিষ্কার করেছিলেন। সংসদে পাস করেছিলেন চোরাচালান দমনের জন্য বিশেষ স্পেশাল অ্যাক্ট। জিয়া এবং এরশাদের সামরিক শাসন জারির সময়ে এবং এক-এগারোর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানগুলোর কথাও এক্ষেত্রে স্মরণীয়। খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মেয়াদে অপারেশন ক্লিনহার্টও ছিল দেশে বহুল আলোচিত। প্রতিটির ক্ষেত্রেই ধরপাকড়ে যারা আটক হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই কিছুদিন পর সদর্পে রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন। প্রয়োজনে কেউ দল বদল করেছেন, নয়তো অন্য কোনোভাবে রফা করে নিয়েছেন। মাশুল দিয়েছেন হাতেগোনা দু-চারজন মাত্র। কিন্তু রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন যে তিমিরে ছিল, আজও সে তিমিরেই রয়ে গেছে।

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা বলে কথা। তিনি দেশের জনগণের মনোভাব বোঝেন বলেই শোভন-রাব্বানীর অব্যাহতির মাধ্যমে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন। তারপর শুরু করেছেন ক্যাসিনো-সম্রাটদের বিরুদ্ধে অভিযান। যেখানেই দুর্নীতি-নৈরাজ্য, অনিয়ম বিরাজমান; সেখানেই তিনি শুদ্ধি অভিযান চালাচ্ছেন। যতদিন এ অনিয়ম-নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে না আসবে, ততদিন শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে তিনি দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এতে ক্ষীণ হলেও দেশের মানুষ আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। তাই প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আওয়ামী লীগ এ অঞ্চলের জনগণের নানা সমস্যা সমাধান করে নামের প্রতি যে সুবিচার করে চলেছে; আগামীতেও ঘুষ-দুর্নীতি, লুটপাট-দখলবাজি বন্ধের অগ্নিপরীক্ষায় আওয়ামী লীগ উত্তীর্ণ হবে বলেই সবার প্রত্যাশা।

লেখক : সাংবাদিক
 

আরও পড়ুন