• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ২০, ২০১৯, ০৭:১৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ২০, ২০১৯, ০৭:১৫ পিএম

অভিযান শুরু হোক সরকারি প্রতিষ্ঠানেও

অভিযান শুরু হোক সরকারি প্রতিষ্ঠানেও

সরকারের শুদ্ধি অভিযান সর্বমহলে প্রশংসিত। দেরিতে শুরু হলেও এ অভিযানকে বাহবা দিচ্ছেন। সরকারপ্রধানের দূরদর্শিতার পরিচয় বলেই তারা মনে করছেন। অনেকে বলছেন, এ শুদ্ধি অভিযান আরও আগে শুরু করা দরকার ছিল। এতকিছুর পরও অনেকের মাথায় নানা প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি মারছে- এ যুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কতদূর অগ্রসর হতে পারবেন, কতটুকু সফল হতে পারবেন পাহাড়সমান অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে? এ শুদ্ধি অভিযান কতদিন চলবে? যে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অন্যায়-অবিচার, ধর্ষণ-ব্যভিচার, দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে, তাতে এ কথাটি সর্বক্ষণ সাধারণ মানুষের মনে ধিকি ধিকি জ্বলছে। 

বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনীতিতে শুদ্ধাচার ফিরিয়ে আনতে দেশে দুর্নীতি, জুয়া, মাদক ও ব্যভিচারের বিরুদ্ধে লড়াই সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। এ লড়াই কেবল একজন শেখ হাসিনা, একটি সরকার বা দলের নয়। এ লড়াই ১৭ কোটি মানুষের কল্যাণের জন্য। এ লড়াই সমগ্র বাংলাদেশের জন্য। প্রধানমন্ত্রী এ কঠিন পদক্ষেপ শুরু নিজ দলের অঙ্গসংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে। চাঁদা চাওয়ার অভিযোগে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দুই শীর্ষনেতাকে পদচ্যুত করেন তিনি। গ্রেফতার করা হয়েছে যুবলীগের নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট, জিকে শামীমসহ আরও অনেককে। অনেককে নজরদারিতেও রাখা হয়েছে। গতকাল রবিবার ডিআইজি প্রিজন (হেডকোয়ার্টার্স) বজলুর রশীদকে গ্রেফতার করেছে দুদক। ক্যাসিনো কিংবা জুয়ার বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান এবং নিজ সংগঠনে শুদ্ধি অভিযান এখন সবার কাছে প্রশংসনীয় কাজ হিসেবে গণ্য হচ্ছে। 

সদ্য স্বাধীন দেশে দুর্নীতর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও নিজ দলের ২৩ গণপরিষদ সদস্যকে বহিষ্কার করেছিলেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিসমাপ্তির আগেই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ রাজনীতির নিয়ামক হয়ে দেশ দুর্নীতির অভয়াঞ্চল হয়ে ওঠে। রাজনীতি কলুষিত হয়ে রাজনীতিকদের মাঝে লোভ-লালসার জন্ম নেয়। যার ধারাবাহিকতা এখনও চলমান। এ কারণেই আওয়ামী লীগের ছাত্র ও যুব সংগঠন এখন হাইব্রিডদের দখলে। এদের দুর্বৃত্তপনা ও অপরাধমূলক কার্যকলাপে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। দেশে রাজনীতিবিদরা এখনও আছেন, তবে তারা কোণঠাসা। যার যত লাঠির জোর, যার কাছে যত বেশি চাঁদার টাকা; তার তত ক্ষমতা, তিনি তত বড় নেতা।

অসহনীয় এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতেই দলের অস্তিত্ব সংকট সত্ত্বেও কঠোর এ পদক্ষেপ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান সাধারণ মানুষকে আশান্বিত করলেও সামগ্রিকভাবে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের বদলে শুধু কয়েকজন নেতা, ঠিকাদার, কমিশনার বা চাঁদাবাজকে আটক করলেই কি দুর্নীতির অবসান ঘটবে? ব্যাংকের টাকা নয়ছয়, শেয়ারবাজারের লুটপাট, জমি দখল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ওয়াসা, নদী দখল, কমিশন বাণিজ্য- এ ধরনের হাজারো বিষয়ে কোনো নড়াচড়া দৃশ্যমান নয়। সম্প্রতি আলোচিত কয়েকটি দুর্নীতির ঘটনা জনমনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। রূপপুরের বালিশকা-, বইকা-, পর্দাকা-, পুকুর খননে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়- এ ধরনের ঘটনায় বিচলিত দেশবাসী। বালিশ, পর্দা, টিন, বই, সিল এসবে দুর্নীতির খবর প্রকাশ্যে এসেছে বলেই দেশের মানুষ জানতে পেরেছে। অপ্রকাশিত এমন অসংখ্য ঘুষ-দুর্নীতির সংবাদ আলোর মুখ দেখে না, দেশের মানুষ সেসব জানতেও পারে না।

*********************************************************

সেবা প্রদানের নামে যারা ঘুষ খাচ্ছে, ফাইল আটকে হয়রানি করছে- তাদেরকে শুধু চাকরিচ্যুতি করলেই হবে না, জেল-জুলুমের মাধ্যমে এসব দুর্নীতিবাজের মধ্যে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এটি নিশ্চিত করতে হবে- দুর্নীতি করলেই যে কাউকে শাস্তি পেতে হবে। দল বা স্বজনপ্রীতির দোহাই দিয়ে পার পাওয়ার সুযোগ কারোর নেই।

*********************************************************

সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করার পরও এ ধরনের কর্মকা-ের কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের ওপর প্রায়ই ক্ষোভ প্রকাশ করে থাকেন। রাজকর্মচারীদের বেতন দ্বিগুণ বৃদ্ধি করার হিতে বিপরীত ফল দেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। বালিশ, পর্দা, বইকা- ঘটানো ছাড়াও তাদের কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় সেবা পেতে ঘুষের রেট নাকি এখন দ্বিগুণ। সেবা প্রদানের নামে যারা ঘুষ খাচ্ছে, ফাইল আটকে হয়রানি করছে- তাদেরকে শুধু চাকরিচ্যুতি করলেই হবে না, জেল-জুলুমের মাধ্যমে এসব দুর্নীতিবাজের মধ্যে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এটি নিশ্চিত করতে হবে- দুর্নীতি করলেই যে কাউকে শাস্তি পেতে হবে। দল বা স্বজনপ্রীতির দোহাই দিয়ে পার পাওয়ার সুযোগ কারোর নেই। তবেই না সমাজ ও রাষ্ট্র নিরাপদ হবে। মানুষে মানুষে ধনবৈষম্য কমবে। চলমান উন্নয়নকে সাধারণ জনগণ স্বস্তিদায়ক মনে করবে ।

চুন খেয়ে মুখ পুড়লে দই দেখেও ভয় করে। দুর্নীতি এবং নানা ধরনের অপরাধ দমন এ দেশের জনগণ এর আগেও প্রত্যক্ষ করেছে। এ ধরনের অপরাধ দমনে চটকদার অভিযান চালানোর নজির প্রায় প্রতি দশকেই রয়েছে। স্বাধীনতার পর প্রথম সরকারের আমলে কালোবাজারি-মজুদদারির বিরুদ্ধে অভিযান, জিয়া এবং এরশাদের সামরিক শাসন জারির সময়ে এবং এক-এগারোর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানগুলোর কথা এক্ষেত্রে স্মরণীয়। খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মেয়াদে অপারেশন ক্লিনহার্টও ছিল বহুল আলোচিত। প্রতিটির ক্ষেত্রেই ধরপাকড়ে যারা আটক হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই কিছুদিন পর সদর্পে রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন। প্রয়োজনে কেউ দল বদল করেছেন, নয়তো অন্য কোনোভাবে রফা করে নিয়েছেন। মাশুল দিয়েছেন হাতেগোনা দু-চারজন। কিন্তু রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ হয়নি।

তারপরও বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা বলে কথা। তিনি অনেক কষ্ট-সাধনায় দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। প্রথমত অর্থনৈতিক উন্নয়নে তিনি দেশকে সারা বিশ্বের একটি বিস্ময়ে পরিণত করেছেন। জঙ্গি দমন, অসাম্প্রদায়িক আধুনিক চেতনায় দেশকে পরিচালিত করা। সর্বোপরি বর্তমানের এই বহুকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের বিশ্বে তিনি সবার সঙ্গে সমান বন্ধুত্ব রেখে, সবার হাত ধরে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছেন। যা পৃথিবীর খুব কম নেতাই এ কাজ করতে পেরেছেন। নিজ হাতে গড়া শোভন-রাব্বানীকে দিয়েই তিনি এ অভিযান শুরু করেছেন। যথোপযুক্ত সময়ে যথোচিতভাবেই তিনি এ অভিযান শুরু করেছেন। তারপর শুরু করেছেন ক্যাসিনো-সম্রাটদের বিরুদ্ধে অভিযান। এতে ক্ষীণ হলেও দেশের মানুষ আশার আলো দেখছেন। দেশের মানুষের চাওয়া-পাওয়া এবং আশা-আকাক্সক্ষার কথা ভালোভাবেই জানেন বলে শেখ হাসিনা যথোপযুক্ত সময়ে যথোচিত পদক্ষেপ নিয়েছেন। তাই তিনি অত্যন্ত ঠা-া মাথায় ধীর পদক্ষেপে এগোচ্ছেন। 

তাই শোভন-রাব্বানী, খালেদ মাহমুদ-জিকে শামীম, ইসমাইল হোসেন চৌধুরী স¤্রাট, ডিআইজি প্রিজন (হেডকোয়ার্টার্স) বজলুর রশীদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার পদক্ষেপ সর্বমহলে প্রশংসিত। জনগণের প্রত্যাশার মাত্রাও ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে। কিন্তু সিঁধুরে মেঘ দেখলে গোয়ালের গরু যেমন ভয় পায়, তেমনি দেশের মানুষও বঞ্চিত হতে হতে অল্পতেই ভেঙে পড়ে। অন্যায়-অবিচার, ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে এ অভিযান যেন মাঝপথে মুখথুবড়ে না পড়ে। ক্যাসিনো বা জুয়ার হাতেগোনা কয়েকজনকে গ্রেপ্তার বা জেলে পাঠানোতেই যেন এ অভিযানের সমাপ্তি টানা না হয়। শুদ্ধি অভিযান জরুরি সবখানে। প্রয়োজনে তাকে আরও কঠোর হতে হবে। দেশের মানুষ আপনার পাশে আছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ যেখানেই ঘুষ-দুর্নীতি, প্রতারণা-বাটপারির আখড়া- সেখানেই এ অভিযান চালাতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে মাও সেতুংকেও এ রকম পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল। তার দূরদর্শী পদক্ষেপের কারণেই চীন আজ দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ।
 
দেশের মাটি ও মানুষের কাছের একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেও প্রত্যাশা, দেশকে একটি সত্যিকার স্বস্তিময় ও টেকসই অর্থনীতির দেশে পরিণত করতে একটি দৃঢ়, কঠোর অথচ বাস্তবোপযোগী গাইডলাইন। 

আরও পড়ুন