• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ১৫, ২০২১, ১১:২২ এএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ১৫, ২০২১, ০৬:২৮ পিএম

ইতিহাসের কাছে এ আমার দায়

ইতিহাসের কাছে এ আমার দায়
ছবি-জাগরণ গ্রাফিক্স ডেস্ক

‘ইতিহাসের কাছে এ আমার দায়’-  বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগেই এক রকমের দৈবাৎক্রমে একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে তাঁর হত্যার পূর্বাভাষ পেয়েছিলাম। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এই লেখাটি। ১৫ই আগস্ট বার বার ফিরে আসে এবং অনুরূপভাবে আমার কাছে ইতিহাসের দায়ের বিষয়টিও সেভাবেই ফিরে আসে। কিন্ত যতবারই এই বিষয়ে লিখি ততবারই এর বর্ণনা তো একইভাবে উঠে আসে এবং আসবেও। তবে, বর্তমান যে পরিপ্রেক্ষিত লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে কুশীলবদের চেহারা পরিবর্তন হয়েছে কিন্ত ধরন রয়েই গেছে।

এই লেখাটি না লিখলে দেশ ও জাতির কাছে, সর্বোপরি ইতিহাসের কাছে আমি দায়বদ্ধ থেকেই যাব- সে জন্যই কলম ধরা। এমনিতেই বয়স আমার স্মৃতিহরণ শুরু করেছে, এখনই যদি সেখান থেকে এটুকু উদ্ধার না করি, তাহলে হয়তো পুরো ঘটনাটাই একসময় বিস্মৃতির অতল গর্ভে নিমজ্জিত হয়ে চিরকালের মতো হারিয়ে যাবে।

পঁচাত্তর সালের কথা। আমি তখন ইত্তেফাকের সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কাজ করি। পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় নিয়মিত ছাপা হয় আমার একটি অনুসন্ধানী রিপোর্টিং সিরিজ। নাম ‘ওপেন সিক্রেট’। সিরিজটা বেশ পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করার কারণে বিভিন্ন সংবাদ সূত্র (নিউজ সোর্স) আমার কাছে চলে আসত। ঠিক সেভাবেই একদিন দুপুর ১২টা নাগাদ অফিসে একটা টেলিফোন এলো। সম্ভবত ৭৫ সালের মার্চের গোড়ার দিককার কথা। আমি অফিসে বসে লিখছিলাম, অপারেটর ফোনটা থ্রু করলো রিপোর্টিং টেবিলে আমার কাছে। রিসিভার তুলে দেখি, ও প্রান্তে আছে আমার কৈশোরের সহপাঠী ও বন্ধু শাহাদত চৌধুরী, সাপ্তাহিক বিচিত্রার। সে তখনও সম্পাদক হয়নি, তবে মোটামুটিভাবে বিচিত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। শাহাদত আমাকে বলল, ‘‘তোকে একটা বোম ফাটানো ‘ওপেন সিক্রেট’ লেখার মসলা দিতে পারি। সাহস করে লিখতে পারবি?’’ বললাম, ‘আমি ভয় পাই না সে তো তুই জানিসই। বল, কিভাবে পাব!’ সে বলল, ‘সাড়ে তিনটায় তোর অফিসের নিচে একজন গাড়ি নিয়ে আসবে, খবর পাঠালে চুপচাপ চলে আসবি।’

গাড়ি এলো কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে তিনটায়। স্টিয়ারিংয়ে একহারা সুদর্শন সুবেশী এক যুবক। একটানে গাড়ি নিয়ে গেল দৈনিক বাংলার নিচে। শাহাদত নেমে এলো। আমাদের নিয়ে গাড়ি চলল বাংলা মোটরের দিকে। আমরা কেউ কথা বলছি না, যেন এক রহস্যময় অভিযানে যাচ্ছি। আমি জানি না গাড়ি কোথায় যাচ্ছে। যুবকটি গাড়িটা নিয়ে গেল ক্যান্টনমেন্টের ভেতর। তখন ক্যান্টনমেন্ট এখনকার মতো এত ইমারতে ঠাসা ছিল না। আর ক্যান্টনমেন্ট সম্পর্কে আমারও তেমন কোনো ধারণা ছিল না। বলতে পারব না কোন পথ দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো একটি বাংলো ধরনের বাড়িতে। তখন বিকেল সাড়ে ৪টা হবে। মনে হলো শাহাদত বাড়িটা চেনে এবং সম্ভবত গৃহকর্তাকেও। কারণ, আমরা যখন বাংলোর লনে রাখা চেয়ারে বসলাম, তখন সুন্দরী গৃহকর্ত্রী এলেন হাসিমুখে। শাহাদত তাঁর নাম ধরে সম্বোধন করল এবং আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল মেজর ডালিমের স্ত্রী ‘নিম্মি’ বলে। প্রসঙ্গটা ওঠাল শাহাদতই। বেইলি রোডের লেডিজ ক্লাবে অনুষ্ঠিত এক বিয়ের অনুষ্ঠানে কিভাবে এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল, তারই সবিস্তার বিবরণ। বোধহয় শাহাদতের ইচ্ছা ছিল এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি ইত্তেফাকে একটা রিপোর্ট লিখি। কিংবা হতে পারে ইচ্ছাটা ছিল অন্য কারও, যা প্রকাশিত হয়েছে শাহাদতের মাধ্যমে।

..............‘’..............

অফিসে ফিরে লিখলাম রিপোর্ট- লেডিজ ক্লাবের ঘটনার বিন্দুমাত্র উল্লেখ তাতে নেই- আছে কিছুসংখ্যক তরুণ সেনা কর্মকর্তার গোপন বৈঠক এবং ক্ষোভের বিস্তারিত বিবরণ আর আসন্ন বিপর্যয়ের আভাস। শিরোনাম ছিল ‘তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের গোপন বৈঠক’ শোল্ডার হেডিং এবং মূল হেডিং ‘সেনা বিদ্রোহের আশঙ্কা’।

..............‘’..............

আমরা যখন লনে কথা বলছিলাম, তখন বাংলোর একটি কক্ষ থেকে ছয়-সাতজন তরুণ সেনা কর্মকর্তাকে বের হতে দেখলাম। শাহাদত তাদের একজনের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল, মেজর ডালিম। শ্যামলা, সুদর্শন। মেজর ডালিম তার বন্ধুদের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিল। তাদের মধ্যে তিন-চারজনের নাম লিখে রেখেছিলাম পরে আমার রিপোর্টে। কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশীদ, মেজর নূর, কর্নেল শাহরিয়ার। পরে শাহাদতের কাছ থেকে জেনেছি, ঘাতকচক্রের আরও কয়েকজন ছিল এবং ওখানে ওদের গোপন বৈঠক হচ্ছিল। ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পর কর্নেল ফারুককে খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছিল এবং তার কথাবার্তাও ছিল বল্গাহীন। রশীদকে মনে হচ্ছিল শান্ত, স্বল্পভাষী এবং নীরব পর্যবেক্ষণকারী। মেজর নূরকে দেখলাম, নিস্পৃহভাবে একটা কাঠি দিয়ে পাঁচিলের একটা গর্ত খোঁচাচ্ছে। মেজর ডালিম আমাকে বারবার অনুরোধ করছিল লেডিজ ক্লাবের ঘটনাটা লেখার জন্য। ওদিকে কর্নেল ফারুক সক্রোধে বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিষোদগার করছিল এবং কর্কশকণ্ঠে আমাকে বলছিল, ‘ইউ উইল সি, দেয়ার ইউল বি আ ন্যাশনাল ইস্যু ভেরি সুন।’ (তুমি দেখো, শিগগিরই একটা জাতীয় ইস্যু তৈরি হবে।) যতই আমার বন্ধু শাহাদত, মেজর ডালিম ও তার স্ত্রী আমাকে লেডিজ ক্লাবের ঘটনা নিয়ে লেখার জন্য পীড়াপীড়ি করুক না কেন, আমার মস্তিষ্কের গভীরে তখন ‘ওপেন সিক্রেট’-এ এক বিপজ্জনক প্রতিবেদন দানা বাঁধছে। বারবার মনে হচ্ছিল, লেডিজ ক্লাবের ঘটনা পত্রিকায় ছাপানোর উদ্দেশ্য এক ক্রমঘনায়মান ষড়যন্ত্রকে আড়াল করার প্রয়াস মাত্র। কিন্ত ওই বিপজ্জনক স্থানে বসে আমার মানসিক অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ সঠিক হবে না অনুমান করে নীরব থাকলাম।

শিল্পীর তুলিতে রক্তাক্ত জাতির পিতা। ছবি- সংগৃহীত। 

সন্ধ্যায় আমি ফিরলাম আমার অফিসে। শাহাদত হাটখোলায় তার বাড়িতে। পথে শাহাদত জিজ্ঞেস করল, ‘স্টোরিটা কেমন বলে মনে হয়?’ বললাম, ‘দারুণ’! শাহাদত বলল, ‘তুই ভালো বুঝিস কী লিখবি, কিভাবে লিখবি!’ অফিসে ফিরে লিখলাম রিপোর্ট- লেডিজ ক্লাবের ঘটনার বিন্দুমাত্র উল্লেখ তাতে নেই- আছে কিছুসংখ্যক তরুণ সেনা কর্মকর্তার গোপন বৈঠক এবং ক্ষোভের বিস্তারিত বিবরণ আর আসন্ন বিপর্যয়ের আভাস। শিরোনাম ছিল ‘তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের গোপন বৈঠক’ শোল্ডার হেডিং এবং মূল হেডিং ‘সেনা বিদ্রোহের আশঙ্কা’।

                                                        ..............‘’..............

পাকিস্তান আমলে একসময় আমার চিফ রিপোর্টার ছিলেন তাহেরউদ্দিন ঠাকুর। তিনি তখন বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রভাবশালী তথ্য প্রতিমন্ত্রী। গেলাম তাঁর কাছে, খুলে বললাম ঘটনার কথা, আশঙ্কার কথা। জানতাম, তাহের ঠাকুর বঙ্গবন্ধুর খুব বিশ্বস্ত। তাই চাইলাম, তিনি যেন বঙ্গবন্ধুকে খুলে বলেন সব কিছু। ১৫ আগস্টে বুঝেছিলাম, কী ভুল জায়গায় কথা বলেছি আমি।

..............‘’..............

রাতে লেখাটা সরাসরি প্রেসে পাঠিয়ে দিয়ে চলে গেলাম বাড়িতে। তখন বার্তা সম্পাদক মরহুম আসফউদ্দৌলা রেজা। আমার লেখার ওপর তাঁর এতখানি আস্থা ছিল যে তিনি স্ক্রিপ্ট দেখতে চাইতেন না। আমি বাসায় ফিরে ভাবছি একটা দারুণ চাঞ্চল্যকর ‘ওপেন সিক্রেট’ ছাপা হবে পরদিন। কিন্ত দেখলাম, পরদিন রিপোর্টটা ছাপা হয়নি। রেজা ভাই টেলিফোনে জানালেন, চিফ ফোরম্যান খন্দকার বজলুর রহমান আমার লেখা নিয়ে রেজা ভাইকে দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘রেজা সাহেব, এই ‘ওপেন সিক্রেট’টা নিয়ে ছোট সাহেবের (আনোয়ার হোসেন মঞ্জু) সঙ্গে কথা বলেন।’’ রেজা ভাইয়ের কাছ থেকে বিষয়টি শুনে সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু লেখাটি না ছাপানোর নির্দেশ দেন এবং আমাকে বলা হয়, আমি যেন ‘ওপেন সিক্রেট’ সিরিজটি বন্ধ করে দিই।

সেই মুহূর্তে আমার কাছে ‘ওপেন সিক্রেট’ সিরিজের চেয়ে পরিস্থিতিটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তান আমলে একসময় আমার চিফ রিপোর্টার ছিলেন তাহেরউদ্দিন ঠাকুর। তিনি তখন বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রভাবশালী তথ্য প্রতিমন্ত্রী। গেলাম তাঁর কাছে, খুলে বললাম ঘটনার কথা, আশঙ্কার কথা। জানতাম, তাহের ঠাকুর বঙ্গবন্ধুর খুব বিশ্বস্ত। তাই চাইলাম, তিনি যেন বঙ্গবন্ধুকে খুলে বলেন সব কিছু। ১৫ আগস্টে বুঝেছিলাম, কী ভুল জায়গায় কথা বলেছি আমি। ওদিকে রেজা ভাইয়ের সঙ্গে খন্দকার মোশতাকের ছিল দারুণ খাতির। আর খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে ইত্তেফাকের সম্পর্কও ছিল অত্যন্ত নিবিড়।

..............‘’..............

ফেরার সময় খালেদ ভাই (ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, চিফ অব জেনারেল স্টাফ) আমাকে তাঁর গাড়িতে উঠিয়ে নিলেন। আমি সবিস্তারে আমার আশঙ্কার কথা বললাম। তিনি শুনলেন গভীর মনোযোগের সঙ্গে। তারপর আমাকে আশ্বস্ত করলেন যে ব্যাপারটা তিনি দেখবেন।

..............‘’..............

আমার অজ্ঞাতসারেই আমার রিপোর্টের ওপর কঠোর নজরদারি চলতে থাকল। সেদিকেও আমার কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না। মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছানোর জন্য। কিন্ত বঙ্গবন্ধুর চারপাশ তখন আমার নাগালের অনেক বাইরে। সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের দু’জনকে চিনতাম- একজন ব্রিগেডিয়ার মনজুর এবং অন্যজন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, চিফ অব জেনারেল স্টাফ। যোগাযোগ করলাম খালেদ মোশাররফের সঙ্গে। তিনি আমাকে বললেন তাঁর সঙ্গে কুমিল্লা-বেলোনিয়ায় যেতে। সেখানে তিনি আমার কথা শুনবেন একান্তে। গেলাম কুমিল্লা। সঙ্গে নিলাম বন্ধু ইকবাল সোবহান চৌধুরীকে। সে তখন বাংলাদেশ অবজারভারের রিপোর্টার। ফেরার সময় খালেদ ভাই আমাকে তাঁর গাড়িতে উঠিয়ে নিলেন। আমি সবিস্তারে আমার আশঙ্কার কথা বললাম। তিনি শুনলেন গভীর মনোযোগের সঙ্গে। তারপর আমাকে আশ্বস্ত করলেন যে ব্যাপারটা তিনি দেখবেন। আমি তাঁর কথায় আস্থা রেখেছিলাম বটে, কিন্ত আশ্বস্ত হতে পারিনি। কারণ বারবার কর্নেল ফারুকের সেই কঠিন উচ্চারণ আমাকে শঙ্কিত ও কণ্টকিত করে রেখেছিল।

অবশেষে ঘটেই গেল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। সেদিন যদি আমার ওই রিপোর্টটা প্রকাশিত হতো, তাহলে হয়তো বাংলাদেশের ইতিহাস এত ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ দ্বারা মসিলিপ্ত হতো না। পরে একসময় বন্ধু শাহাদতকে বলেছিলাম পুরো ঘটনাটা লেখার কথা। সে বলেছিল, ‘এখনো সময় আসেনি, বন্ধু। চারদিকে ওদের জাল ওরা বিছিয়ে রেখেছে। আমি একদিন লিখব, তুইও তখন লিখিস।’

শাহাদত পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে, সম্ভবত তার স্মৃতিকথা এত দূর পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায়নি। যে কারণে আমরা কেউ জানতেও পারলাম না শাহাদত কতটুকু জানত কিংবা কতটুকু বুঝেছিল অথবা তার সঙ্গে ওদের কী সম্পর্ক ছিল।

সেদিন বঙ্গবন্ধুর চারপাশে যারা ক্রমান্বয়ে পজিশন নিচ্ছিল এবং যাদের জন্য পাকিয়ে ওঠা ষড়যন্ত্রের কথা বঙ্গবন্ধুর কান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছিল না- এখন শুধু ভাবি, তারা কি সব সময় সব যুগে থাকে সব ক্ষমতাসীনের পাশে?

লেখক ● সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক জাগরণ    

আরও পড়ুন