• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ২৯, ২০১৯, ০৮:০৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৩, ২০১৯, ০৯:১০ পিএম

স্মরণ

বসির প্রিন্সিপালের ত্যাগ আমরা ভুলবো না

বসির প্রিন্সিপালের ত্যাগ আমরা ভুলবো না
বসির উদ্দিন

১৯৬৩ সালে ছাত্র আন্দোলনের সময় রাজশাহীতে জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের গাড়িতে জুতা মেরে ছাত্রত্ব হারান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বসির উদ্দিন। আজ শুক্রবার তার পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৪ সালের আজকের এই দিনে এ দেশের ছাত্র আন্দোলনের পথিকৃৎ বসির উদ্দিন মৃত্যু বরণ করেন।

বসির উদ্দিন ১৯৪১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্র রাজনীতির সাহসী সৈনিক চেহারা আর গ্রামের জোতদার পরিবারের সন্তান হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই ‘সাহেব’ হিসেবে পরিচিতি পান। বসির উদ্দিন ১৯৫৭ সালে বাঘা উপজেলার কালিদাসখালী হাইস্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাস করেন। আইএ পাস করেন নাটোর নবাব সিরাজদৌলা কলেজ থেকে। এনএস কলেজে বিএ পড়ার সময় ১৯৬১-৬২ সালে ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। বিএ পাস করার পরে ১৯৬৩ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে মাস্টার্স এ ভর্তি হন। তখন শরীফ কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে পূর্ববাংলায় ছাত্র আন্দোলন তুঙ্গে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন বসির উদ্দিন। এ সময় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানে আসলে বসির তার গাড়িতে জুতা মারেন এবং এ অপরাধে তাতে আটক করা হয়। প্রাণে বেঁচে গেলেও হারান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব। তার সার্টিফিকেটে লাল দাগ দিয়ে দেয় পাকিস্তান সরকার। এ ঘটনায় তার জীবনে বড় ধরনে ধাক্কা খান বসির উদ্দিন। তারপর আসে স্বাধিকার তথা দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন। সেখানেও তিনি ভূমিকা রাখেন।একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পাবনার পাকশি কলেজে শিক্ষকতা করেন। এ সময় স্বাধীনতার জন্য মক্তিযুদ্ধকালীন দিক-নির্দেশনা এবং এলাকার মানুষদের সংগঠিত করেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর আমলে ৭২ সালে আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখেন। তিনি পুনরায় মাস্টার্স করেন ইংরেজিতে। পরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর ইউসুফ আলী কলেজে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি। পরে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন পঞ্চগড় জেলার রহিয়া ডিগ্রি কলেজে। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে বশির সাহেব অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন রাজশাহী জেলার আড়ানী ডিগ্রি কলেজে। আড়ানী কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সাথে নানান বিষয়ে মতানৈক্যের কারণে কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মামলায় জর্জরিত হন। ৮৪ সালে তাকে কলেজ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে বেতনভাতা বন্ধ করে দেয়া হয়। মনের দিক থেকে একেবারে ভেঙ্গে পড়েন এই শিক্ষানুরাগী। ফিরে যান পৈত্রিক ভিটা রঘুনাথপুরে। নিদারুন কষ্টে দিন কাটে বসির প্রিন্সিপালের। বেকার জীবনে কষ্ট করে জীবন-সংসার চালান তিনি। তবে  মামলার কারণে তার স্বাভাবিক জীবন অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। পরে আদালত থেকে তার পক্ষে রায় দেন। মামলায় ডিক্রি লাভের পরও তিনি কলেজে যোগদান করতে পারেননি। ততদিনে চলে গেছে পৈত্রিক সম্পত্তিসহ অনেকগুলো বছর। বকেয়া বেতন-ভাতার জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষসহ সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলা এখনও চলমান।

দ্বিতীয় স্ত্রী ও ৬ ছেলে নিয়ে জীবন সায়হ্নে এসে এই শিক্ষাবিদ সংসার চালাতে ১৯৯১ সালে নাটোর জামহুরিয়া আলীয়া মাদ্রাসায় ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে সামান্য বেতনে চাকরিতে যোগ দেন। জামহুরিয়া মাদ্রাসায় ১০ বছর চাকুরি করে অবসর নেন ২০০১ সালে। স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে জীবনের শেষ দিকে এসে নিদারুন কষ্টে দিন কাটে তার জীবন। অর্থাভাবে তিনি সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারেননি। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের লড়াকু সৈনিক, ছাত্র আন্দোলনের পথিকৃত, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মনের কাছে পরাজিত হয়ে নিভূতচারী হয়ে সংসারের বোঝা মাথায় নিয়ে সাংসারিক অনটনে জীবনকে টেনে নিয়ে আসেন ২০১৪ সালের ২৯ মার্চ পর্যন্ত। রঘুনাপুরে পৈত্রিক ভিটায় চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন তিনি।

অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদী কণ্ঠ এক সময়ের তুখোড় এবং ত্যাগী ছাত্রনেতা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, শিক্ষানুরাগী বসির সাহেব আমাদের কাছে মূল্যায়ন পাননি। নিভূত পল্লী থেকে উঠে আসা এমন শিক্ষাপ্রেমী ছাত্র নেতৃত্ব এবং সংগঠক আমাদের জন্য একটি অনুপম দৃষ্টান্ত। দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এই সাহেবকে নতুন প্রজন্ম স্মরণে রাখবে চিরদিন। তার মৃত্যু দিবসে এই আমাদের প্রত্যাশা। তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। আমার অনুরোধ আমরা যেন বসির প্রিন্সিপালের ত্যাগের কথা ভুলে না যাই।

লেখক : সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা, শ্রম মন্ত্রণালয়