• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৯, ০৮:২০ এএম

পাহাড়ে জুম চাষ 

জ্বলছে পাহাড়, হারিয়ে যাচ্ছে বন্য প্রাণী

জ্বলছে পাহাড়, হারিয়ে যাচ্ছে বন্য প্রাণী
এভাবেই জ্বলছে পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়

 

দাউ দাউ করে জলছে পার্বত্যাঞ্চলের শত শত একর পাহাড় পর্বত। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে নানা প্রজাতির গাছপালা, লতা-পাতাসহ ঔষধি গাছ। বছরের পর বছর জুম চাষের নামে জুমিয়াদের এ ধ্বংসলীলা চলছে। ফলে হারাচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য, বিলুপ্ত হচ্ছে বন্যপ্রানী, পাখি ও কীট-পতঙ্গ। ঘটছে পরিবেশ বিপর্যয়, যার দায়ভার বহন করতে হচ্ছে পাহাড়ে বসবাসরত লক্ষ লক্ষ মানুষকে।

ক্ষতিকারক জুম চাষ থেকে জুমিয়াদেরকে আধুনিক জুম চাষে (স্থায়ীত্বশীল পাহাড় চাষ) উদ্বুদ্ধ করা গেলে এ পরিস্থিতির উত্তরণ করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সচেতন মহল। এজন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। 

পার্বত্য চট্টগ্রামের জুমিয়া চাষিদের হিসাব মতে ফাল্গুন চৈত্রের শুরুতেই পাহাড় ও পাহাড়ের ঢাল জুম চাষের উপযোগী করে তোলার উপযুক্ত সময়। এ সময় জুম চাষিরা পাহাড়ের অনাবাদী লক্ষ লক্ষ একর বনাঞ্চলের ছোট বড় বিভিন্ন জাতের গাছ-পালা কেটে জুম চাষের উপযোগী করে তোলে। আর এসব কাটা গাছ পালায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে, পাহাড়কে ন্যাড়া করে ফেলে। জুম চাষের প্রভাবে দিন দিন পরিবেশ হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে কয়েক বছর যাবৎ খাগড়াছড়ির পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা জন সচেতনতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানকে জুম চাষ প্রতিরোধে ইতোপূর্বে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।


 
মূলত কর্মসংস্থান ও জন সচেতনতার অভাবে জুমিয়া পরিবারগুলো প্রতি বছর জুম চাষের জন্য পাহাড়ের পর পাহাড় আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। এক মুহূর্তের লাগিয়ে দেয়া আগুন দিনের পর দিন জ্বলতে থাকে। ফলে এক পাহাড়ের আগুনে আশে-পাশের পাহাড়গুলোও পুড়ে সবুজহীন ন্যাড়া পাহাড়ে পরিণত হয়ে যায়। সেখানে বসবাসরত পশু-পাখি কীট-পতঙ্গরা তাদের আবাস্থল হারিয়ে ফেলে। আগুনের ধোঁয়ায় শহর এলাকাসহ প্রার্বত্যাঞ্চলে নেমে আসে অন্ধকার। পাহাড় পোড়া ছাইয়ে ছেয়ে যায় পুরো পার্বত্যাঞ্চল। জুম চাষের কারণে পাহাড়ের লতা-পাতা ঔষধি বৃক্ষ যেমন ধ্বংস হচ্ছে সেই সঙ্গে পাহাড় ধ্বংস বেড়েই চলেছে।

যে পাহাড়ে একবার জুম চাষ করা হয়, সেই পাহাড়ে সাধারণত ৪/৫ বছরের মধ্যে কোন প্রকার গাছ পালা জন্মায় না। যে কারণে জুমিয়া পরিবারগুলো এক পাহাড়ে ২বার জুম চাষ করেনা। পরবর্তী বছর তারা অন্য পাহাড়ে গিয়ে জুম চাষ করে। এভাবেই বছরের পর বছর হাজার হাজার পাহাড়ের লক্ষ লক্ষ একর ভূমির উর্বরতা নষ্ট ও প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে। জুমিয়া পরিবারগুলো এ চাষের মাধ্যমে কিছুটা লাভবান হচ্ছে ভাবলেও প্রকৃত পক্ষে ক্ষতির পরিমাণ অনেক গুণ বেশি। এক সময় পার্বত্যাঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা শুধুমাত্র জুম চাষের উপর নির্ভরশীল ছিল। তখন লবন ছাড়া তাদের আর কিছুই কিনতে হতো না। বস্ত্র তৈরীর কাঁচামালসহ জুমে উৎপাদিত ফসল ধান, শাক-সাবজি, ফল-মূল, সুতা ও তিল ইত্যাদি তাদের কাছে পাওয়া যেত। সময়ের ব্যবধানে ভূমির উর্বরতা হ্রাস পাওয়ায় জুমে এখন তেমন ফলন পাওয়া যাচ্ছেনা। তবুও আদি পেশা হিসাবে জুমিয়া পরিবারগুলো জুম চাষকে আকঁড়ে ধরে রেখেছে। 

সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সুনির্দিষ্ট কোন উদ্যোগ না থাকায় জুমিয়া পরিবারগুলোর ভাগ্যের পরিবর্তন যেমন হচ্ছেনা। একই সঙ্গে প্রতি বছর জুমিয়াদের কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছেনা লক্ষ লক্ষ একরের গাছ-পাল ও পশু-পাখিসহ প্রাকৃতিক সম্পদের ভরপুর পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় পর্বত।


 
সনাতন পদ্ধতিতে ক্ষতিকর এই জুম চাষের পরিবর্তে জুমিয়া পরিবারগুলোকে আত্মনির্ভরশীল করতে স্থানীয় এনজিও ‘জাবারাং কল্যান সমিতি’ ১৯৯৭ সালে জুম চাষের বিকল্প হিসাবে স্থায়ীত্বশীল পাহাড় চাষ নামে একটি পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া গাছ-পালা ও লতা-পাতা বলবৎ রেখে পাহাড়ে পরিকল্পিত বনায়ন ও চাষাবাদ সৃষ্টি করা। এ প্রকল্প এলাকাবাসীর মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়লেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় তা আর এগুতে পারেনি।
 
পরিবেশ রক্ষায় পার্বত্যাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠির জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান ও পরিবেশ সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মাঠ পর্যায়ে জুম চাষিদের পরিবেশের লাভ-ক্ষতি সম্পর্কে অবহিত করতে সরকার স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বার, হেডম্যান, শিক্ষক, এনজিও কর্মী ও উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে উদ্যোগ নিলে সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি জাতীয় ও জেলা পর্যায়ে সরকারি উদ্যোগে উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড ও পাড়া পর্যায়ে পরিবেশ রক্ষায় উদ্বুদ্ধকরণ সভা সেমিনারের আয়োজন করলেও সুফল পাওয়া যেতে পারে। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো জুম চাষ মৌসুমের শুরুতে চাষিদের পরিবেশ সচেতনতামূলক সভা সেমিনার ও বিকল্প চাষাবাদের ব্যবস্থা নিলে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে পার্বত্যাঞ্চলের পরিবেশ।  

এ বিষয়ে মাটিরাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, মো.শাহ আলম জানান, জুম চাষের ফলে পাহাড়ের উর্বরতা শক্তি কমে যায়, ভূমি ক্ষয় হয় এবং পরিবেশ বিপর্যয় ঘটে। সরকার এরইমধ্যে জুম চাষকে নিরুৎসাহিত করার লক্ষে জুমিয়াদের মাঝে বিনামূল্যে উচ্চফলনশীল ধানবীজ, সার বিতরণ করছে এবং প্রশিক্ষণ ও সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জুম চাষের অপকারিতা তুলে ধরে জুমিয়াদের সচেতন করছে।  

এএস