• ঢাকা
  • রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ৩১, ২০১৯, ০৮:৫৪ এএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ৩১, ২০১৯, ০২:৫৯ পিএম

ডাক্তার ও জনবল সংকট

সমস্যায় ধুঁকছে বোয়ালমারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

সমস্যায় ধুঁকছে বোয়ালমারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তারের অপেক্ষায় রোগীরা- ছবি: জাগরণ


 

তখন সকাল সাড়ে দশটা। হাসপাতাল গেটে যেতেই ছুটে আসে পৌর সদরের ছোলনা গ্রামের মো. কামরুল ইসলাম (৪০)। তিনি বললেন, ভাই হাসপাতাল নিয়ে একটু লেখেন। হাসপাতালে ডাক্তার পাওয়া যায় না। ওষুধ মেলেনা। ভিতরে ঢোকা যায় না ময়লা আর নোংরা গন্ধে। বললেন সেই সকালে আমার অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে এসেছি কিন্তু হাসপাতালে কোন ডাক্তার নেই। টিকিট (যার সিরিয়িাল নং ৩২৬২৫) কেটে বসে আছি। আমার রোগীর কিছু হয়ে গেলে তার দায়িত্ব কে নিবে? কথা বলতে বলতে আরও লোকজন জড়ো হয়ে যায়।

শিবপুর গ্রামের মো. হাফিজুর রহমান অভিযোগ করে বলেন হাসপাতালে টাকা ছাড়া কোন কাজ হয়না। জরুরি বিভাগে টাকা লাগে।

হাসপাতালের একজন স্টাফ নাম প্রকাশ না করে বললেন, জরুরি বিভাগে কোন লোক নেই। অন্য বিভাগের লোক দিয়ে কাজ চালানো হয়। যে তিনজন কাজ করে তাদের বিরুদ্ধে নানা ছলে টাকা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।

৫০ উর্ধে এক মহিলার নিকট জানতে চাইলে বলেন, আমি প্রেসক্রিপশন ধরে দেই। মানে কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটা ক্লিনিকে মাসিক বেতনে কাজ করি। এখান থেকে রোগী পাঠাই ওই ক্লিনিকে। নাম না বলে জানালেন বাড়ি ছোলনা। এরকম দালালচক্র কাজ করে হাসপাতাল ঘিরে।

হাসপাতালে ঢুকে দেখা যায় ডাক্তারদের বাসার চেম্বারের সামনে ভিড়। ওই ডাক্তাররা তখনও বাসায় রোগী দেখছেন। আর হাসপাতালের চেম্বারের সামনে রোগীরা লাইন ধরে দাড়িয়ে আছে ডাক্তারের আশায়। জানা গেল জরুরি বিভাগে শুধু ডা. মোহাম্ম মারনুশ আছেন। বাকিদের কেউ নেই। লাইনে দাঁড়ানো কয়েক রোগী জানান টিকিট কেটে তারা দাঁড়িয়ে আছে। টিকিটের দাম ৩টাকা হলেও ভাংতি না থাকার কথা বলে ৫টাকা করে নেন টিকিট ক্লার্কের দায়িত্বে থাকা রানা।
গেটে আসতেই ইস্টার্ন ডায়াগনেস্টিক সেন্টারের জিল্লু অভিযোগ করে বলেন, হাসপাতাল ছেড়ে ডাক্তাররা বাইরে গিয়ে দোকানে বসে চা খান আর আড্ডা দেন। এক শ্রেণির দালাল আর মেডিকেল  রিপ্রেজেন্টেটিভরা তাদের সঙ্গ দেন।

হাসপাতাল গেটের নোবেল ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে আসা রহিমা বেগম (৫৫) বলেন, ডাক্তার মুখে শুনেই ওষুধ লেখে দেয়। ভাল করে দেখে না। হাসপাতালের ওষুধও দেয়না।

নোবেল ফার্মেসির মালিক নন্দ দুলাল সমাদ্দার বলেন, রোগীর চাপ খুব বেশি। সে তুলনায় ডাক্তারের সংখ্যা খুবই কম। হাসপাতালে খাবার পানির সমস্যা রয়েছে। একটি মাত্র টিউবওয়েল রয়েছে হাসপাতাল কমপ্লেক্সে সীমানার মধ্যে। এরকম নানা সমস্যায় ধুঁকছে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সাথে ৫টি সাব সেন্টার আর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোর অবস্থাও তথবৈচ। এজন্য প্রচন্ড রকম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছে উপজেলার ৩ লাখ মানুষ।

স্বাধীনতার পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালটি ২০০৬ সালে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। বর্তমানে একশ শয্যায় উন্নয়নের কাজ চলছে।

হাসপাতাল অফিস সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালে ২১ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও ১৪টি পদই শূন্য। একজন ডেপুটেশনে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ কর্মরত আছেন মোট ৬ জন। জুনিয়র কনসালটেন্ট সার্জারি শূন্য। জুনিয়র কনসালটেন্ট কার্ডিও ডেপুটেশনে কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে। এছাড়াও শূন্য অবস্থায় আছে, জুনিয়র কনসালটেন্ট চর্ম ও যৌন, জুনিয়র কনসালটেন্ট মেডিসিন, জুনিয়র কনসালটেন্ট অর্থো, জুনিয়র কনসালটেন্ট চক্ষু, জুনিয়র কনসালটেন্ট ইএনটি, জুনিয়র কনসালটেন্ট এ্যানেসথেসিয়া, মেডিকেল অফিসার ৩টির মধ্যে ২টি, আইএমও, ইএমও, এ্যানেসথেসিস্ট, ডেন্টাল সার্জন এবং সহকারী সার্জনের পদ। দ্বিতীয় শ্রেণির সেবিকাদের ১৭টি পদের সবাই কর্মরত আছে। তৃতীয় শ্রেণির মঞ্জুরীকৃত ৯৪ পদের মধ্যে ৫০জন কর্মরত থাকলেও প্রধান সহকারী, প্রধান সহকারী কাম একাউনটেন্ট, ক্যাশিয়ার, পরিসংখ্যানবিদ, স্টোর কিপারসহ ৪৪টি পদ শূণ্য। চতুর্থ শ্রেণির ২৪টি পদের ১৫টিই শূণ্য। ৫টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মধ্যে খরসূতির মেডিকেল অফিসার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এবং রূপাপাতের মেডিকেল অফিসার মুগদা মেডিকের কলেজে ডেপুটেশনে, বঙ্গেশ্বর্দী ও কাদিরদী শূন্য। শুধুমাত্র খামারপাড়ার মেডিকেল অফিসার কর্মরত আছে। ৬টি ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ৬টি সহকারী সার্জনের পদ শূন্য রয়েছে।

সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় প্রসূতি মায়েদের। গাইনি সার্জন ও এ্যানেসথিয়া সার্জন না থাকায় একটি আধুনিক অপারেশন থিয়েটার দীর্ঘ দিন বন্ধ রয়েছে। প্রসূতিদের যেতে হচ্ছে স্থানীয় বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিকে। সেখানে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেও পাওয়া যাচ্ছে না প্রকৃত স্বাস্থ্য সেবা। মাঝে মধ্যে ঘটছে জীবন নাশের ঘটনা। ২০০৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ৯ লাখ টাকা মূল্যের একটি আধুনিক এক্সরে মেশিন পায় হাসপাতাল যা ২০০৭ সালে জুলাই মাসের ১০ তারিখে স্থাপন করা হয়। কিন্ত ওই পর্যন্তই। আজ অবধি তা তালামারা কক্ষেই বন্দি হয়ে আছে। বদ্ধ রুমে এতদিনে তা হয়তো মরিচা ধরে অকেজো হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত মূল্যে রোগীদের এক্সরে করতে হচ্ছে বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে। প্যাথলজি ও প্যাথলজিস্ট থাকলেও ডাক্তাররা রোগীদের টেস্ট করতে পাঠিয়ে দেন পছন্দের প্যাথলজি সেন্টারগুলোতে। জরুরি বিভাগের কর্মচারী না থাকায় মালি (ভেষজ) বদরুল ও শাহজাহান, পিয়ন বাবলা, ওটিবয় আফসার জরুরি বিভাগে কাজ করে।
 
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তাপস বিশ্বাস দৈনিক জাগরণকে বলেন, প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসক ও জনবল খুবই কম। অপরদিকে রোগীদের চাপ অনেক বেশি। ৫০ শয্যার হাসাপাতাল কিন্তু গড়ে ৮০ থেকে ১০০ রোগী ভর্তি থাকে প্রতিদিন। বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৪০০ রোগী দেখা হয়। জরুরি বিভাগে টাকা নেয়ার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন আগে ছিল কিন্তু বর্তমানে এ অভিযোগ নেই। তারপরও তিনি দেখবেন। সকাল ৮টা থেকে ২ টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত ডাক্তারদের হাসপাতালে থাকার কথা। ২/১ জন ডাক্তারের রোগী বেশি। বিশেষ করে শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. গিয়াস উদ্দিনের রোগী বেশি। এলাকার অনেকেই প্রাইভেটভাবে দেখাতে চায়। তাই তাদের একটু বিলম্ব হতে পারে। তাছাড়া সকালে এসে ডাক্তাররা রাউন্ডে যায়। শুধু বোয়ালমারী নয়, পাশের আলফাডাঙ্গা, কাশিয়ানী, সালথা উপজেলা থেকেও রোগী আসে এ হাসপাতালে।

তিনি বলেন, চিকিৎসক ও জনবল সংকটের কারণে যে পর্যায়ের সেবা রোগীরা প্রত্যাশা করে সেই পর্যায়ের সেবা হয়তো দিতে পারিনা। তবে সিমিত জনবল নিয়ে রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। যারা আছেন তারা সবাই আন্তরিক। দালালচক্র যতদূর সম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখা হয় আর মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভদের অফিস আওয়ারে হাসপাতালে ঢোকা নিষেধ।


কেএমআরএস/টিএফ