• ঢাকা
  • শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ১, ২০১৯, ০৪:০০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ১, ২০১৯, ১০:০৩ পিএম

মে দিবস 

শত বছরের বৈষম্য ও বঞ্চনা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে চা শ্রমিকদের

শত বছরের বৈষম্য ও বঞ্চনা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে চা শ্রমিকদের
পরাধীনতার গ্লানি কাটিয়ে দেশ স্বাধীন হলেও আজও অধিকার বঞ্চিত ও পরাধীন চা শ্রমিকরা -ছবি : জাগরণ

ঊনবিংশ শতাব্দীতে শোষণ, শাসন, অত্যাচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে পুরো ভারত উপমহাদেশের পণ্ডিতগণ সোচ্চার ছিল। ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশ আমলের ২শ বছরের দাসত্ব থেকে ভারত উপমহাদেশ ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হয়েছিল। আর বৈষম্য দূরীকরণ, গণতন্ত্র, বাক-স্বাধীনতা রক্ষায়, অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসার দাবিতে ফুঁসে উঠা বাঙালি জাতিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি পাকিস্তান। ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক একটি দেশের স্বাধীন পতাকা বিশ্ব মানচিত্রে আজও শোভা পাচ্ছে।

অসভ্যতার গ্লানি কাটিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এই দেশের চা শ্রমিকরা আজও পরাধীন। দেশের নাগরিক হিসেবে সকলের সম অধিকারের কথা থাকলেও তারা পদে পদে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। এ যেন স্বাধীন দেশে পরাধীন নাগরিক। শত বছর বাস করেও এরা ভূমির মালকানার অধিকার থেকে বঞ্চিত। ২শ ২২ বর্গফুটের একটি কুঁড়েঘরে তাদের বসবাস। বংশ পরম্পরায় এ ঘরেই তাদের জীবন, যৌবন, জন্ম, মৃত্যুর প্রহর গুনতে হয়।

ঝড়ে ঘরের ঢেউটিন উড়ে গেলে মালিকের অনুমতি ছাড়া মেরামত করা যাবে না। বয়সের ভারে ন্যুব্জ শ্রমিকরা অসহায়ত্ব আর উপোসে মৃত্যুর প্রহর গুণে। প্রসূতি মায়েরা চিকিৎসার অভাবে, অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত অবস্থায় সন্তান জন্ম দেন। ওই কুঁড়ে ঘরটিই তাদের সন্তান প্রসবের উত্তম স্থান, হাসপাতালের বেড তাদের জন্য সোনার হরিণ।

প্রায় ২শ বছর ধরে মৌলভীবাজারের ৯২টি চা বাগানে বংশ পরম্পরায় কাজ করছেন চা শ্রমিকরা। তাদের শ্রমে এই শিল্পের উন্নয়ন হলেও শ্রমিকদের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না। মধ্যযুগের ভূমিদাসের মতোই যেন চা মালিকের বাগানের সঙ্গে তার নিয়তি বাঁধা।

সকালে লবণ দিয়ে এক মগ চা আর সঙ্গে দু’মুঠো চাল ভাজা খেয়ে বাগানে যেতে হয়। তার পরিশ্রমে উৎপাদিত চা, দুধ-চিনি দিয়ে খাওয়ার সামর্থ্যটুকুও নেই তার। সারাদিন দু’পায়ে দাঁড়িয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে কঠোর পরিশ্রম করতে হয় তাকে। দুপুরে কোনো এক ফাঁকে মরিচ আর চা পাতার চাটনি, সঙ্গে মাঝে মাঝে মুড়ি কিংবা চানাচুর খেয়ে দিনটা কেটে যায়। হাড়ভাঙা শ্রম শেষে বিকালে ঘরে এসে বাচ্চাদের নিয়ে চিড়া-গুড় খেয়ে সময় পার। আর রাতটা কাটে কোনরকমে ডাল-ভাত খেয়ে।

দৈনিক মজুরি বা হাজিরা ৮৫ টাকা ছিল যা গত বছর বেড়ে ১০২ টাকা করা হয়েছে। যারা পাতা তোলেন, ২৩ কেজি পাতা তুললেই কেবল দিনের নিরিখ পূরণ হয়, হাজিরা হিসেবে গণ্য হয়। দিনে অন্তত ২৫০টি গাছ ছাঁটতে হয়। এক একর জমিতে কীটনাশক ছিঁটালে তবে নিরিখ পূরণ হবে। সপ্তাহ শেষে তিন কেজি খাওয়ার অনুপযোগী আটা ভাগ্যে জুটে তাও আবার ওজনে কম। এই হচ্ছে দেশের ১৬৫টি চা বাগানের শ্রমিকদের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব চিত্র।

চা গাছ ছেঁটে ছেঁটে ২৬ ইঞ্চির বেশি বাড়তে দেয়া হয় না। চা শ্রমিকদের জীবনটাও যেন চা গাছের মতো একটা নির্দিষ্ট সীমারেখায় বন্দি। কোনভাবেই যেন তার মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে সেভাবেই যেন নিয়মরীতি গড়ে তোলা হয়েছে। ক্ষোভে-দুঃখে এমনটাই দাবি করছেন মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল চা শ্রমিক চুরামন দাস, আগনু দাস।

তারা বলেন, সেই পাকিস্তান আমলে এই বাগানে ৫শ শ্রমিকের তালিকা ছিল। তখন জনসংখ্যা ছিল ৬শ। আর ২০১৯ সালে শ্রমিকের তালিকায় সেই ৫শ জনই রয়ে গেছে যদিও বর্তমানে ভোটার সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। এই বৈষমের শেষ কোথায়?

মৌলিক চাহিদা পূরণে দীর্ঘদিন ধরে মজুরি বৃদ্ধি, ভূমি অধিকার, বাসস্থান ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বিভিন্ন দাবি তাদের। কিন্তু বাস্তবায়ন না হওয়ায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন চা শ্রমিক পরিবারের সদস্যরা। চা বাগানের শ্রমিকরা তাদের শ্রম দিয়ে চা বাগান আগলে রাখলেও তাদের শিক্ষা ও চিকিৎসা এখন সেই অবহেলিত রয়ে গেছে।

সরকার তাদের আবাসস্থল নিজ নিজ মালিকানায় করে দেবে বললেও এখনও এর কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। আর এজন্য দীর্ঘদিন ধরে ভূমি নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছেন চা শ্রমিকরা।

চা শ্রমিকরা জানান, বাগানের হাসপাতালে ভালো চিকিৎসার অভাব। যা কিছু অসুখই হোক না কেন চিকিৎসকরা প্যারাসিটামল দেন রোগ সারাবার জন্য। প্রসূতি মায়েদের জন্য নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা। এনজিও সংস্থার ওপর নির্ভরশীল হলেও অনেক বাগানে এনজিও কর্মীরা যাচ্ছে না। শিশুরা অপুষ্টিজনিত রোগে প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে। তাছাড়া বাগানের অনেক ছেলে-মেয়েরা তাদের নিজেদের অদম্য চেষ্টায় লেখাপড়া করেও ভালো চাকরি পাচ্ছে না। বৈষম্যতার গ্যাঁড়াকলে তারা প্রতিনিয়ত হোঁচট খাচ্ছে।

কুলাউড়ার কালিটি চা বাগানের মহিলা চা শ্রমিক মিনা পাশী, জগদিশ কৈরি, শ্রীকান্ত দাস, সঞ্জিত কৈরী, দয়াল অলমিক, রাজন দাস, নারায়ণ দাস  বলেন, প্রতি বছর চা বাগানের অনেক মানুষ নিয়ে আমরা মে দিবস পালন করছি। আমাদের দুঃখ-দুর্দশা সবার কাছে তোলে ধরি। কিন্তু আমাদের এই আন্দোলন, আমাদের মুখের ভাষা কেউ শোনেনা, শুনতে চায়না। শতাব্দী পার হয়ে গেলেও শ্রমিকের ন্যায্য অধিকারের জন্য এখনও আমাদের আন্দোলন করতে হচ্ছে। মে দিবসে সবাই সমবেদনা আর অধিকারের প্রশ্নে আপস দেখালেও কিছুক্ষণ পরেই আবারও তারা পূর্বের ন্যায় আচরণ করছে। এ যেন নতুন বোতলে পুরনো মদ।

কুলাউড়ার বরমচাল চা বাগানের চুরামন দাস বলেন, চা শ্রমিকরা সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এ দেশে বাস করছে। তারা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল। সেই চা শ্রমিকরা আজও অবহেলিত, নির্যাতিত। বর্তমান শ্রমিকবান্ধব সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে দাবি জানাচ্ছি- এই অবহেলিত চা শ্রমিকদের বাসস্থানের জায়গাটুকু যাতে তাদের নিজের নামে করে দেয়া হয়। যাতে বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের যখন তখন ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতে না পারে।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রাম ভজন কৈরী জানান, চা শ্রমিকদের ২০ দফা দাবি মালিকপক্ষকে লিখিত দেয়ার পর কয়েক দফা দ্বি-পক্ষীয় আলোচনা হয়েছে। তবে মালিকপক্ষের কালক্ষেপনের কারণে দাবিগুলো হেলায় পড়ে আছে। বিষয়গুলোর সমাধান করতে হলে মালিকপক্ষের আন্তরিকতার প্রয়োজন। অন্যতায় তা বাস্তবায়ন সম্ভব না। উনাদের হাত অনেক লম্বা, তাই শ্রমিকদের উপর উনারা প্রভাব বিস্তার করে আছেন। আমাদের ন্যায্য দাবি, মজুরি ও বোনাসের ব্যাপারেও যদি মালিকপক্ষ সমাধান করতেন তবে শ্রমিকরা কিছুটা শান্তনা পেতো।

চা শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম একটি বৃহৎ শিল্প। জাতীয় অর্থনীতিতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এদেশের চা পৃথিবীর ২৫টি দেশে রফতানি করা হয়। আর এই চা উৎপাদনের সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত চা-শ্রমিকরা। কিন্তু চা-শ্রমিকরা সকল নাগরিক সুবিধা ভোগের অধিকার সমভাবে প্রাপ্য হলেও তারা পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্যের শিকার বলে প্রতিয়মান।

যাদের শ্রমে অর্জিত হচ্ছে হাজার কোটি বৈদেশিক মুদ্রা, তাদের অবহেলিত না রেখে অধিকার বাস্তবায়ন করা হোক এমনটাই প্রত্যাশা চা শ্রমিক নেতাদের। চা শ্রমিকদের প্রতি সদয় আচরণ ও ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হওয়া পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, সকলের দায়িত্ব।

একেএস