• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ২১, ২০১৯, ০৮:৩৪ এএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ২১, ২০১৯, ০৮:৩৫ এএম

ঈদকে ঘিরে ব্যস্ত রংপুরের টুপি কারিগররা

ঈদকে ঘিরে ব্যস্ত রংপুরের টুপি কারিগররা
রংপুরের কাউনিয়া গ্রামের নারীদের সুনিপুন হাতের তৈরি টুপি- ছবি: জাগরণ

আসছে ঈদ। আর এ ঈদকে ঘিরে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার টুপি গ্রামের কারিগররা ব্যস্ত সময় পার করছেন। এখানকার প্রত্যন্ত গ্রামের প্রত্যেকটি পরিবার যেন এখন এক একটি টুপির কারখানা। গ্রামীণ নারীদের সুনিপুণ হাতের তৈরি এসব টুপি দেশের সীমানা পেড়িয়ে এখন সৌদি, ওমান, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বিক্রি হচ্ছে। গোটা এলাকায় এমন একটি পরিবার পাওয়া যাবে না, যাদের কেউ টুপি তৈরির কাজে যুক্ত নেই। 

এই টুপি থেকে প্রতি মাসে অন্তত ৫০ লাখ টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আসছে দেশে। ঈদের আগে এর পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। তাই এখানকার নারীরা বেকার না বসে থেকে ঘরে ঘরে টুপি বানিয়ে দ্রুত তাদের ভাগ্য পাল্টে ফেলছে। মাত্র কয়েক বছর আগেও যে নারীদের ঘরে চাল-চুলো ছিল না, টেলিভিশন কিংবা বিনোদন যাদের কাছে স্বপ্নের মত ছিল। আজ তাদের ঘরে ঘরে টেলিভিশন হয়েছে।

শুধু তাই নয়, অনেকেই এখন প্রতিমাসে ব্যাংকে সঞ্চয়ও করছেন। শিল্প উদ্যোক্তারা মনে করছেন, সঠিক উদ্যোগ এবং পৃষ্ঠপোষকতা পেলে রংপুরের এই টুপি পল্লীই দেশের জন্য বয়ে আনতে পারে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা, হতে পারে বহু গ্রামীণ নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও। 

রংপুরের কাউনিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামের নারীরা অতি মনোযোগ দিয়ে ব্যস্ত টুপি তৈরির কাজে- ছবি: জাগরণ

যেভাবে যাত্রা শুরু

তখন ২০০২ সালে জেলার একটি অভাবি উপজেলার নাম ছিল কাউনিয়া। তিস্তা বিধৌত এখানকার মানুষের অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। পরিবারে অশান্তি লেগেই থাকতো। তেমনি একটি পরিবার ছিল শহীদবাগ ইউনিয়নের খোর্দ্দ ভুতছাড়া গ্রামের ফরিদ উদ্দিন ও শাহিদা বেগমের পরিবার। ফরিদ স্থানীয় এক স্কুলের দফতরি। স্ত্রী দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে তাদের সংসার। এক সময় শাহিদা বাড়ির একটা খড়ের ঘরে ব্র্যাকের সহায়তায় স্কুল গড়ে তোলেন। ওই স্কুলে আসা-যাওয়া করতো আসাদ নামের এক ছেলে। আসাদ শাহিদাকে দাদি বলে ডাকতো। সেই সুবাদে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। শাহিদা গৃহস্থালীর কাজের পাশাপাশি বালিশের কভার, হাত পাখা ইত্যাদিতে সুঁই সুতা দিয়ে নকশার কাজ করতেন। আর আসাদ পাশে বসে সেসব দেখতো। এক সময় আসাদ ঢাকা চলে যায় এবং একটি তৈরি পোশাকের কারখানায় চাকরি নেয়।
 
একদিন সেখানকার এক কর্মকতা আসাদের কাছে জানতে চান তার বাড়ির এলাকায় এসব টুপি বা হাতের কাজ করে এমন মহিলা আছে কী না ? আসাদ তাৎক্ষণিক তার দাদি শাহিদাসহ অন্য নারীদের কথা তুলে ধরে। সে সূত্র ধরেই ওই কর্মকর্তা আসাদকে নিয়ে কাউনিয়ার গ্রামে আসেন এবং টুপির কাজ নিয়ে শাহিদার সঙ্গে কথা বলেন। শাহিদার কথায় সন্তুষ্ট হয়ে গামেন্টেসের ওই কর্মকর্তা পরীক্ষামূলকভাবে শাহিদার হাতে কিছু টুপি তৈরির কাজ দিয়ে যান। সেটিই ছিল শাহিদার জীবনে প্রথম টুপি তৈরির কাজ। শাহিদা তখন তার স্কুল পড়ুয়া দুই মেয়ে এবং ননদ মিলে কিছু টুপি তৈরি করে ঢাকায় পাঠালে সংশ্লিষ্টরা তা দেখে সন্তুষ্ট হন। তখন একেকটি টুপির পারিশ্রমিক হিসেবে শাহিদা পেতেন ২২০ টাকা। সে থেকেই শাহিদার টুপি তৈরির যাত্রা শুরু। পরে ক্রমেই বাড়তে থাকে টুপির পরিমাণ। শাহিদাও গৃহস্থালীর কাজের পাশাপাশি মেয়েদের পড়াশোনার ফাঁকে তাদের নিয়ে এবং আগ্রহীদের অন্যান্যদের সঙ্গে নিয়ে কাজ শুরু করেন। এভাবে খুব অল্প সময়েই শাহিদার খোর্দ্দ ভুতছাড়াসহ আশপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে টুপি ও শাহিদার উত্থান কাহিনী। গ্রামের মানুষের মুখে ছড়িয়ে পড়ে সাহিদার নাম। 

পরবর্তীতে এভাবেই ভুতছাড়া, পার্শ্ববর্তী বল্লভবিষু, শিবু, রামচণ্ডীপুর, শাহবাজ, বেটুবাড়ি, পূর্বচাঁদঘাট, পশ্চিমচাঁদঘাট, বখসি পাড়াসহ এখন গোটা কাউনিয়া উপজেলাই পরিণত হয়েছে টুপির কারাখানায়। গ্রাম্য নারীরা কমবেশি সকলেই এখন তাদের গৃহস্থালীর কাজের পাশপাশি ঘরে বসে তৈরি টুপি করছেন।
 
শাহিদার কথা

রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়কে কাউনিয়ার বেইলি ব্রিজ পার হতেই হাতের বাম দিকে নেমে গেছে মাটির এক সরু পথ। আঁকা-বাঁকা সে পথ পেরিয়েই যেতে হয় শাহিদার খোর্দ্দ ভুতছাড়া গ্রামে। বাসায় ঢুকেই দেখা গেল বাড়ির আঙ্গিনায় তৈরী করে রাখা টুপিগুলো গোছানোর কাজে ব্যস্ত শাহিদা। তিনি জানালেন, তার জীবন যুদ্ধ আর ভাগ্য পরিবর্তনের কাহিনী। 

১৯৮৭ সালে বিয়ে হয় ফরিদ উদ্দিন মণ্ডলের সঙ্গে। স্বামী তখন সামান্য এক দিনমজুর। ফরিদের বাসায় থাকার উপযোগী একটি ঘরও ছিল না। ছনের একটি ভাঙ্গা ঘর, মাথার উপর টিন ছিল না। বৃষ্টি এলে পলিথিন জড়িয়ে কোন রকমে দুই মেয়েকে নিয়ে থাকতে হতো।

অকপটেই বললেন, ভাত খাবার পারি নাই, চালের বদলে অন্যের বাড়ি থাকি খুঁদ আনি তা খায়া ছেলে মেয়ে নিয়া বাঁচছি। কষ্ট হয় মেয়ে যখন বৃত্তি পরীক্ষা দিতে যায়, তখন মানুষের বাড়ি থাকি ভাত আনি খাওয়াইছি’। অনেকটা গর্ব করে বললেন, এই গ্রামে এখন তার ৪৫ হাত লম্বা টিনের ঘর রয়েছে, ১১ হাত রান্নাঘর আর কালার টিভি, স্টিল আলমিরা, শোকেজ, ভিসিপি সবকিছুই আছে তার। তিন ছেলে মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে ফরিদা পারভীনকে বিয়ে দিয়েছেন বুয়েট থেকে পাস করা প্রকৌশলীর সঙ্গে। ছোট মেয়ে রংপুরে বাংলায় মাস্টার্স শেষে চাকরি করছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। এ সবই সম্ভব হয়েছে টুপির কাজ করে। 

রংপুরের কাউনিয়ায় শাহিদা বেগম টুপি গোছানোর কাজে ব্যস্ত- ছবি: জাগরণ

শাহিদা জানালেন, সততা ধৈর্য্যশীলতাই তাকে এ অবস্থানে এনেছে। উপজেলা সদরে ৪২ শতক জমি কিনেছেন। খুব শিগগিরই বাড়ির কাজে হাত দেবেন। তিনি জানান, একেকটি টুপিতে সুই সুতার কাজে প্রতিদিন তিন চার ঘণ্টার বেশি সময় দেয়া যায় না। প্রতিদিন এ পরিমাণ সময় দিলেও একেকটি টুপি করতে সময় লেগে যায় ১০ থেকে ১২ দিন। অর্থাৎ একজন নারী মাসে ২ থেকে ৩টি কিংবা ৪টিও করে থাকেন। এ জন্য একেকটি টুপিতে নারীদের পারিশ্রমিক দেয়া হয় আড়াইশ থেকে সাড়ে ৩শ টাকা। আর এ টুপিই সৌদি ওমান কিংবা কাতারে বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশি টাকায় ৬শ থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত। শাহিদা এখন আর নিজে এ কাজ করেন না। গ্রামীণ নারীদের দিয়ে এসব করিয়ে নেন। আর এজন্য তাকে ঘুরতে হয় গ্রাম থেকে গ্রামে। তার গ্রাম ঘোরার খরচ এবং প্রতি টুপিতে কারিগরের পারিশ্রমিক ছাড়াও তাকে কমিশন দেয়া হয় ৫০ টাকা করে। এভাবে প্রতি মাসে এখন তার কমপক্ষে আয় হয় ২৮ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। প্রতিমাসে ব্যাংকেও সঞ্চয় করছেন তিনি। তার ভাষায় স্বামী সন্তানদের নিয়ে ‘যারপর নাই ভাল আছেন’ তিনি।
   
টুপি বানিয়ে শাহিদার সাবলম্বী হওয়ার গল্প এখন গোটা কাউনিয়া উপজেলায় এক দৃষ্টান্তের সৃষ্টি করেছে। তার মতো অনেকেই এখন টুপির কাজ করছেন। জানা যায়, ঢাকা, ফেনী, ছাগলনাইয়া থেকে লোক এসে গ্রামীণ নারীদের টুপির কাপড়, সুতা দিয়ে এবং কোন ডিজাইনের কতগুলো হবে ইত্যাদি বুঝিয়ে দিয়ে যায়।

ঈদকে ঘিরে প্রতিবছরই তারা অন্তত ৩ মাস আগে থেকে যোগাযোগ ও অর্ডার দিয়ে যায়। জানা গেছে, কাউনিয়ায় এখন স্থানীয়ভাবে অনেক দালাল-ফরিয়া প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যারা ঢাকাসহ বাইরের পার্টিদের কাছে চুক্তি নিয়ে গ্রাম্য নারীদের দিয়ে কাজ করিয়ে সেখানে সরবরাহ করছেন। 

পূর্বচাঁদঘাট গ্রামের টুপি কারিগর রোশনা, সামসুন্নাহার, ইসমাতআরা জানালেন, এখন গ্রামে অনেক দালাল হয়েছে। যারা তাদের কাছ থেকে কাজ করিয়ে নিলেও সঠিক মূল্য দেয় না।

স্থানীয় বড়ুয়াহাট বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের অধ্যক্ষ শাহ মো. রেজাউল ইসলাম জানালেন, কাউনিয়ার ঘরে ঘরে এই যে টুপি বিপ্লব, এরা যদি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেত, তবে তারা নিজেরাই এই টুপি দেশের বাইরে পাঠাতে পারতো। তখন আর এদের অন্যের দ্বারস্থ হতে হতো না। 

একই এলাকার তারেকুল ইসলাম তারেক জানান, ঢাকা কুমিল্লা ফেনী নোয়াখালীর মানুষ এসে এখানকার টুপি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন স্থানে বাজার গড়ে তুলেছেন। কিন্তু এখানকার কেউ এ বাজার তৈরি করতে পারেনি। এ অঞ্চলের কেউ যদি তা শুরু করতে পারে তবে তারা প্রত্যন্ত গ্রামের এই  মানুষগুলোর পরিশ্রমের সঠিক মূল্য দেবে। এজন্য এ অঞ্চলের বড় ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসা উচিত। 

রংপুর চেম্বারের কমার্সের সভাপতি শিল্পপতি মোস্তফা সারওয়ার টিটো জানান, ব্যাংকগুলো এখন ঋণ দিতে নারী উদ্যোক্তা খুঁজে বেড়াচ্ছে। যে কোন উদ্যোক্তা নারী পেলেই তারা এ ব্যাপারে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। এজন্য শুধু প্রযোজন সঠিক নির্দেশনা ও পরামর্শ। 

একেএস/টিএফ