• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ২৫, ২০১৯, ০৫:৩৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ২৫, ২০১৯, ০৫:৩৮ পিএম

‘আমি মাকে না নিয়ে যাব না, আমার মাকে বের করেন’

মানবতার দৃষ্টান্ত : মাটি খুঁড়ে লাশ বের করলেন তারা

মানবতার দৃষ্টান্ত : মাটি খুঁড়ে লাশ বের করলেন তারা
ট্রেনের নিচের মাটি সরিয়ে উদ্ধার করা হয় কুলাউড়ার মনোয়ারা পারভীনের লাশ  ছবি : জাগরণ

“হঠাৎ কানে এল ট্রেনের ভেতরে থাকা কোনো এক মেয়ের আর্তচিৎকার। বুকফাটা কান্নার আওয়াজে আমি স্থির থাকতে পারলাম না। দৌড়ে গিয়ে দেখলাম, একজন মহিলার (কুলাউড়ার আব্দুল বারীর স্ত্রী মনোয়ারা পারভীন (৪৫), শরীর ট্রেনের ভেতরে আর মাথাটা ট্রেনের জানালার বাইরে মাটির ভেতরে চাপা পড়ে আছে। মেয়েটা (রুকশানা পারভীন) বলতে লাগল, ‘ভাই, আমি মাকে না নিয়ে যাব না, আমার মাকে বের করেন’।”

লোমহর্ষক এই কথাগুলো বলেন গত রোববার (২৩ জুন) উপবন ট্রেন দুর্ঘটনাস্থল মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল ইউনিয়নের স্থানীয় সাবেক ফুটবলার ফখরুল আমিন চৌধুরী মিছলু। তিনি বলেন, ওই দুর্ঘটনার পর বরমচাল ইউনিয়নের সর্বস্তরের মানুষ এগিয়ে এসে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল।

এই সংবাদদাতাকে দেওয়া প্রত্যক্ষদর্শী ও উদ্ধারকর্মী মিছলুর দেওয়া বিস্তারিত বর্ণনা নিচে তুলে ধরা হলো :

মাত্র খেয়ে টেবিল থেকে উঠলাম। এমন সময় বিকট শব্দ। ভেবেছিলাম ভূমিকম্প হয়েছে হয়তো। ওই সময় আমার চাচাতো ভাই দীপু (এজাজ কবির দীপু) ফোন দিয়ে বলল, ‘তোমাদের বাড়ির সামনে উপবন ট্রেন এক্সিডেন্ট করেছে, দ্রুত আসো।’ কোনো কিছু না ভেবে আমি ও আমার আরও দুই ভাই হুছনুল আমিন চৌধুরী ফাজু, লুৎফুল আমিন চৌধুরী মারফু ঘটনাস্থলে যাই। সেখানে গিয়ে উপলব্ধি করলাম বীভৎস অবস্থা, চারদিকে অন্ধকার, ভীতিকর পরিবেশ, সুনসান নীরবতা।

দৌড়ে গিয়ে উল্টে যাওয়া ট্রেনের ওপর উঠে যাই। ওপর থেকে ভেতরের দৃশ্য দেখে মনে হয়েছিল সবাই লাশ হয়ে পড়ে আছে। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে দু-একজন বলতে শুরু করলেন, ‘ভাই, আমার হাত নাই, আমাকে বের করেন।’ আরেকজন যাত্রী বললেন, ‘ভাই, আমার পা তুলতে পারছি না, আমাকে বের করেন।’ বুঝলাম ওখানে লাশের চেয়ে আহতের সংখ্যা বেশি। উদ্ধারকাজ শুরু করলাম, আমাদের স্থানীয় জয়নুল ইসলামকে বলি, ‘একটা মইয়ের ব্যবস্থা করো। নতুবা মানুষকে নামাতে পারব না।’

এভাবেই উদ্ধার করা হচ্ছিল আহত ব্যক্তিদের। হঠাৎ কানে এল কোনো এক মেয়ের আর্তচিৎকার। বুকফাটা কান্নার আওয়াজে আমি স্থির থাকতে পারলাম না। দৌড়ে গিয়ে দেখলাম, একজন মহিলার (পরে জানতে পারি, তিনি কুলাউড়ার আব্দুল বারীর স্ত্রী মনোয়ারা পারভীন (৪৫), শরীর ট্রেনের ভেতরে আর মাথাটা ট্রেনের জানালার বাইরে মাটির ভেতরে চাপা পড়ে আছে। মেয়েটা (রুকশানা পারভীন) বলতে লাগল, ‘ভাই, আমি মাকে না নিয়ে যাব না, আমার মাকে বের করেন।’

ওই অবস্থাতেই ট্রেনের ভেতর থেকে আমি, জয়নুল ইসলাম, আমার ভাই ফাজু, মারফু, সালামত খান, হাসান উদ্দিন, নুর আলী, শফিক, জাকির আহমদ, সাহিদ মিয়া ট্রেনের দুই জানালার নিচের মাটি সরানো শুরু করলাম। একপর্যায়ে মহিলার মাথাটি বের করতে সক্ষম হলাম। বিকৃত হয়ে যাওয়া মাথাটা দেখে উপস্থিত কেউ কেউ ভয় পাচ্ছিলেন। আমি মহিলার মেয়ের গায়ের ওড়না নিয়ে অর্ধেক করে লাশটি ঢেকে বেঁধে নিলাম। পরে মহিলার গায়ের শাড়ির আঁচল দিয়েও মাথাটা বেঁধে দিলাম।

এদিকে একই বগির শেষ মাথায় আরও দুজন মহিলার (সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নার্স সানজিদা আক্তার (২০) ও ফাহমিদা ইয়াসমিন ইভা (২০)) পা ট্রেনের ভেতরে আটকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু শরীরের বেশি রভাগ অংশ ট্রেনের নিচে চাপা পড়ে আছে। আমি ওপরে উঠে উপস্থিত কয়েকজনকে চিৎকার করে বললাম, ট্রেনের উল্টো পাশে গিয়ে মাটি সরিয়ে লাশ দুটো বের করতে। মাটি খননে সাহায্য করেছেন স্বপন, শফিক, কালাম। এর পরের সর্বশেষ বগি থেকে একজন পুরুষের (হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার নুর হোসেনের ছেলে কাওছার হোসেন (২৬)) লাশ বগি থেকে বের করে কাঁধে করে মাটিতে নামান কয়ছর টেইলার। এ সময় উদ্ধারকাজে নিরলস শ্রম দেন মো. আবু হানিফ, তাজুল ইসলাম সাইকুল, এম জামাল হোসেন, চুনু প্রমুখ।

এছাড়া উদ্ধারকাজে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন ভাটেরা ইউপির চেয়ারম্যান একেএম নজরুল ইসলাম, বরমচালের নজরুল ইসলাম লিজাত, আ. বাছিত, আব্দুস সালাম, মাতাব, আ. করিম, রিপন, কাওছার, ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের নজরুল ইসলামসহ শতাধিক স্থানীয় লোক। এ সময় স্থানীয় অনেক মহিলাও মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসেন।

লাশ উদ্ধারের শেষ মুহূর্তে ফায়ার সার্ভিসের টিম আমাদের কাছ থেকে লাশগুলো গ্রহণ করে।

শুধু আমরা নই, বরমচাল ইউনিয়নের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। ভাটেরা-ব্রাহ্মণবাজারের অনেক মানুষও উদ্ধারকাজে সহযোগিতা করেন। বরমচাল ইউনিয়নের সিএনজি মালিক-ড্রাইভার সমিতির উদ্যোগে মানবতার খাতিরে আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কাজে নিয়োজিত ছিল। সিএনজি মালিক ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ইছহাক চৌধুরী ইমরান, সাহান উদ্দিন আহমদ, আব্দুল জহুর ডেন ও সিএনজি ড্রাইভার সমিতির সভাপতি আব্দুস সালাম, সাধারণ সম্পাদক বাবেল মিয়া আহতদের উদ্ধারপূর্বক হাসপাতালে স্থানান্তরে সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন।

এ বিষয়ে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ইছহাক চৌধুরী ইমরান বলেন, ‘বরমচালের সর্বস্তরের মানুষ অনেক অক্লান্ত পরিশ্রম করে মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যে আহত মানুষকে উদ্ধার করে। লাশগুলোকে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বাকি উদ্ধারকাজে সহায়তা করে।

এ বিষয়ে সাবেক ফুটবলার ও সংগঠক এম জামাল হোসেন বলেন, ‘খবর পেয়ে বরমচালের সর্বস্তরের মানুষ এগিয়ে আসেন। মানুষের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় হতাহতের সংখ্যা কমে যায়।’

সাবেক ফুটবলার ও সংগঠক তাজুল ইসলাম সাইকুল বলেন, ‘উদ্ধারকাজে যেভাবে বরমচালবাসী এগিয়ে এসে সহায়তা করেছে, তা সত্যিই ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে। মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করল বরমচালবাসী।’

উল্লেখ্য, ওই দুর্ঘটনায় তিনজন নারী ও একজন পুরুষের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক।

এনআই