• ঢাকা
  • বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ২০, ২০১৯, ১০:০২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ২১, ২০১৯, ০৯:৩০ এএম

মাদকের বলি রিফাত শরীফ 

০০৭ বন্ডের সদস্য হতে পাড়ি দিতে হয় তিন ধাপ

০০৭ বন্ডের সদস্য হতে পাড়ি দিতে হয় তিন ধাপ

বরগুনায় মাদক সিন্ডিকেটের আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকেই রিফাত শরীফকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এমনটাই মনে করেন বরগুনার সচেতন মহল। তাদের মতে, রিফাত হত্যার সঙ্গে জড়িতরা সবাই মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ী। তারা সবাই ০০৭ বন্ড বাহিনীর সদস্য। এই ঘটনার সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্যের ছেলের সম্পৃক্ততার বিষয়টিও আলোচনায় রয়েছে।

প্রশ্ন উঠেছে, নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকী মিন্নির সঙ্গে নয়ন বন্ডের সম্পর্ক ছিল। সেই কারণেই জন্য যদি হত্যাকাণ্ডটি হয়ে থাকে, তবে রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী কেন রিফাত শরীফকে কোপাবে? আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি গ্রেপ্তারের আগেই বলেছে, তাকে ফাঁসানোর ষড়যন্ত্র চলছে। মিন্নির পিতাও দাবি করেছেন, রিফাত শরীফ হত্যার সঙ্গে একাধিক ঘটনা জড়িত। এর মধ্যে রিফাত হত্যার দুদিন আগের ঘটনাটি প্রাধান্য পাচ্ছে। 

বরগুনার সাধারণ মানুষ মনে করেন, মাদক ব্যবসার বিরোধ নিয়েই এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। বরগুনা জেলা নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. আনিসুর রহমান জানিয়েছেন, রিফাত শরীফ হত্যার অন্যতম কারণ হচ্ছে, মাদক ও ০০৭ কিশোর গ্যাং বাহিনী। এ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ২৬০ জন। তিনটি পরীক্ষায় পাস করে এই বাহিনীর সদস্য হতে হয়। এক. অবশ্যই তাকে মাদকসেবী হতে হবে। দুই. তাকে মাদক ব্যবসায় যুক্ত হতে হবে। তিন. এ বাহিনীর সদস্য হিসেবে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, লুটপাট, অপহরণ ও ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবে কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে হবে। 

বন্ড বাহিনী ছাড়াও বরগুনায় টিম ৬১, লারেলাপ্পা, হানীবন্ডসহ বিভিন্ন নামে একাধিক কিশোর গ্যাং গ্রুপ রয়েছে। সব মিলিয়ে এদের সদস্য সংখ্যা হবে সহস্রাধিক। বরগুনার মতো ছোট্ট একটি জেলায় সহস্রাধিক মাদক ব্যবসায়ী বা সন্ত্রাসী বাহিনী থাকলে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হওয়াই স্বাভাবিক। এই কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যদের বয়স ১২ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। হাতে গোনা কয়েকজন লিডারের বয়স ৪০ এর মধ্যে। 

অ্যাডভোকেট মো. আনিসুর রহমান আরো জানিয়েছেন, বরগুনায় সড়ক পথ ছাড়াও বঙ্গোপসাগর হয়ে নৌপথে মাদকের বড় বড় চালান আসে। চলতি বছরের ২ এপ্রিল ঢাকা সদরঘাটে বরগুনা থেকে ছেড়ে যাওয়া সপ্তবর্ণা লঞ্চ এবং আবদুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে ৫০ কোটি টাকা মূল্যের ৮ লাখ ইয়াবা র‌্যাব সদস্যরা আটক করে। সেসময় যে ৩ জনকে আটক করা হয়েছিল তাদের দুজনের বাড়ি বরগুনায়। 
মিয়ানমার থেকে সাগর পথে ইয়াবার চালান বরগুনায় আসে। এর একটা অংশ কিশোর বয়সী মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবীদের কাছে চলে যায়। বরগুনায় অনেক ভূমিহীন পরিবারের সন্তান রয়েছে যারা অত্যন্ত অত্যাধুনিক ও দামি মোটরসাইকেল চালায়, ৫০/৬০ হাজার টাকা দামের স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে। 

মিয়ানমার থেকে মাদকের চালান আসার পরে তালতলীর শুভসন্ধ্যা সমুদ্র সৈকতের অদূরে মৎস্যজীবীদের ট্রলারে খালাস হয়। তালতলীর ‘ম’ আদ্যাক্ষরের কোম্পানি ও পাথরঘাটার ‘স’ আদ্যাক্ষরের কোম্পানির ট্রলারে মাদকের চালান তীরে নিয়ে আসা হয়। এ ছাড়াও বরগুনায় ‘হ’ আদ্যাক্ষরের টেকনাফ নামে একজন ইয়াবা ব্যবসায়ী রয়েছে।

রিফাত শরীফ, রিফাত ফরাজী, নয়ন বন্ডসহ ০০৭ বাহিনীর সদস্যরা একত্রেই মাদক সেবন ও ব্যবসা করত। একসময় তারা একত্রেই চলাফেরা করত। এমনকী একটি মাদকের মামলায় রিফাত শরীফ ও রিফাত ফরাজী একত্রে আসামিও ছিল। 

মামলা সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ১১ মে রাত পৌনে ২টার দিকে রিফাত শরীফ ১০০ পিস ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে আটক হয়। বরগুনা থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক সোহেল খান তাকে গ্রেফতার করেন। এসময় রিফাত শরীফকে আটকের দৃশ্য মোবাইল ফোনে ভিডিও করে নয়ন বন্ড ও তার সহযোগীরা। তারা সেদিনই ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়। ওই মামলায় আটকের পরে রিফাত শরীফ ১৯ দিন কারাগারে ছিল। 

কারাগার থেকে বের হয়ে রিফাত শরীফ তার প্রতিপক্ষ রিফাত ফরাজী ও নয়ন বন্ডের কাছে জানতে চায়, কেন তারা ইয়াবা দিয়ে তাকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছে। কেন তারা তাকে আটকের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়েছে। এ নিয়ে দ্বন্দ্বের একপর্যায়ে রিফাত ফরাজীকে হাতুড়ি পেটা করে রিফাত শরীফের নেতৃত্বে তার সহযোগীরা। রিফাত শরীফকে হত্যার পেছনে এটিও একটি কারণ হতে পারে।

মিন্নির চাচা আবু সালেহ জানিয়েছেন, রিফাত শরীফকে হত্যার দুদিন আগে ঘটেছে আরেকটি ঘটনা। রিফাত শরীফের কাছ থেকে ইয়াবা কিনেছিল হেলাল নামে এক যুবক। ইয়াবার টাকা না দেয়ায় গত ২৪ জুন হেলালের মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় রিফাত শরীফ। হেলালের সঙ্গে রিফাত শরীফের আগে বন্ধুত্ব থাকলেও পরবর্তীতে নয়ন বন্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। যে কারণে রিফাত শরীফের কাছ থেকে মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করার জন্য আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে ফোন করে নয়ন বন্ড। নয়নের কথায় মিন্নি ২৪ জুন রাতেই রিফাত শরীফের কাছ থেকে হেলালের মোবাইল ফোন উদ্ধার করে। মোবাইল ফোন উদ্ধার করতে গিয়ে স্বামীর মারধরের শিকার হন মিন্নি। রিফাত শরীফ হত্যার আগের দিন ওই মোবাইল ফোন নিয়েই নয়নের বাসায় যায় মিন্নি। তখন মিন্নি বলেছিল, মোবাইল ফোন উদ্ধার করতে গিয়ে তাকে স্বামীর মার খেতে হয়েছে। নয়ন তখন তাকে বলেছিল, তোমার স্বামীকেও পাল্টা মার দেয়া হবে। রিফাত শরীফ যেন তার স্ত্রীর গায়ে হাত না দেয়, সেই শিক্ষা দেয়া হবে। রিফাত শরীফকে শিক্ষা দেয়া নিয়ে ২৫ জুন রাতেও নয়ন বন্ডের সঙ্গে ফোনে মিন্নির কথা হয়েছে। এর পরের দিন সকালে রিফাত শরীফকে কোপানো হয়। বরিশালে নেয়ার পথে বিকাল ৪টার দিকে রিফাত মারা যায়।

বরগুনা জেলা নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটির পক্ষ থেকে গত ১৫ জুলাই মানববন্ধন কর্মসূচি পালন শেষে ৭ দফা দাবিতে বরগুনা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে। দাবিগুলো হচ্ছে, বরগুনায় মাদক ব্যবসায়ী ও গডফাদারদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। সড়কপথ ও নৌপথে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তাদের জন্য অত্যাধুনিক জলযানসহ একটি সি-প্লেনের ব্যবস্থা করতে হবে। বরগুনায় একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র করতে হবে। সন্ধ্যার পর সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান ও কোচিং বন্ধ রাখতে হবে এবং মাদক উদ্ধারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে। বরগুনার সকল গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে স্থায়ী চেকপোস্ট বসাতে হবে এবং সন্দেহজনক ব্যক্তিদের তল্লাশি করতে হবে। রিফাত হত্যাসহ বরগুনার সকল হত্যাকাণ্ড এবং মাদক ব্যসায়ীদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

বরগুনার ধূমপান বিরোধী আন্দোলনের সভাপতি ও মানবাধিকারকর্মী মো. হাসানুর রহমান ঝন্টু জানিয়েছেন, বরগুনায় মাদকের রমরমা ব্যবসা চলছে। এই মাদক ব্যবসায়ীরাই রিফাত শরীফকে হত্যা করেছে। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, বরগুনা জেলা শহরের প্রায় প্রত্যেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদক গ্যাং ও লিডার রয়েছে। তারাই ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মাদকসেবী বানাচ্ছে। 

তিনি আরো জানান, মাদক নিয়ে রিফাত শরীফের সঙ্গে সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ডের বিরোধ ছিল। সেই বিরোধের জের ধরেই রিফাতকে মাদক দিয়ে নয়ন ফাঁসিয়েছিল। মাদক সম্পৃক্ততার দায়ে রিফাত জেলেও ছিল। পুরো ঘটনা সবার জানা। যদিও পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন দাবি করেছেন, রিফাত খুনের সঙ্গে মাদকের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তবে তিনি আসামিদের অনেকেই মাদকসেবী ও কারবারি বলে স্বীকার করেছেন।

স্থানীয় লোকজন বলছে, বরগুনা শহরে কান পাতলেই শোনা যাবে, রিফাত হত্যার আসামিরা মাদক ও মোটরসাইকেল চোরাচালানের সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। প্রধান আসামি, যে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে সেই নয়ন বন্ড ২৬০ জন সদস্য নিয়ে ফেসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপ ০০৭-এর মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাত। 

নিহত নয়ন বন্ডের মা শাহিদা বেগম জানিয়েছেন, তার ছেলের সঙ্গে এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথের একসময় ভালো সম্পর্ক ছিল। গত উপজেলা নির্বাচনের সময় সেই সম্পর্কে একটু ফাটল ধরে। 

বরগুনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জুবায়ের আদনান অনিক জানান, সুনামের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও মদদে নয়ন মাদক চোরাকারবার ও মোটরসাইকেল চোরাচালানে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল। মাদক চোরাকারবার, চোরাচালান ও আরো ক্ষমতা লাভের আশায় সুনাম সেই গ্যাং গঠন করেন। এর আগেও সংবাদ সম্মেলনে করে সুনামের বিরুদ্ধে মাদকের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলেছিলেন জুবায়ের। 

সুনাম দেবনাথ এসব অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, তার বাবা ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু যেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পান সেজন্য আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। তার বাবার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে তার বিরুদ্ধে মাদকের মিথ্যা অভিযোগ তুলেছিল ওই পক্ষ। তার দাবি, এখনও তারা মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।

বরগুনা থানার ওসি আবির মোহাম্মদ হোসেন জানান, রিফাত শরীফকে যারা হত্যা করেছে তাদের মধ্যে নয়ন বন্ডের নামে ৮টি ও রিফাত ফরাজীর নামে ৪টি মামলা রয়েছে। এর অধিকাংশই মাদকের মামলা।

বরগুনা জেলা মহিলা পরিষদের সভাপতি নাজমা বেগম জানিয়েছেন, বরগুনায় মাদকের কারণেই কিশোর বয়সী ছেলেমেয়েরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তার ধারণা, মাদকের কারণেই রিফাত শরীফকে হত্যা করা হয়েছে। 

তিনি আরো জানান, নয়নের সাথে মিন্নির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকতে পারে। কিন্তু রিফাত শরীফ হত্যার সঙ্গে মিন্নি জড়িত- এটা তাদের বিশ্বাস হচ্ছে না। তারা মিন্নিকে আইনি সহায়তা দিতে চান। তার দাবি, বরগুনায় মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে আরো হত্যার ঘটনা ঘটবে।

এফসি

আরও পড়ুন