• ঢাকা
  • বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ৩০, ২০১৯, ০৮:৪২ এএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ৩০, ২০১৯, ০৮:৪২ এএম

৩৭টি পয়েন্ট ধসে ভয়াবহ রূপ গাইবান্ধার বন্যার

৩৭টি পয়েন্ট ধসে ভয়াবহ রূপ গাইবান্ধার বন্যার

গাইবান্ধায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের অন্তত ৩৭টি পয়েন্ট ধসে শহর ও নিম্নাঞ্চলের ৪২৪টি গ্রামে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতিতে চরম বিপর্যয় দেখা দেয়। 

অন্যদিকে, সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলো সঠিক সময়ে মেরামত করায় বাঁধ ভেঙে কোথাও পানি প্রবাহিত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। ফলে ভয়াবহ বন্যার হাত থেকে বাড়িঘর ও সম্পদ রক্ষায় কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পশ্চিম অঞ্চলের মানুষেরা।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, যমুনা, করতোয়া, ঘাঘট, আলাই ও বাঙালী নদ-নদী বেষ্টিত গাইবান্ধা জেলা। এবারের বন্যায় সদর, ফুলছড়ি, সাঘাটা, সাদুল্লাপুর ও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার নদ-নদীর তীর ঘেঁষে ২৪২.৫৫ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৩৭টি পয়েন্ট ধসে যায়। 

গত ১১ জুলাই থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত উজানের ঢল ও অব্যাহত বৃষ্টিপাতে পানির প্রবল চাপে ধসে যায় বাঁধগুলো। এরমধ্যে ফুলছড়িতে ব্রহ্মপুত্র নদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১৩টি পয়েন্ট, সদর ও সাদুল্লাপুরে ঘাঘট নদীর শহর রক্ষাসহ ডান তীর ও বাম তীর বাঁধের ২১টি পয়েন্ট ও করতোয়া নদীর গোবিন্দগঞ্জে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৩টি পয়েন্ট ধসে যায়।

একের পর এক বাঁধ ধসে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে জেলার দু’টি পৌরসভা ও সাত উপজেলার ৪২৪টি গ্রামের ৫ লাখ ৮৫ হাজার ৩৯৭ জন মানুষ ক্ষতির শিকার হন। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৫৯ হাজার ৮৭০টি পরিবারের বাড়িঘর। নষ্ট হয় ১৪ হাজার ২১ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল। 

মরে-ভেসে যায় সাড়ে ৬ হাজার পুকুর ও খামারের মাছ। বিধ্বস্ত হয়েছে রেললাইন, ৬শ কি.মি. কাঁচা সড়ক, ২শ ৬৬ কি.মি. পাকা সড়কসহ ৩৯টি ব্রিজ-কালভার্ট। বন্যার পানিতে ডুবে ও সাপের কামড়ে শিশুসহ মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের।

প্রতি বছরেই বন্যায় জেলার দুর্গম চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের কমবেশি ৩ লাখ মানুষ ক্ষতির শিকার হয়। কিন্তু বাঁধ ভেঙে এবারের বন্যা যে বিপর্যয় এবং ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে তাতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় গাইবান্ধার মানুষ। এ জন্য অনিয়ম-দুর্নীতিসহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের খাময়েলিপনা এবং গাফিলতিকে দায়ী করছেন সচেতন মহল ও স্থানীয়রা। 

তাদের অভিযোগ, সময় মতো বাঁধ সংস্কার দূরের কথা, জরুরি মুর্হুতে বারবার বলা সত্ত্বেও ভাঙন প্রতিরাধে নেয়া হয়নি পদক্ষেপ। ফলে বাঁধ ধসে বন্যা পরিস্থিতি মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে। এছাড়া বর্তমানে ধসে যাওয়া বাঁধ রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড তাড়াতাড়ি করে বালুর বস্তা ফেলে দুই-তিনটি পয়েন্ট কোন রকমে রক্ষা করলেও এখনো অধিকাংশ পয়েন্টে তীব্র স্রোতে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। 

এ অবস্থায় বাঁধ রক্ষায় বালুর বস্তা ফেলে শুধু সরকারের কোটি কোটি টাকার অপচয় হচ্ছে। অন্যদিকে অনিয়ম-দুর্নীতি আর লুটপাটে ঠিকাদার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পকেট ভারী করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে, বন্যার এমন ভয়াবহতা থেকে কিছুটা রক্ষা পেয়েছে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীর তীর ঘেঁষে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের আশপাশ এলাকার লাখ লাখ মানুষ। বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে তাৎক্ষণিকভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বরত কর্মকর্তা স্থানীয়দের সহায়তায় বালুর বস্তা ফেলে মেরামত করায় ভাঙন রক্ষা হয়।

স্থানীয়রা বলছেন, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীর তীর ঘেঁষে সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের প্রায় ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ৮ কিলোমিটার বাঁধ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। উজানের ঢল ও পানির প্রবল চাপেও ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের কোন পয়েন্ট ধসে বা ভেঙে যায়নি। তবে লালচামার, জয়বাংলা মোড়, ফারাজিপাড়া ও হরিপুরের ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টে পানির প্রবল চাপে ধসের উপক্রম হলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। 

কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৎপরতায় বালুর বস্তা ফেলে মেরামত করায় ভাঙন ঠেকানো সম্ভব হয়। এছাড়া বর্ষার আগে থেকেই বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট রক্ষায় জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়দের চাপ ও দাবির মুখে নজরদারীসহ তৎপর হয়ে উঠেন স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট পানি উন্নয়ন বোর্ডের এ অঞ্চলের দায়িত্বরত কর্মকর্তা।

সঠিক সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত পয়েন্টগুলোতে বালুর বস্তা, জিও ব্যাগ ফেলাসহ পাইলিং করার কারণে কোথাও বাঁধ ধসের ঘটনা ঘটেনি। ফলে ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা ও হাহাকারের পরিবর্তে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে শ্রীপুর, কাপাসিয়া, চন্ডিপুর, হরিপুর, কঞ্চিবাড়ি ও বেলকা ইউনিয়নের বাঁধের তীর (পশ্চিম অঞ্চলের) মানুষ।

সরেজমিনে চন্ডিপুর ইউনিয়নের হরিপুর, ফারাজিপাড়া, জয়বাংলা মোড়, উত্তর সীচা ও লালচামার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কয়েক যুগের পুরনো বাঁধের কোথাও উচু, কোথাও নিচু। আবার কোথাও প্রশস্ততাও কমে সরু বাঁধে পরিণত হয়েছে। ইঁদুরের গর্ত, ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট এবং মেরামত (বালুর বস্তা ফেলানো) অংশ দেখলেও বোঝা যায় ভয়াবহতা।

তারপরেও বাঁধের উপর ও দুই ধারে ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস করছে মানুষ। এছাড়া বন্যা আক্রান্ত অধিকাংশ মানুষ বাঁধগুলোতে ছাপড়া ও টিনের চালা তুলে আশ্রয় নিয়েছে।

চন্ডিপুরের জয় বাংলা মোড়ের বাঁধের পাশের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘বাঁধগুলো দীর্ঘদিনের পুরনো। বেহাল অবস্থা আর কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তা বাস্তবে দেখলেই বোঝা যায়। প্রতি বছরই বাঁধ সংস্কার হয়। কিন্তু তা শুধু বর্ষা আর ভাঙনের সময়। শুধু সাময়িক মেরামত নয়, সঠিক রক্ষাণাবেক্ষণ ও শুষ্ক মৌসুমে স্থায়ী সমাধানে বাঁধ সংস্কার করতে হবে’।

চন্ডিপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নং ওয়ার্ড সদস্য (মেম্বার) রঞ্জু মিয়া বলেন, ‘সুন্দরগঞ্জের অধিকাংশ বাঁধেই ঝুঁকিপূর্ণ। তবে ভাঙন ঠেকাতে প্রস্তুত ছিলো পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন। ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের অন্তত ২০টি পয়েন্ট মেরামতের কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে লাখ লাখ মানুষ।

বর্ষা ও বন্যা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টে জরুরি মেরামত কাজ চলমান রাখতে পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঠিক দায়িত্ব ও আন্তরিক ভূমিকা পালনের দাবি জানান তিনি’।

এ বিষয়ে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বাঁধ রক্ষায় দায়িত্বরত পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী এ.টি.এম মোনায়েম হোসেন বলেন, ‘নৈতিকতা ও দায়িত্বেবোধ নিয়ে বাঁধ রক্ষায় দিনরাত সার্বক্ষণিক তদারিক করেছি। স্থানীয়দের সহযোগিতায় বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে বালুর বস্তা, জিও ব্যাগ ও পাইলিং করে মেরামতের ফলে ভাঙন রোধ সম্ভব হয়েছে।

আশা করছি, আপাতত বর্ষা মৌসুমে বাঁধ ভাঙনের বিপর্যয়ের মুখে পড়বে না মানুষ। সুন্দরগঞ্জ উপজেলার পুরো বাঁধটি স্থায়ী সংস্কারের জন্য জরিপ কাজ সম্পন্ন করে একটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবনাটি অনুমোদন হলে দ্রুত কাজ শুরু হবে। এতে ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবে এলাকার মানুষ’।

গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের এমপি ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘বাঁধ রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সর্বদাই সর্তক ছিল। সকলের আন্তরিক চেষ্টায় বাঁধ ধস ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ঝুঁকিপূর্ণ ও আর জোড়াতালির বাঁধ রক্ষায় স্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহণে মন্ত্রণালয়সহ সংসদেও বারবার দাবি জানানো হয়। মানুষের জানমাল-সম্পদ রক্ষায় নদী শাসন ও ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের স্থায়ী সংস্কার এবং টেকসই-স্থায়িত্ব বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে’।

অনিয়ম-দুর্নীতি ও গাফিলতির অভিযোগ অস্বীকার করে গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হারুন অর রশিদ বলেন, ‘বরাদ্দের অভাবে স্থায়ীভাবে বাঁধ মেরামত করা হয়নি। তারপর প্রতিবছর বন্যা ও নদী ভাঙন এবং নাব্যতা সংকটে বাঁধগুলো রক্ষা অনেকটা কঠিন হয়ে পড়ে। 

তারপরেও ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের পয়েন্টগুলোতে আপতকালীন পদক্ষেপে বালুর বস্তা, জিও ব্যাগ, পাইলিং করে ভাঙনরোধে মেরামত করা হয়। এছাড়া প্রতি বছরেই বাঁধের অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ও হুমকির মুখে থাকা এলাকা চিহ্নিত করাসহ তীর রক্ষা প্রকল্পের আওতায় কাজ করা হয়। তবে বাঁধগুলোর স্থায়ী সংস্কারসহ বেশ কিছু পরিকল্পনা দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। 

সেগুলোর অনুমোদন হলে বাঁধগুলোতে ঝুঁকিমুক্ত করা সম্ভব হবে। বর্ষা মৌসুম শেষে নতুন করে কিছু পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনা তৈরি করে আবারও পাঠানো হবে’।

কেএসটি

আরও পড়ুন