• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ০৭ মে, ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ২৭, ২০১৯, ০৬:২৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ২৭, ২০১৯, ০৬:২৬ পিএম

জালিয়াতি করে দেড় যুগ শিক্ষকতায় জামায়াত নেতা!

জালিয়াতি করে দেড় যুগ শিক্ষকতায় জামায়াত নেতা!
প্রধান শিক্ষক গোলাম কবির আখতার জাহান  -  ছবি : জাগরণ

মাত্র ১০ মাসের অভিজ্ঞতায় সহকারী শিক্ষক থেকে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কাশিমপুর একে ফজলুল হক উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন গোলাম কবির আখতার জাহান। সর্বশেষ গত ২৫ মে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষকের পদে এসেছেন তিনি।

যদিও প্রধান শিক্ষক নিয়োগে উচ্চ আদালতে রিট করেন বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিক। রিট নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই গোপনে প্রধান শিক্ষকের পদ বাগিয়ে নেন গোলাম কবির।

গোলাম কবির আখতার জাহান উপজেলার কাশিমপুর গ্রামের মৃত শাহজাহানের ছেলে। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিতে যুক্ত। তৎকালীন সরকারবিরোধী আন্দোলনেও অংশ নেন এই জামায়াত নেতা। গোদাগাড়ীতে জামায়াতের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অর্থের জোগানদাতাও তিনি।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়। পরে এখনকার বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শরিফুল আলমের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন ওই প্রধান শিক্ষক। এর পরই ওই মামলা থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি।

অভিযোগ উঠেছে, প্রায় ১৮ বছর ধরে শিক্ষকতার নানান পর্যায়ে জালিয়াতি করে প্রধান শিক্ষক পদে এসেছেন গোলাম কবির। এই দীর্ঘ সময়ে জড়িয়েছেন নানান অনিয়মে। নিজের অনিয়ম ঢাকতে অনিয়মের সুযোগ করে দিয়েছেন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটিকেও।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০১ সালের ১১ এপ্রিল সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান গোলাম কবির আখতার জাহান। এর ১০ মাসের মাথায় ২০০২ সালের ১০ এপ্রিল একই বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান।

বিধি অনুযায়ী, সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের দুই বছর শিক্ষানবিশকাল। সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে সহকারী শিক্ষক হিসেবে ১২ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়।

কিন্তু শিক্ষানবিশকাল পূরণ হওয়ার আগেই সহকারী প্রধান শিক্ষক হয়ে যান গোলাম কবির। এর পরের ১১ বছর ৬ মাস অভিজ্ঞতা দেখিয়ে গত ২৫ মে প্রধান শিক্ষক হন তিনি। তার সব কটি নিয়োগই বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটিকে ম্যানেজ করে।

অভিযোগ রয়েছে, সহকারী প্রধান শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক পদে গোলাম কবিরের নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে অত্যন্ত গোপনে। গোপনে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ এবং গোপন স্থানে কথিত এই নিয়োগ পরীক্ষা হয়েছে। যাচাই-বাছাইয়ে গোলাম কবিরের আবেদন বৈধ হওয়ার প্রমাণ নেই। তার পরও তাকেই বৈধ এবং মনোনীত প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করে নিয়োগ কমিটি।

ওই সময়কার রেজুলেশনের কপি এসেছে এ প্রতিবেদকের হাতে। তাতে দেখা গেছে, সহকারী প্রধান শিক্ষক পদের সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্ত প্রার্থী হিসেবে দেখানো হয়েছে গোলাম কবির আখতার জাহানকে। কিন্তু তিনি কত নম্বর পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন, সেটি উল্লেখ নেই। উল্লেখ নেই ওই পরীক্ষায় ঠিক কতজন প্রার্থী অংশ নিয়েছিলেন। নিয়োগ পরীক্ষা কোথায় অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেই স্থানও উল্লেখ নেই রেজুলেশনে।

তৎকালীন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মোজাহারুল ইসলাম ওরফে ঝালু চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে ৫ জনের নিয়োগ কমিটি এই নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। কমিটিতে ডিজির প্রতিনিধি ছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের হরিমোহন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মঞ্জুর আহমেদ। তিনি গোলাম কবির আখতার জাহানের নিকটাত্মীয় বলে জানা গেছে।

তৎকালীন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য একেএম কামরুজ্জামানও ছিলেন নিয়োগ কমিটিতে। তিনি বাদে কমিটির বাকি সদস্যরা মৃত্যুবরণ করেছেন। গোলাম কবির আখতার জাহানের নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে একেএম কামরুজ্জামান বলেন, তাকে না জানিয়েই নিয়োগ হয়েছে। কমিটির এমন অনেক সদস্যই ছিলেন, যারা এই নিয়োগ বিষয়ে জানতেন না। কেবল সভাপতির সম্মান রক্ষায় রেজুলেশনে সই দিয়েছেন মাত্র।

তার অভিযোগ, এই নিয়োগ ছাড়াও একই সাথে আরো কয়েকটি নিয়োগ হয়েছে। সেখানেও অনিয়ম হয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যালয়ে নানান অনিয়ম হয়েছে। এসবের প্রতিবাদ জানিয়ে মেয়াদের মাত্র দুই মাস পর দায়িত্ব ছেড়ে চলে আসেন তিনি।

বিদ্যালয়ে নানান অনিয়মের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক। নাম প্রকাশ না করে এক সহকারী শিক্ষক বলেন, সহকারী প্রধান শিক্ষক হওয়ার পর থেকেই অনিয়মে জড়ান তিনি। শিক্ষকদের ভাষ্য, পুরাতন বই-খাতা বিক্রি, বিদ্যালয়ের নামের জমি ইজারা, দোকান ভাড়া, ছোটখাটো নির্মাণ ও সংস্কারে ব্যাপক আর্থিক অনিয়ম করে আসছেন প্রধান শিক্ষক।

পরিচালনা কমিটির সভাপতি শরিফুল আলম ও সদস্য আহাদ আলীর যোগসাজশে এই অনিয়ম করে যাচ্ছেন। তার অনিয়মের প্রতিবাদ করলেই হুমকির মুখে পড়ছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা।

জানতে চাইলে নিজের সব কটি নিয়োগই বৈধ বলে দাবি করেন প্রধান শিক্ষক গোলাম কবির আখতার জাহান। তার দাবি, তৎকালীন পরিচালনা কমিটি তাকে নিয়োগ দিয়েছে। বিধি মেনেই সম্পন্ন হয়েছে নিয়োগপ্রক্রিয়া। এ সময় তিনি কোনো অনিয়মে জড়িত নন বলেও দাবি করেন।

তার সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ পাওয়ার বিষয়টি জানা নেই বলে দাবি করেন বর্তমান সভাপতি শরিফুল আলম। তার দাবি, প্রধান শিক্ষক নিয়োগ স্বচ্ছতার সাথে হয়েছে। উচ্চ আদালতে রিটের পরও নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আদালত নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা দেননি। নিয়োগে আইনত কোনো বাধা নেই। সেটি মাথায় রেখেই নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছে।

প্রধান শিক্ষক নিয়োগপ্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন তৎকালীন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শামশুল হক। এখন তিনি নওগাঁর সাপাহারে কর্মরত। তার দাবি, সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে অভিজ্ঞতার আলোকে ওই শিক্ষককে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে তার সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগে জালিয়াতি হয়েছে, সেটি তিনি জানতেন না। এ নিয়ে নিজের দায় স্বীকার করেন এই শিক্ষা কর্মকর্তা।

জানতে চাইলে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নাসির উদ্দীন বলেন, তার ফাইলটা আমরাও দেখেছি, সেখানে কিছু ঘাটতি লক্ষ করা গেছে। কিন্তু তৎকালীন পরিপত্র অনুযায়ী তার সহকারী প্রধান শিক্ষকের নিয়োগ অবৈধ। তার পরও তিনি বেতন পাচ্ছেন। এ নিয়ে যাবতীয় দায়দায়িত্ব মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের। তবে অভিযোগ পেলে তদন্ত করে আইনত ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের রাজশাহী অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক ড. শরমিন ফেরদৌস চৌধুরী বলেন, নিয়োগ নির্ভর করে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও নিয়োগ কমিটির ওপর। পরে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এমপিওর জন্য কাজগপত্র দাখিল করেন। এ সংক্রান্ত যাবতীয় দায়দায়িত্ব তাদেরই। তিনি আরো বলেন, পরিপত্র অনুযায়ী ওই শিক্ষক সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবেই নিয়োগের অযোগ্য। তার সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে পরের অভিজ্ঞতা আমলে নেয়ার সুযোগ নেই। এমপিও স্থগিতসহ তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান তিনি।

এনআই

আরও পড়ুন