• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২০, ০৯:৩৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২০, ০৯:৩৪ পিএম

প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন

সাগরপথে রোহিঙ্গা পাচার : পুরনো ঘাট ও দালালরা নতুনভাবে সক্রিয়

সাগরপথে রোহিঙ্গা পাচার : পুরনো ঘাট ও দালালরা নতুনভাবে সক্রিয়
সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় ট্রলারডুবির পর উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা - ছবি : জাগরণ

প্রায় প্রতি রাতে বঙ্গোপসাগরের কোনো না কোনো পয়েন্ট দিয়ে মাছ ধরার ট্রলার বা বোট বোঝাই করে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে সাগরপথে  মানুষ পাঠানো হচ্ছে। কয়েক বছর আগে সাগরে অসংখ্য মানুষের সলিল সমাধি ও থাইল্যান্ডের জঙ্গলে নির্যাতনে গণকবরের সন্ধানে এ পথে বাংলাদেশিদের মালয়েশিয়া যাওয়া প্রায় বন্ধ রয়েছে। তবে রোহিঙ্গারা এ পথকে সহজ ভেবে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। এধরনের ঝুঁকিপূর্ণ পাচার প্রতিরোধে কাজ করা জাতিসংঘসহ ডজন খানেক দেশি-বিদেশি এনজিওর কর্মকাণ্ড নিয়ে বার বার প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। 

নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সময় সমুদ্র শান্ত থাকে। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে উখিয়া, টেকনাফসহ কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূলবর্তী ঘাট ও দালালরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডে পাচারের শিকার অসংখ্য মানুষের গণকবরের সন্ধান মেলার পর কয়েক বছর অনেকটা নিষ্ক্রিয় ছিল সাগরপথে বাংলাদেশ থেকে মানব পাচার। উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অতি আগ্রহে সাগরপথে মানব পাচারের পুরনো ঘাট ও দালালরা নতুনভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। 

ট্রলারডুবিতে নিহতদের লাশ   - ছবি জাগরণ

বর্তমানে স্থানীয় বাসিন্দারা সাগরপথে ঝুঁকি নিয়ে আর মালয়েশিয়া যেতে চায় না। তাই মানব পাচারে জড়িত দালালরা এবার টার্গেট করেছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের। সর্বশেষ মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) টেকনাফ উপকূলীয় ইউনিয়ন সেন্টমার্টিনস দ্বীপের অদূরে দক্ষিণে ছেড়াদ্বীপে রোহিঙ্গা বোঝাই একটি মালয়েশিয়াগামী ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটে। এতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড সদস্যরা অভিযান চালিয়ে ৭৩ জনকে জীবিত ও ১৫ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে। নিহতদের মধ্যে ১২ জন রোহিঙ্গা নারী, বাকি ৩টি লাশ শিশুদের। ৪০ জনের মতো এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। উদ্ধার তৎপরতা চলমান রয়েছে, ব্যবহৃত হচ্ছে হেলিকপ্টার। 

সোমবার রাতে টেকনাফ উপকূল দিয়ে ২৩০ জন যাত্রী নিয়ে দুটি ট্রলার মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা হয়। সকাল ৭টার দিকে সাগরের পাথরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে একটি ট্রলার ডুবে যায়, অন্যটির খোঁজ এখনো মেলেনি। উদ্ধারকৃত রোহিঙ্গাদের মধ্য বেশিরভাগ নারী ও শিশু। জিজ্ঞাসাবাদে উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা দালালদের খপ্পরে পড়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিচ্ছে বলে স্বীকার করেছেন। তবে প্রায় সবাই নিজেদের উদ্যেগে দালালদের মাধ্যমে চরম ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে বাংলাদেশের আশ্রয় ক্যাম্পগুলো থেকে মালয়েশিয়া যাচ্ছিল বলে জানান। 

গত ১৫ ডিসেম্বর মিয়ানমার নৌবাহিনী গভীর সমুদ্র এলাকা থেকে ক্রুসহ ১৮১ জনকে আটক করে। আটককৃতরা বাংলাদেশের আশ্রয়ক্যাম্প থেকে ঝুঁকিপূর্ণ পন্হায় মালয়েশিয়া যাচ্ছিল বলে জানা গেছে। আটক রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৮২ জন পুরুষ, ৬৯ জন মহিলা, ১৪ জন বালক, ৯ বালিকা ও ৭ ক্রু।

সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় ট্রলারডুবির পর উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা    - ছবি : জাগরণ

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রমতে, গত ৭ বছরে ২ হাজার ৭৩৫ বাংলাদেশি সাগরপথে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে নিহত হয়েছেন। ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া থাইল্যান্ড ও মধ্যপ্রাচ্যরে বিভিন্ন কারাগারে আটকা পড়ে আাছে ১০ হাজারের বেশি। তাদের মধ্য ৬ হাজার ৩৭০ জনই শিশু ও নারী। 

সাগর শান্ত থাকায় দালালরা নৌকায় করে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে- এমন আশঙ্কায় তা প্রতিরোধ করার জন্য স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উপকুলীয় এলাকাগুলোয় নজরদারি বাড়িয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অতি আগ্রহে টার্গেট করেছে পাচারকারী দালাল চক্রের সদস্যরা। তারা প্রতিটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সক্রিয় রয়েছে। এর আগেও একাধিক সময় টেকনাফ উপকূল দিয়ে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার চলেছে। তবে সেসময় রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয় বাংলাদেশির সংখ্যাও ছিল চোখে পড়ার মতো। 

উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গা নারী সানজিদা বেগম বলেন, মালয়েশিয়ায় আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। দুই পরিবার মিলে আমাকে স্বামীর কাছে পাঠানোর জন্য ট্রলারে তুলে দিয়েছেন। আমাকে বলা হয়েছিল জাহাজে করে নেয়া হবে, কিন্তু এখানে এসে দেখি ঝুঁকিপূর্ণ কাঠের ট্রলারে করে পাঠানো হচ্ছে।

তথ্যসূত্রে দেখা যায়, গত কয়েক মাসের মধ্যে সাগরপথে ট্রলারে চেপে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় এ পর্যন্ত প্রায় ৯শ জনকে উদ্ধার করেছে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তারা সবাই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা। রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে তথ্য নিয়ে জানা যায়, সাগরপথে মালয়েশিয়াগামী রোহিঙ্গাদের মধ্যে সুন্দরী নারীর সংখ্যা বেশি। মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত রোহিঙ্গা যুবকদের সঙ্গে বিয়ে দিতে দালালরা সুন্দরী নারীদের টার্গেট করে বিভিন্ন প্রলোভনের মাধ্যমে সেদেশে পাচার করছে। 

সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় ট্রলারডুবির পর রোহিঙ্গাদের উদ্ধার কার্যক্রম - ছবি : জাগরণ

এছাড়া অনেক বিবাহিত নারীও তাদের শিশু সন্তানসহ সেখানে স্বামীর কাছে যাওয়ার জন্য দালালদের কাছে ধর্না দিচ্ছেন। উখিয়ার তাজনিমার খোলা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা আবদুল নবী বলেন, আগে স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় অনেক রোহিঙ্গা পাসপোর্ট তৈরি করে বাংলাদেশি সেজে আকাশপথে মালয়েশিয়াসহ মধ্যপাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি রোহিঙ্গারা যেন কোনো পাসপোর্ট করতে না পারে সে বিষয়ে সরকারের কঠোর নজরদারি রয়েছে। ফলে অবৈধ ভাবে সাগরপথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়া যেতে রাজি হচ্ছে তারা।

তিনি আরো বলেন, প্রতিটি ক্যাম্পে মালয়েশিয়া পাচারকারী দালাল চক্রের সদস্যরা ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। দালালরা প্রথমে কম টাকার বিনিময়ে মালয়েশিয়া পৌঁছে দেয়ার কথা বললেও পরে মাঝপথে গিয়ে স্বজনদের কাছে পৌঁছানোর আগে হাতিয়ে নেয় মোটা অংকের টাকা। এই টাকা দিতে ব্যর্থ হলে দালালরা বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের পথ বেছে নেয়। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসরত বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, সাগরপথে মালয়েশিয়ায় মানবপাচারে সক্রিয়ভাবে জড়িত রোহিঙ্গা দালাল চক্র। তাদের সঙ্গে এই অপকর্মে স্থানীয় কিছু অর্থলোভী অসাধু ব্যক্তিও রয়েছে।

র‌্যাব-১৫ টেকনাফ শাখার কর্তব্যরত কোম্পানি কমান্ডার লে. মির্জা শাহেদ মাহতাব বলেন, মানব পাচারে জড়িত দালালরা পাচারের জন্য এবার নতুন করে টার্গেট করেছে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদেরকে। এসব রোহিঙ্গা দালালেরা সাগরপথে মানব পাচারের অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই অপতৎপরতা রোধ করতে এবং পাচারকারী দালালদের আইনের আওতায় আনতে র‌্যাবের নজরদারি আরো বাড়ানো হয়েছে।

সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় ট্রলারডুবির পর উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা    - ছবি : জাগরণ

টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আলম বলেন, বাংলাদেশ থেকে সাগরপথে মানব পাচার কমে এসেছিল। কিন্তু বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যে যেভাবে পারছে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি দিচ্ছে। 

উখিয়া সুজনের সভাপতি নুর মোহাম্মদ সিকদার বলেন, এতগুলো আশ্রিত রোহিঙ্গা, এদের সামলানো কঠিন। 

হেলপ কক্সবাজার এনজিওর চেয়ারম্যান এমএ কাসেম বলেন রোহিঙ্গাদের মাঝে যেসব এনজিও বা সংস্থা পাচার প্রতিরোধে কাজ করছে তারা কোনোভাবে এর দায় এড়াতে পারে না। কারণ এ ব্যাপারে ব্যয় করা হচ্ছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এর পরও সাগরপথে মানব পাচার কমছে না, বরং বেড়েই চলেছে। 

উখিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে মানব পাচারের বদনাম থেকে বাংলাদেশ বের হতে পারছে না। তিনি বলেন, জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএমসহ অন্তত ডজনের বেশি দেশি-বিদেশি সেবা ও সাহায্য সংস্থা রোহিঙ্গাদের পাচার প্রতিরোধে কাজ করছে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের পাচারে অনেক এনজিও কর্মী জড়িয়ে পড়ছে। মানব পাচার প্রতিরোধে গত দুই বছরে কয়েক কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। যা কোনো কাজে আসছে বলে মনে হয় না। এসব কর্মকাণ্ড নিয়ে লোকজন সন্দিহান, এগুলো লোক দেখানো। 

এফসি