• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২০, ০৮:৩৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২০, ০৮:৩৪ পিএম

আল্লামা শাহ আহমদ শফীর ১০৪ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনের ইতি

আল্লামা শাহ আহমদ শফীর ১০৪ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনের ইতি

হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী মারা গেছেন। শুক্রবার(১৮ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় তিনি পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় আজগর আলী হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।  

শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় আইসিইউতে থাকা আল্লামা শফীকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে আজ শুক্রবার সন্ধ্যার আগে ঢাকায় এনে আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন।

এর আগে, আজ শুক্রবার দুপুরে তার শারীরিক অবস্থা অবনতি হলে বিকেলে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে ঢাকায় নেয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।  

জানা যায়, হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে বৃহস্পতিবার দুপুরে অসুস্থ হয়ে পড়েন আল্লামা শফী। রাতে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

সকালে হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মেডিকেল বোর্ডে বসেন। দেশের শীর্ষ এ আলেমের অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। বিকালে তাকে ঢাকার আজগর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

দেশের শীর্ষ কওমী আলেম আল্লামা আহমদ শফীর শরীরের বাসা বেঁধেছিল নানা রোগ। ১০৪ বছর বয়সী এ প্রবীণ আলেম ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। ফলে প্রায় ওনাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হত। গত কয়েক মাসে শরীরে নানা জটিলতা দেখা দিলে একাধিকবার চট্টগ্রাম ও ঢাকার হাসপাতালে কয়েকদিন চিকিৎসা নিতে হয় বড় হুজুরখ্যাত আল্লামা শফীকে।

শাহ আহমদ শফী (যিনি আল্লামা শাহ আহমদ শফী নামেও পরিচিত) একজন বাংলাদেশি ইসলামি ব্যক্তিত্ব, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত আমির ছিলেন। তিনি একইসঙ্গে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এবং দারুল উলুম মুঈনুল ইসলামের হাটহাজারীর মহাপরিচালক ছিলেন।

আল্লামা শাহ আহমদ শফীর পরিচয়:
আল্লামা আহমদ শফী ১৯১৭ সালে (১৩৫১ হিজরী সন) বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানাধীন পাখিয়ারটিলা নামক গ্রামে এক অভিজাত সম্ভ্রান্ত ও ঐতিহ্যবাহী দীনদার আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম বরকত আলী। মাতা মরহুমা মুসাম্মাৎ মেহেরুন্নেছা বেগম।

শিক্ষাজীবন:
পিতা-মাতা দু'জনই শিশুকালেই তাকে কোরআন শিক্ষার জন্য মৌলভী আজিজুর রহমানের কাছে প্রেরণ করেন। কোরআর শিক্ষার ফাঁকে ফাঁকে নিয়মিত চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত মাতৃভাষাও শিক্ষা দান করেন। এরপর তিনি শরফভাটা মাদরাসায় প্রাথমিক কিতাব পাঠে মনোনিবেশ করেন। ছোটবেলা থেকেই আহমদ শফী অত্যন্ত নম্র, ভদ্র, বিনয়ী, চিন্তাশীল, প্রখর মেধাবী ও সুবুদ্ধির অধিকারী ছিলেন। যার কারণে অতি অল্প বয়সেই কোরআনের তিলাওয়াত ও প্রাথমিক শিক্ষা-দীক্ষা সাফল্যের সঙ্গে সমাপ্ত করে কৃতিত্ব অর্জন করতে সক্ষম হন।

এরপর তিনি ভর্তি হন চট্টগ্রামস্থ ঐতিহ্যবাহী আল জামিয়াতুল আরাবিয়া ইসলামিয়া জিরি মাদরাসায়। সেখানে তিনি ৫ মাস অধ্যয়ন করেন। এরপর তিনি ১৩৬১ হিজরীতে হাফেজ ইমতিয়াজের প্রচেষ্টায় এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম মুঈনুল ইসলামে ভর্তি হন। তখন তার বয়স মাত্র ১০ বছর। হাটহাজারী মাদরাসায় শিক্ষা গ্রহণ করার পর উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের অদম্য বাসনা নিয়ে ১৩৭১ হিজরী সনে ছুটে যান ইসলামী শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র, ঐতিহ্যবাহী হাদীস শিক্ষার পাদপীঠ, এশিয়া মহাদেশের শ্রেষ্ঠতম দীনি বিদ্যানিকেতন দারুল উলূম দেওবন্দে। 

দেওবন্দ মাদরাসার পড়াশুনা শেষে আল্লামা মাদানির প্রতিনিধি হয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসেন আহমদ শফী এবং চট্টগ্রামে আল-জামিয়াতুল আহ লিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলামে শিক্ষক হিসেবে তিনি নিযুক্ত হন। এরপর ১৪০৭ হিজরিতে মহাপরিচালকের দায়িত্ব লাভ করেন। হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালকের পাশাপাশি শায়খুল হাদিসের দায়িত্বও পালন।

স্বীকৃতিসমূহ:
আল্লামা আহমদ শফী পবিত্র কাবা শরীফের গিলাফের একটি অংশ উপহার পেয়েছিলেন। এ উপহার ছাড়াও তিনি অসংখ্য স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০১ সালের ১১ আগস্ট লন্ডন থেকে ফেরার পথে ওমরা পালনের জন্য সৌদি আরব গিয়েছিলেন। সেখানে হারামাইন শরীফের মহাপরিচালক শাইখ সালেহ বিন আল হুমাইদ তাকে পবিত্র কাবা শরীফের গিলাফের একটি অংশ উপহার দিয়েছিলেন। 

ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, লন্ডন, দুবাই, কাতার, বাহরাইন, কুয়েত, ওমান তথা মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা উপমহাদেশে আল্লামা আহমদ শফীর ইলম ও প্রজ্ঞার উৎস থেকে অনুপ্রেরণা লাভকারী ছাত্র, শিষ্য, মুরীদ ও অনুসারীর সংখ্যা বর্তমানে কোটির ঘর ছড়িয়ে গেছে। তার নম্রতা, খোদাভীরুতা, ইলম ও প্রাজ্ঞা দেখে পবিত্র হেরেম শরীফের ইমামগণ তাকে শায়েখ বলে সম্বোধন করে থাকেন।

আহমদ শফি রচিত গ্রন্থসমূহ:
দায়িত্ব ও কাজের পাশাপাশি লেখালেখিতেও রয়েছে তার বিশেষ অবদান। বাংলা ও উর্দূ ভাষায় তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৫টি। 

সেগুলো হলো- হক্ব ও বাতিলের চিরন্তন দ্বন্দ্ব, ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা, ইসলাম ও রাজনীতি, ইজহারে হাক্বীক্বত বা বাস্তব দৃষ্টিতে মওদূদী মতবাদ, তাকফীরে মুসলিম বা মুসলমানকে কাফির বলার পরিণাম, সত্যের দিকে করুণ আহ্বান, ধুমপান কি আশীর্বাদ না অভিশাপ, একটি সন্দেহের অবসান, একটি গুরুত্বপূর্ণ ফতোয়া, তাবলীগ একটি অন্যতম জিহাদ, ইছমতে আম্বিয়া ও মিয়ারে হক্ব, সুন্নাত-বিদআতের সঠিক পরিচয়, বায়আতের হাক্বীক্বত, আল বয়ানুল ফাসিল বাইনাল হক্কে ওয়াল বাতিল, আল হুজাজুল ক্বাতিয়াহ্ লিদাফয়িন নাহ্জিল খাতেয়াহ, আল-খায়রুল কাসীর ফী উসূলীত্ তাফ্সীর, ইসলাম ওয়া ছিয়াছত, ইজহারে হাক্বীক্বত, তাকফীরে মুসলিম, চান্দ রাওয়েজাঁ, ফয়ূজাতে আহমদিয়া, বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ফয়জুল জারী এবং মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রমুখ। এছাড়াও উর্দু ও বাংলা ভাষায় তার আরো অনেকগুলো মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।


জাগরণ/এমইউ