• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ০৭ মে, ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১, ২০২১, ১০:২৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ২, ২০২১, ০৫:১০ পিএম

মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থান

স্টেট কাউন্সেলর সু চির ভবিষ্যৎ

স্টেট কাউন্সেলর সু চির ভবিষ্যৎ

২০১০ সালের নভেম্বরের কোনো এক সন্ধ্যার কথা। দিনের আলো মিলিয়ে যাওয়ার আগেই বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাভিনিউ থেকে বেরিকেড সরিয়ে নেয় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। আন্দোলনকারীরা দৌড়ে চলে যান তাদের নেত্রীর বাড়ির কাছে। তাদের চোখে পানি, মুখে ছিল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের স্লোগান আর একটি নাম — অং সান সু চি।
 
১৯৮৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে দীর্ঘ ১৫ বছর গৃহবন্দী ছিল সু চি। সামরিক শাসনের অবসান ঘটাতে তাঁর শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক হয়ে দেখা দেয়। গৃহবন্দি অবস্থা থেকে সু চির এই মুক্তি বিশ্বজুড়ে স্বস্তির বার্তা বয়ে আনে। মিয়ানমারে গণতন্ত্রের সূর্য উঠেছে ভেবে তাকে স্বাগত জানান বিশ্বনেতারা। সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আপসহীন এক রাষ্ট্রনায়ক হয়ে উঠবেন তিনি এমনটাই আশা ছিল সবার।

এরপর ২০১৫ সালের নভেম্বরে ২৫ বছরের মধ্যে প্রথম কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় মিয়ানমারে। এতে তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিজয় অর্জন করে। তবে সন্তানেরা বিদেশি নাগরিক হওয়ায় সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি সু চি। কার্যত দেশটির রাষ্ট্রনেতা হলেও সরকারিভাবে তিনি ছিলেন ‘স্টেট কাউন্সিলর’। সামরিক বাহিনীর সঙ্গে চুক্তি ফলে ক্ষমতায় বসেও তাকে মূলত দুর্বলই থাকতে হয়েছে। নতুন সংবিধান অনুসারে,পার্লামেন্টের ২৫ শতাংশ আসন ও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো ছিল সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।

রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী গণহত্যায় লিপ্ত থাকলেও তাতে নিন্দা জানাতে সুচির অনিচ্ছা বা অপারগতা সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল। সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়, নারীদের ধর্ষণ করে এবং যারা পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে পারেনি, তাদের নির্বিচারে হত্যা করে। এহেন অবস্থায় মিয়ানমারের স্বাধীনতার নায়ক জেনারেল অং সানের এই কন্যা নীরব ভূমিকা রাখেন।

দেশের সবচেয়ে নিপীড়িত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়াতে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ তাকে আহ্বান জানান। কিন্তু তাদের সুরক্ষা দেয়ার বদলে কপটতার আশ্রয় নেন তিনি। প্রকৃত ঘটনা লুকানোর চেষ্টা করেন। রোহিঙ্গা গণহত্যার নিন্দা জানাতে অস্বীকারের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাইও গেয়েছেন। হেগ শহরের আন্তর্জাতিক আদালতে সুচি বলেন, “রাখাইনের পরিস্থিতি খুবই জটিল এবং যা ব্যাখ্যা করা সহজ না। আর গণহত্যার অভিযোগ পরিস্থিতির অসম্পূর্ণ ও বিভ্রান্তিমূলক বাস্তবতার চিত্র।”

অক্সফোর্ডপড়ুয়া সুচি সবসময়ই জাতীয়তাবাদী ছিলেন এবং আছেন। তার জাতি ধারণার পুরোটাই নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের সঙ্গে জড়িত। কেবল রোহিঙ্গারাই না—মিয়ানমারের বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর দুর্দশা ছিল তার বোধগম্যের বাইরে ছিল না। সুচি দেশটির সবচেয়ে বড় জাতীয়তাবাদী নায়কের কন্যা। তার ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক দর্শনের মূলও সেখানে। গৃহবন্দি থাকাকালে ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় তাকে। কিন্তু রোহিঙ্গা সংকটে তার অবস্থান বিশ্বের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতাকে করছে প্রশ্নবিদ্ধ। যদিও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার খ্যাতির সঙ্গে ‘কু’ বিশেষণ যুক্ত হলেও মিয়ানমারের নাগরিকদের কাছে তিনি এখনো আদরণীয়।

সোমবার ভোরে সেনা অভ্যুত্থানে ফের ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দি হলেন নোবেলজয়ী সু চি। মিয়ানমারের নাগরিকদের কাছে যা নিপীড়ন ও ‘কালো অধ্যায়ের’ প্রত্যাবর্তন বলেই মনে হবে। সেনাবাহিনীর ঘোষণা অনুসারে অন্তত বছরখানেক ক্ষমতা তাদের হাতে থাকবে। এতে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পাল্টা প্রতিক্রিয়া আসতে পারে বলে মনে করেন রাজনীতি বিশ্লেষক ডেভিড মশাথিসন। তার মতে, “বিপুল সংখ্যক মানুষ নিষ্ক্রিয় থাকবে বলে সেনাবাহিনীর মনে করার সুযোগ নেই। তার গৃহবন্দিত্ব থাকাকালে একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে, আর তার মুক্ত অবস্থায় আরেকটি তরুণ প্রজন্ম এসেছে এবং তারা মনেপ্রাণে সুচিকে সমর্থন করছেন। আর সুচি কিংবা তার দলের পক্ষে দাঁড়াতে পারবেন না নৃতাত্ত্বিক প্রদেশগুলোর বহু মানুষ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারাও সামরিক বাহিনীকে ঘৃণা করেন।”

এমন পরিস্থিতিতে সু চির এই বন্দীদশা দেশকে নতুন বিপ্লবের দিকে ঠেলে দিতে পারে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

তথ্যসূত্র: গার্ডিয়ান ও বিবিসি