• ঢাকা
  • শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ১৪, ২০২২, ১১:১৪ এএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ১৪, ২০২২, ১১:১৪ এএম

কুষ্টিয়ার বসছে সাধুদের হাট

কুষ্টিয়ার বসছে সাধুদের হাট

মো: আব্দুল কুদ্দুস
ছেঁউড়িয়ায় লালন আখড়ায় বসছে সাধুদের হাট। করোনার কারণে দুই বছর বন্ধ থাকার পর এবার শুরু হচ্ছে লালন স্মরণোৎসব। মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) থেকে তিন দিনের এই উৎসব শুরু হওয়র কথা কিন্তু তার আগেই কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালন শাইজির আখড়া বাড়িতে জড়ো হয়েছেন ভক্ত-অনুসারীরা। 

উৎসবের মাধ্যমে লালনের জাতপাতহীন মানবতাবাদি অহিংস দর্শনের প্রচার বাড়লে দেশে দেশে সংঘাত কমে যাবে বলে মনে করছেন সাঁইজির অনুসারিরা। প্রায় ২০০ বছর আগে বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই দোল পূর্ণিমায় এই উৎসব করতেন।  

কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় তার আখড়া বাড়িরর রূপ বদলেছে কিন্তু আজও বদলায়নি সেই উৎসব। চলছে গানে গানে লালনের জাতপাতহীন মানবতাবাদি অহিংস দর্শনের প্রচার। উৎসব শুরুর আগে চলে এসেছেন সাধু ফকিররা। তারা আসন গেড়ে বসেছেন। উৎসবে আসতে পেরে আগত সবাই খুশি। করোনার কারণে সরকারি নিষেধাজ্ঞায় ২০২০ সালের পরে টানা দুই বছর কুষ্টিয়ায় ছেঁউড়িয়ায় বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ্ আখড়াবাড়িতে লালন স্মরণোৎসব ও লালন তিরোধান দিবসে সব উৎসব বন্ধ ছিল। মহামারির সংকট কাটিয়ে আবারও দোলপূর্ণিমা উপলক্ষ্যে লালন স্মরণোৎসবে দেশ বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসছে লালন অনুরাগিরা তাদের সাঁইজির চরনধুলি নিতে বারামখানায়।

এবারে সাংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় তিন দিনের লালন স্মরণোৎসবের আয়োজন করেছে কুষ্টিয়ার লালন একাডেমি। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ্ এর এই আধ্যাত্মিক বাণীর স্লোগানে মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়ে এ উৎসব চলবে বৃহস্পতিবার (১৭ মার্চ) পর্যন্ত। বাউল সম্রাট লালন শাহ্ তার জীবদ্দশায় ছেঁউড়িয়ার এই আখড়াবাড়িতে প্রতি বছর চৈত্রের দোল পূর্ণিমা রাতে বাউলদের নিয়ে সাধুসঙ্গ উৎসব করতেন। 

১২৯৭ বঙ্গাব্দের পহেলা কার্তিক তার মৃত্যুর পরও এ উৎসব চালিয়ে আসছেন তার অনুসারীরা। এবার সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় লালন একাডেমি তিন দিনের এ লালন স্মরনোৎসবের আয়োজন করেছে। ইতোমধ্যে এ উৎসবকে ঘিরে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার কালী নদীর তীরে লালন আখড়াবাড়িতে চলছে উৎসব ও গ্রামীণ মেলার প্রস্তুতি। সেইসঙ্গে দুই বছর পরে সাধু ভক্তরা লালন মাজারে আসতে পারবেন বলে খুশি তারা।

তিন দিনের এ আয়োজনে সাধুদের আনুষ্ঠানিকতার বাইরে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে আয়োজকরা।

উদ্বোধনী দিন থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬ টা ৪৫ মিনিট থেকে লালন মুক্তমঞ্চে আলোচনা সভা এবং পরে বাউল গানের আয়োজন করা হয়েছে। প্রথম দিনের আলোচনা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন খুলনার বিভাগীয় কমিশনার মো. ইসমাইল হোসেন, এনডিসি। বুধবার (১৬ মার্চ) দ্বিতীয় দিনের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রণালনের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ।
বৃহস্পতিবার (১৭ মার্চ) শেষ দিনের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য মাহাবুব উল আলম হানিফ। তিন দিনের আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করবেন।

সাঁইজির আখড়ায় আসা রহিম ফকির নামে এক সাধু বলেন, মহামারী করোনার জন্য দুই বছর লালন উৎসব হয়নি। মনে খুব কষ্ট ছিল। এবার আসতে পেরে খুব ভালো লাগছে। সাঁইজির জয় হয়েছে।

কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও লালন একাডেমির সভাপতি মো. সাইদুল ইসলাম। সেই সঙ্গে উৎসব চলাকালীন সময়ে প্রতিদিন আলোচনা সভা শেষে দেশ বরেণ্য লালন গানের শিল্পী, লালন একাডেমির শিল্পীসহ গুণী সংগীত শিল্পীরা গান পরিবেশন করবেন বলে জানা গেছে।

কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক সাইদুল ইসলাম জানান, তিন দিনব্যাপী এ লালন স্মরণোৎসবকে ঘিরে ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব, সাদা পোশাকে জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্বে থাকবেন।

কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামের এই আখড়াবাড়িই ছিল বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ্ এর প্রধান অবস্থান এবং এখানেই তিনি জীবনের শেষ প্রয়াণ নেন। তবে বর্তমান সেখানে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে লালন একাডেমি। এখানে লালন সমাধীস্থলকে স্মরণীয় করতে ১৯৬২ সালে একটি সমাধী সৌধ নির্মিত হয়েছে। ভক্ত, আশেকান, অনুসারী ও শিষ্যদের মতে, লালন তরুণ বয়সে রোগাক্রান্ত ও অচেতন অবস্থায় ছেঁউড়িয়া গ্রামের কালী গঙ্গার পূর্বপাশের তীরে পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় মলম ফকিরের স্ত্রী মতিজান গ্রামের অন্যদের সাহায্যে সেখান থেকে উদ্ধার করেন। বাড়িতে এনে অসুস্থ লালনকে সেবা যত্ন করে সুস্থ করে তোলেন। এভাবে সান্নিধ্য লাভের মধ্য দিয়ে মতিজানের স্বামী মলম কবিরাজ নিজেও লালন সাঁইয়ের অনুসারী হয়ে উঠেন। লালনের গুরু সিরাজ সাঁইয়ের কাছে দীক্ষা লাভ এবং লালনের কণ্ঠে নানান আধ্যাত্বিক কথা শুনে মলম কবিরাজ, স্ত্রী মতিজানসহ আশপাশের প্রতিবেশীরাও অনুরক্ত হয়ে উঠেন। 
এই সময়ই লালন কোথাকার কে, কার সন্তান, কোথায় তার জন্ম, কী তার পরিচয় এ নিয়ে শুরু হয় জল্পনা-কল্পনা। তবে এসব প্রশ্নের জবাবে লালন ছিলেন নিশ্চুপ। এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও লালন গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে অনীহা প্রকাশ করেন। পরে সিরাজ সাঁইয়ের কাছে দীক্ষা লাভের পর মলম কবিরাজ তার ভূসম্পত্তির একটা অংশ লালনকে লিখে দেন। একই সঙ্গে মলম কবিরাজের অনুরোধ ও গুরু সিরাজ সাঁইয়ের নির্দেশক্রমে লালন এই ছেঁউড়িয়া গ্রামে নির্মিত কুঁড়ে ঘরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন যা আজকের ছেঁউড়িয়া আখড়াবাড়ি নামে পরিচিতি পেয়েছে দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বময়। 

লালনের জীবদ্দশায় এক বিধবা নারীকে আশ্রয় দিয়েছিলেন আখড়াবাড়িতে যিনি পরে লালনের স্ত্রী রূপে এবং বিশাখা নামে পরিচিতি পান। লালন ফকির প্রতি বছর শীতকালে মহোৎসব করতেন এবং সে উৎসবে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভক্ত আশেকান সাধু বাউল ফকিররা মিলিত হতো। ওই উৎসবকে ঘিরে সেখানে বাউল গানের আসর হতো এবং লালন ও তার স্ত্রী পরিচয়ধারী বিশাখাও সেই জলসায় অংশ নিতেন। সেখানে সব গানই মূলত লালন নিজেই রচনা ও সুর সংযোজন করতেন যা পরে তার শিষ্য-অনুসারীরা রপ্ত করতেন। 

লালনের জন্ম সংক্রান্ত তথ্যানুযায়ী সঠিক সময়কাল শনাক্তকরণ সম্ভব না হওয়ায় তিনি জীবদ্দশায় প্রকৃত অর্থে কত বছর বেঁচে ছিলেন তার নির্ণয় করা যায়নি। তবে তিনি যে একজন দীর্ঘায়ু ব্যক্তি হিসেবে বেঁচে ছিলেন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই বলে শিষ্য-অনুসারীদের ধারণা। 

তৎকালীন সময়ে শিলাইদহের জমিদার জ্যেতিরিন্দ্রনাথ ২৩ বৈশাখ ১২৯৬ বাংলা, ৫ মে ১৮৮৯ সালে পঞ্চবোটে রবীন্দ্রনাথসহ পরিবারের অন্যদের সামনে চেয়ারে বসিয়ে লালন ফকিরের একটি স্কেচ তৈরি করেন। স্কেচটি রবীন্দ্র ভারতী সোসাইটিতে রক্ষিত আছে এখনও। তার একটি ফটোকপি ও শিল্পী সহিদ হোসেন কর্তৃক উক্ত স্কেচের একটি নকল লালন একাডেমিতেও রক্ষিত আছে। আচার্য নন্দলাল বসু কর্তৃক লালন ফকিরের স্কেচটি শ্রী শচীন্দ্রনাথ অধিকারীর নির্দেশে কাল্পনিকভাবে অংকিত হয়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্কেচটি অংকনের এক বছর পর ১২৯৭ সালের ১ কার্তিক, ইংরেজী ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন লালন ফকির। 

তৎকালীন কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত হিতকারী নামক পাক্ষিক পত্রিকায় লালন ফকিরের তিরোধানের ওপর রচিত সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। ওই সম্পাদকীয় লেখার বিবরণানুযায়ী মৃত্যুকালে লালনের বয়স হয়েছিল ১১৬ বছর। লালন ফকির মৃত্যুকালের এক মাস আগে থেকে পেটের অসুখে পড়েন এবং হাতপায়ের গ্রন্থি জলস্ফীত হয়। পীড়িত অবস্থায় দুধ ছাড়া অন্য কিছু খান নাই। তবে মাঝে মধ্যে কিঞ্চিত মাছ খেতে পছন্দ করতেন। 

লালন ফকির মৃত্যুর পূর্ব রাতেও ভক্ত শিষ্যদের সঙ্গে গান করেছেন এবং ভোর ৫টার দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। লালন শাহ্ এর ইচ্ছা ও পূর্ব নির্ধারিত ঘরেই তাকে সমাধি করা হয়। মৃত্যুকালে তার কাছে প্রায় ২ হাজার টাকা ছিল। ছেঁউড়িয়াতে তার সমাধির পশ্চিম পাশে মলম সাহের স্ত্রী মতিজানেরও সমাধি রয়েছে। লালন শাহ্’র স্ত্রী বিশাখার মৃত্যুর পর লালন শাহ্ এর সমাধীর দক্ষিণ পাশে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। 

জাগরণ/আরকে