• ঢাকা
  • শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৯, ০৯:১৮ এএম

চিকিৎসকদের মনগড়া নিয়মে চলছে শেবাচিম হাসপাতাল

চিকিৎসকদের মনগড়া নিয়মে চলছে শেবাচিম হাসপাতাল

 

প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা ও দুদকের অভিযানের কারণে পাল্টে যাচ্ছে দেশের অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালের চিত্র। রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে শৃঙ্খলা ও কর্মস্থলে উপস্থিতি বাড়তে শুরু করেছে হাসপাতাল গুলোতে। তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরেও পূর্বের অবস্থানেই রয়ে গেছে দক্ষিণাঞ্চলের একমাত্র নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতাল।

এখনো চিকিৎসকদের মনগড়া নিয়মেই চলছে এই হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম। সঠিক সময়ে কর্মস্থলে না আসা, দায়িত্ব ফাঁকি দিয়ে ব্যক্তিগত চেম্বার ও ক্লিনিকে রোগী দেখাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে বৃহত্তর শেবাচিম হাসপাতালের চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে।

বিশেষ করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পর্যায়ের জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। মিড লেভেলের চিকিৎসকরা ফাঁকিবাজির মাধ্যমে চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করলেও জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের খুঁজে পাওয়াটা দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে হাসপাতালের অপরেশন থিয়েটারে অস্ত্রপচারের অপেক্ষায় থাকা রোগীর লাইন দীর্ঘ হচ্ছে।

সূত্রমতে, এশিয়া মহাদেশের মধ্যে আয়োতনে সর্ববৃহৎ ও দক্ষিণাঞ্চলের প্রাচীনতম নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এই হাসপাতালে শুধুমাত্র বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলার মানুসই নয়, চিকিৎসা সেবা নিতে আসছেন পার্শ্ববর্তী মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জের রোগীরাও আসছে।

আর তাই হাসপাতালটিতে রোগীর সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও বাড়ছে না চিকিৎসা সেবার মান। বহির্বিভাগ থেকে ওয়ার্ড গুলোতে রোগীদের চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির কারণে চিকিৎসা সেবা ব্যহত হচ্ছে। বহির্বিভাগে যেন তেন ভাবে চিকিৎসা কার্যক্রম চললেও আন্তঃবিভাগে রোগীদের শেষ ভরসা ইন্টার্ন চিকিৎসক।

গত ২৮, ২৯ ৩০ জানুয়ারি ৩ দিন হাসপাতালের নিচ তলায় বিভিন্ন বহির্বিভাগ ঘুরে দেখা যায় চিকিৎসকের অধিকাংশ কক্ষই শূন্য। সামনে রোগীর দীর্ঘ লাইন থাকলেও নির্ধারিত সময়ে হাসপাতালে পৌছতে পারেনি চিকিৎসকরা। শুধুমাত্র শিশু বহির্বিভাগের চিত্র কিছুটা ভিন্ন।

বাকি মেডিসিন, সার্জারি, অর্থপেডিক্স, গাইনি, চর্ম-যৌন, ইএনটি, চক্ষু ও মানসিক রোগ বহির্বিভাগের কোন চিকিৎসকদের কেউ গত ৩দিনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কর্মস্থলে পৌছতে পারেননি। কর্মস্থলে পৌছতে তাদের এক থেকে দেড় ঘন্টা সময় লেগেছে।
 
এদিকে দেরি করে কর্মস্থলে এসে আবার ১২টা বাজতেই শুরু হয় গোল টেবিলে চা চক্র। টানা ৩০ মিনিট পরে কোন কোন চিকিৎসক চেম্বারে ফিরে দায় সারা ভাবে রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছেন। কোন কোন চিকিৎসক আবার বেরিয়ে পড়েন পারিবারিক কাজে। তাছাড়া দেড়টা বাজতেই রোগী দেখা বন্ধ করে শুরু হয় কোম্পানি বিভিজ। ১টা না বাজতেই বন্ধ হয়ে যায় হাসপাতালের টিকিট কাউন্টার। তাছাড়া হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসকদের বহিরাগত ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে কমিশন বাণিজ্যর অভিযোগ তো রয়েছেই।

এদিকে কোন প্রকার ছুটি ছাড়াই সোমবার (২৮ জানুয়ারি)  ও মঙ্গলবার (২৯ জানুয়ারি) কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন মেডিসিন বহির্বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা.রেজওয়ানুল আলম রায়হান। তবে মঙ্গলবার দুপুরে কর্মস্থলে আসলেও রোগী দেখেননি। বুধবার (৩০ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ৯টায় কর্মস্থলে দুপুর ১টা পর্যন্ত রোগী দেখেন তিনি। ২৮ ও ২৯ জানুয়ারি তার স্থলে রোগীর চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন একজন নারী ইন্টার্ন চিকিৎসক।

খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, ডা. রেজওয়ানুল আলম রায়হান সপ্তাহের ৩ থেকে ৪ দিন ভোলায় থাকেন। সেখানে ব্যক্তিগত চেম্বারে বসে রোগী দেখেন তিনি। এ কারণেই ২৮ ও ২৯ জানুয়ারি কর্মস্থলে আসতে পারেননি। তার অনুপস্থিতির বিষয়টি জানতে পেরে মঙ্গলবার (২৯ জানুয়ারি) দুপুরে ডা. রায়হানকে শোকজ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

বুধবার (৩০ জানুয়ারি) বেলা ১২টার দিকে হাসপাতালের মেডিসিন বহির্বিভাগে গিয়ে দেখা যায় দু’জন মেডিকেল অফিসারের কক্ষে তালা ঝুলানো। তারা হলেন ডা. নুরুন্নবী চৌধুরী তুহিন ও অপর জন গোলাম মোস্তফা কামাল। জানা যায়, মোস্তফা কামাল গত ৩ দিনই কর্মস্থলে নেই। তিনি ছুটিতে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন মেডিসিন বিভাগের অন্য একজন চিকিৎসক।

এদিকে শুধুমাত্র বহির্বিভাগই নয়, একই চিত্র হাসপাতালের ওয়ার্ড গুলোতেও। ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীদের সার্বক্ষণিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে চিকিৎসকদের ২৪ ঘন্টা উপস্থিতির কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। ওয়ার্ড গুলোতে সকাল ৯টার আগে কোন সিনিয়র চিকিৎসক কর্মস্থলে আসছেন না। আবার দুপুর ২টা বাজতেই সবাই দুপুরের খাবারের জন্য বেরিয়ে পড়ছেন। দিনে ডাক্তারের উপস্থিতি চোখে পড়লেও রাতে হাসপাতালের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। শুধুমাত্র ইন্টার্ন চিকিৎসক ছাড়া কোন সিনিয়র চিকিৎসকদের খুঁজে পাওয়া যায় না ।

সহকারী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পর্যায়ের চিকিৎসকরা বেশিরভাগই থাকেন ব্যক্তিগত চেম্বার নিয়ে ব্যস্ত। কর্মস্থলে হাজিরা দিয়েই তারা তাদের চেম্বারে ছুটছেন। এর ফলে কোন কোন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক আসছেন না ওয়ার্ড পরিদর্শনেও। আবার কোন কোন চিকিৎসক যাচ্ছেন না মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের ক্লাশ নেয়ার জন্যও।

হাসপাতালের টিকিট কাউন্টারের একজন ক্লার্ক নাম প্রকাশ না করে বলেন, স্যারেরা আমাদের বলেছেন দুপুর ১টার পর আর টিকিট বিক্রি না করতে। নির্দেশনা উপেক্ষা করে দু-একটি টিকিট বিক্রি করলে সে জন্য আমাদের ডেকে নিয়ে স্যারেরা গালি দেয়। পরিচালকও এ বিষয়টি জানেন।

চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি এবং দায়িত্ব অবহেলার প্রশ্নে শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. বাকির হোসেন দৈনিক জাগরণকে বলেন, যেভাবে দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ করা হচ্ছে আসলে বিষয়টি সেরকম নয়। আবার চিকিৎসকদের উপস্থিতি একেবারেই যে সন্তোষজনক তাও বলা যাবে না। দুই একজন হয়তো নিয়ম মানতে পারছেন না। আমরা তাদের নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি।

তিনি বলেন, খুব শিগগিরই আমরা শেবাচিম হাসপাতালে বায়োমেট্রিক হাজিরা কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছি। এটা চালু হলে চিকিৎসকদের উপস্থিতি শতভাগ নিশ্চিত করা যাবে জানিয়ে ডা. বাকির হোসেন বলেন, চিকিৎসকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার বিষয়টিতে আমরা পূর্বে থেকেই গুরুত্ব দিচ্ছি। এরইমধ্যে ৩ জন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। যারা কর্মস্থলে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করেননি। তাছাড়া সোমবার ডা. রেজওয়ানুল আলম রায়হান নামের যে চিকিৎসক কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন তাকেও শোকজ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।


এএস/