• ঢাকা
  • বুধবার, ০১ মে, ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৯, ০৯:১৬ পিএম

নানা সংকটেও ফেনীর মানুষকে সেবা দিচ্ছে ১৯ উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র

নানা সংকটেও ফেনীর মানুষকে সেবা দিচ্ছে ১৯ উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র

 

জনবল ও ভবন সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতা থাকার পরে জেলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছে ফেনী জেলার ১৯টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র। যদিও এসব স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পদ থাকলেও অধিকাংশ কেন্দ্রে কোনো এমবিবিএস চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট, পিয়ন অথবা আয়া নেই। তারপরও গ্রামীণ জনপদের মানুষের ভরসাস্থল এসব স্বাস্থ্য কেন্দ্র।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলা উপকেন্দ্রগুলোতে প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত সব বয়সের রোগীকে বিভিন্ন রকমের স্বাস্থ্য সেবা দেয়া হয়। এর মধ্যে বিনামূল্যে মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা, পরিবার পরিকল্পনা, প্রজনন, স্বাস্থ্য, পুষ্টি সেবা, রক্ত, মলমুত্র ও কফ পরীক্ষারসহ সাধারণ অপারেশন করা হয়। তাছাড়া বিনামূল্যে শিশুদের বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক টিকা দেয়া হয়। সরবরাহ সাপেক্ষে বিনামূল্যে ওষুধও বিতরণ করা হয়। কোনো কোনো রোগীকে উন্নত সেবার জন্য আধুনিক সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়।

স্বাস্থ্যকেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, এসব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে একজন এমবিবিএস চিকিৎসক, একজন ফার্মাসিস্ট, একজন মেডিকেল এ্যাসিস্টেন্ট ও একজন আয়া থাকার কথা। কিন্তু জেলার ১৯টি উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মধ্যে শর্শদী ও কালীদহ ইউনিয়নের স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছাড়া ১৭টি কেন্দ্রে এমবিবিএস চিকিৎসক কর্মরত নেই। এসব কেন্দ্রে ডিপ্লোমাধারী এ্যাসিস্টেন্ট মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো) দিয়েই সেবা দেয়া হচ্ছে। একইভাবে ফাজিলপুর কেন্দ্র ছাড়া অন্য কোনো কেন্দ্রে ফার্মাসিস্ট থাকার কথা থাকলেও জেলাজুড়ে একজন কর্মরত আছেন। বাকি ১৮টিতে কোন ফার্মাসিস্ট নেই। জেলার কোনো কেন্দ্রে পিয়ন অথবা আয়া না থাকায় সব সময় কেন্দ্রগুলো অপরিচ্ছন্ন থাকে। অনেক কেন্দ্রে আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই। অনেক কেন্দ্রে স্থায়ী বিদ্যুৎ সংযোগ ও পানির ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ও রোগীদের চাহিদা অনুযায়ী ওষুধ নেই। এতো সংকটের পরও প্রান্তিক জনপদে সাধ্যের মধ্যে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন কেন্দ্রগুলোতে কর্মরত মেডিকেল এ্যাসিস্টেন্টরা।

সরেজমিনে সোনাগাজী উপজেলার মতিগঞ্জ উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, পরিত্যক্ত, অস্বাস্থ্যকর ও ঝুকিপূর্ণ একটি ভূতুড়ে ভবনে আগত রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সকাল থেকে বেশ কয়েকজন চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজন গর্ভবতী মা’কে প্রয়োজনীয় পরার্মশসহ আয়রন-ক্যালসিয়াম ওষুধ দেয়া হয়েছে। দুবছর বয়সী শিশুর জন্য ডায়রিয়ার ওষুধ দেয়া হয়েছে। একজন নারীকে জন্ম নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ১৯৩১ সালে তৎকালীন ইউনিয়ন পরিষদের কাউন্সিলের দেয়া একটি ঘরে মতিগঞ্জ ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সেবা দেওয়ার কাজ শুরু হয়। এখানে কয়েক বছর থাকার পর ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কেন্দ্রটি আশ্রয়ণ কেন্দ্রে নেওয়া হয়। পরে ওই ভবন ধসে পড়লে ১৯৯৫ সালে উপজেলা পরিষদের পরিত্যক্ত ভবনে কেন্দ্রটি স্থানান্তরিত করা হয়। প্রতিষ্ঠার ৮৮ বছর পার করলেও এখন পর্যন্ত নিজস্ব কোনো ভবন তৈরি করা হয়নি।

এখানে কর্মরত মেডিকেল এ্যাসিস্টেন্ট ছাদেকুল করিম আরাফাত জানান, কেন্দ্রটির নিজস্ব কোনো ভূমি নেই। ফলে সোনাগাজী উপজেলা পরিষদের ২০ বছর আগে পরিত্যক্ত একটি ভবনে উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রটির কাজ চলছে। এ ভবনে পানি, শৌচাগার ও বিদ্যুতের কোনো ব্যবস্থা নেই। দরজা জানালাগুলো অনেক আগেই ভেঙে গেছে। দেওয়াল ও ছাদের পলেস্তরা খসে পড়েছে। শেওলা জন্মেছে অনেক বছর আগেই। সামান্য বৃষ্টি হলেই দেওয়াল ছুয়ে পাড়ি পড়ে। যে কোনো সময়ে ভবনটি ধসে পড়তে পারে। তারপরেও এখানে প্রতিদিন শতাধিক গরিব রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হয়। তছাড়াও এ কেন্দ্রে কোনো এমবিবিএস চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট ও আয়া নেই। ফলে তিনি এ অফিসের ঝাড় দেয়া থেকে শুরু করে সব কাজই করেন।

এদিকে ছরছান্দিয়া কেন্দ্রের নিজস্ব জায়গা থাকলেও এখন পর্যন্ত ভবন নির্মাণের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে ২০ বছর আগে পরিত্যক্ত ঘোষিত ইউনিয়ন পরিষদের একটি কক্ষে সেবার কাজ চলছে। একইভাবে ভবন না থাকায় গোপাল উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রটি পরিচালিত হচ্ছে স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির একটি কক্ষ থেকে। শুধু মতিগঞ্জ ও চরছান্দিয়া ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র নয়, ফেনীর প্রায় সব উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের একই দশা। ১৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৭টিতে এমবিবিএস চিকিৎসক, ১৮টিতে ফার্মাসিস্ট ও ১৯টিতেই কোনো আয়া বা পিয়ন নেই। এতসব প্রতিকূলতার পরও প্রান্তিক মানুষরা এসব কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে আসেন।

ফেনী সদর উপজেলার ফাজিলপুর কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে আসা নাজমা আক্তার জানান, তিনি দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে এই উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বড় কোনো সমস্যা ছাড়া প্রায় সব সময়ই তিনি এ কেন্দ্র থেকে স্বাস্থ্য সেবা নেন। এক সময় মানুষের কাছে টাকা ছিল না। শহরে যাওয়ার রাস্তাও ছিল না। পর্যাপ্ত পরিবহনও ছিল না। তখন যে কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা হলে এসব কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে আসতেন। কর্মরত চিকিৎসকদেরও আন্তরিকতা রয়েছে।  এখন যাদের টাকা পয়সা আছে তারা এসব কেন্দ্রে আসেন না। তবে এখনও এ প্রতিষ্ঠানটি গ্রামের অসহায়-দরিদ্র জনগোষ্ঠির স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক চিকিৎসা, পরিবার পরিকল্পনা, প্রজনন ও নারী স্বাস্থ্য সেবার জন্য কেন্দ্রটি আশপাশের মানুষের কাছে ভরসার স্থল। তবে এ ভবনটি অনেই আগেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মজিবুল হক রিপন জানান, উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ভবন নির্মাণের জন্য টেন্ডার হয়েছে। দ্রুতই কাজ শুরু হবে।

জেলা সিভিল সার্জন হাসান শাহরিয়ার কবির জানান, গত ১৫ থেকে ২০ বছর যাবত ফার্মাসিস্ট, পিয়ন নিয়োগ বন্ধ। এখন পর্যন্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসক দেয়া যাচ্ছে না। কিছু জটিলতার কারণে কয়েকটি কেন্দ্রে ভবন নির্মাণের জন্য বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কোথায়ও ভবন নির্মাণের বরাদ্দ পাওয়া গেলেও ভূমি পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ৩৯তম বিসিএস সম্পন্ন হলে ফেনীতে চিকিৎসকদের সংকট কিছুটা কমবে বলে জানান তিনি। জেলার সব উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অবস্থা ও জনবল সংকটের কথা কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশনা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এসসি/