• ঢাকা
  • রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ৮, ২০১৯, ০৮:১৯ এএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ৮, ২০১৯, ০৩:৩১ পিএম

ক্যাসিনো আইনে আছে, তবে…

ক্যাসিনো আইনে আছে, তবে…

সম্প্রতি বিভিন্ন স্থানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান পরিচালনার পরিপ্রেক্ষিতে জুয়ার আইনি দিক নিয়ে চলছে নানা আলোচনা–সমালোচনা। তাদের কেউ ‘বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন অর্ডার ১৯৭২’ এ ক্যাসিনোকে বৈধতা দেয়া হয়েছে বলে দাবি করছেন। ১৯৭২ সালের ২৭ নভেম্বর জারি করা এই ‘প্রেসিডেন্ট অর্ডার নং ১৪৩’ এর মাধ্যমে দেশে পর্যটনের বিকাশ ঘটাতে ক্যাসিনোর আয়োজন করা যাবে বলে তারা মত দিয়েছেন।

রাষ্ট্রপতির ওই আদেশের ৫ (২) (i) এ বলা হয়েছে, ‘কোনো কুসংস্কার ছাড়াই পূর্বোক্ত বিধানটি পর্যটকদের বিনোদনের জন্য- হোটেল, রেস্তোরাঁ, রেস্ট হাউস, পিকনিক স্পট, ক্যাম্পিং সাইট, থিয়েটার, পার্ক, ক্যাসিনো, জল স্কিইং সরবরাহ ও পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখে।’

(‘Without prejudice to the generality of the foregoing provision, the Corporation shall, in particular, have power to acquire, establish, construct, arrange, provide and run hotels, restaurants, rest houses, picnic spots, camping sites, theatres, amusement parks, casinos and facilities for water skiing and entertainment for tourist;’)

তবে রাষ্ট্রপতির এই আদেশের ব্যাখ্যায় আইনজীবীদের অনেকে বলছেন, এতে ঢালাওভাবে ক্যাসিনোকে আইনি বৈধতা দেয়া হয়নি। পর্যটন কর্পোরেশনকে ক্যাসিনো স্থাপন ও পরিচালনার অনুমতি দেয়া হয়েছে। কাস্টমারের ক্যাসিনো খেলায় অংশগ্রহণের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। সুতরাং অন্য কোনো আইনে কাস্টমার কর্তৃক ক্যাসিনোতে অংশগ্রহণের বিষয়ে কিছু বলা থাকলে তা প্রযোজ্য হবে।

তা ছাড়া পর্যটন কর্পোরেশনের বাইরে কেউ ক্যাসিনো প্রতিষ্ঠা করলে বা পরিচালনা করলে সে বিষয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যাবে বলেও মত দিচ্ছেন অনেকে।

আবার কেউ বলছেন, শুধু বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য ক্যাসিনো স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়েছে এতে।

এদিকে আওয়ামী লীগ প্রায়ই দাবি করে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর তখনকার সরকার দেশে মদ-জুয়া নিষিদ্ধ করেছিল। কারণ ১৯৭২ সালের সংবিধানে জুয়া বন্ধের বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য রাষ্ট্রকে নির্দেশনা দেয়া আছে।

যদিও পরবর্তীকালে এ বিষয়ে আর নতুন কোনো আইন হয়নি, তাই এখনো কার্যকর রয়ে গেছে দেড়শ বছরের বেশি পুরনো একটি আইন।

এদিকে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বাংলাদেশে সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স বা পারমিট নিয়ে মদ বিক্রি ও পানের সুযোগ আছে।

বিভিন্ন ক্লাবে বা আড্ডায় গোপনে জুয়াখেলার অনেক আসর বসার কথা নানা সময়ে শোনা গেলেও একেবারে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও উপকরণসজ্জিত এই ক্যাসিনোগুলোর অস্তিত্ব থাকার খবর দেশের মানুষের কাছে বলা যায় নতুন। যদিও মদ বিক্রি বা পানের মতো ক্যাসিনোর অনুমোদন বা লাইসেন্স দেয়ার কোনো ব্যবস্থা বা সুযোগই বাংলাদেশের কোনো আইনে নেই।

জুয়ার বিষয়ে যে আইনটি কার্যকর আছে সেটি হলো ‘প্রকাশ্য জুয়া আইন ১৮৬৭’, সেখানে অবশ্য ক্যাসিনো বিষয়ে কিছু বলা নেই। তবে ওই আইনে - ‘কেউ তার ঘর, তাঁবু, কক্ষ, প্রাঙ্গণ বা প্রাচীরবেষ্টিত স্থানের মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী বা ব্যবহারকারী হিসাবে যেকোনো ব্যক্তি জ্ঞাতসারে বা স্বেচ্ছায় অন্য লোককে, উক্ত স্থানকে সাধারণ জুয়ার স্থান হিসাবে ব্যবহৃত করতে দিলে অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ডের বিধান’ রাখা হয়েছে।

এমনকি ‘তাস, পাশা, কাউন্টার অর্থ বা অন্য যেকোনো সরঞ্জামসহ যেকোনো ব্যক্তিকে ক্রীড়ারত বা উপস্থিত দেখতে পাওয়া গেলেও’ শাস্তি দেয়ার সুযোগ আছে এই আইনে।

ঢাকায় বছরের পর বছর ধরে প্রকাশ্যে দিবালোকে সবার নাকের ডগাতেই এসব চলেছে, কিন্তু অন্য অনেক বিষয়ের মতো এখানেও আইনের প্রয়োগ ছিল না।

জুয়া বন্ধে দেড়শ বছরেরও বেশি পুরনো আইনটি যুগোপযোগী করে সংশোধন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা। তারা বলছেন, জুয়া নিয়ে প্রচলিত আইনটিতে সাজা নামমাত্র। এছাড়া যে বিধিবিধান রয়েছে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা-ও চলে না। বলা চলে, আইনটি তার কার্যকারিতাই হারিয়েছে। তাই দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে আইনটির সংশোধন জরুরি।

জানা গেছে, সম্প্রতি ঢাকা মহানগরীসহ দেশের বিভিন্ন ক্লাবে অভিযান চালিয়ে বেশকিছু ক্যাসিনো সিলগালা ও অনেককে আটক করা হয়েছে। কিন্তু তাদের কারও বিরুদ্ধেই জুয়া খেলার অপরাধে মামলা হয়নি। সব মামলা হয়েছে মাদক, মানি লন্ডারিং ও অস্ত্র আইনে।

১৮৬৭ সালের প্রকাশ্য জুয়া আইনের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের প্রজারা যেসব এলাকায় বসবাস করে সেখানে প্রকাশ্যে জুয়ার জন্য শাস্তি প্রদানের এবং সাধারণ ক্রীড়াভবনের ব্যবস্থা করার জন্য একটি আইন।’ ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের শাসনাধীন এলাকায় প্রকাশ্য জুয়া খেলার অপরাধে শাস্তি এবং সাধারণ ক্রীড়াভবনের ব্যবস্থা করার জন্য আইনটি প্রণয়ন করা হয়।

আইনের ১ ধারায় জুয়ার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘ক্রীড়া’ শব্দ দ্বারা জুয়া বা বাজি ধরা বোঝাবে (কেবল ঘোড়া দৌঁড়ের জন্য ধরা বা জুয়া খেলা ব্যতীত)। খেলার কাজে ব্যবহৃত যেকোনো হাতিয়ার বা সামগ্রী ‘ক্রীড়াসামগ্রী’ শব্দের অন্তর্গত।

ধারা-৩ এ বলা আছে, ‘এ ধরনের জুয়া খেলা দণ্ডনীয় অপরাধ। যেকোনো ঘর, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনো সাহায্যকারী তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। এ রকম কোনো ঘরে তাস, পাশা, কাউন্টার বা যেকোনো সরঞ্জামসহ কোনো ব্যক্তিকে জুয়ারত বা উপস্থিত দেখতে পাওয়া গেলে তিনি এক মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ১০০ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

দেশে জুয়াবিরোধী একটি আইন থাকলেও রাজধানীতে সম্প্রতি বিভিন্ন ক্রীড়া-ক্লাবের জুয়ার আসর থেকে আটক শতাধিক ব্যক্তির কারও বিরুদ্ধেই ওই আইনের আওতায় ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

দেশে ‘পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট, ১৮৬৭’ নামের যে আইনটি রয়েছে সেটি রাজধানীতে প্রয়োগ করার সুযোগ নেই বলে মত দেন আইনজীবীদের অনেকে। এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা ছাড়া সমগ্র বাংলাদেশে এটি প্রযোজ্য হবে’। অন্যদিকে, ‘ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশ, ১৯৭৬’ এর ৯২ ধারায় প্রকাশ্যে জুয়া খেলার জন্য মাত্র ১০০ টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে।

এমএ / টিএফ

আরও পড়ুন