• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৫, ২০২০, ১০:৩৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ১৫, ২০২০, ১০:৪৪ পিএম

বিশেষ স্মৃতিচারণ

তোমার সৃষ্টিমাঝে তুমি অমর রবে

তোমার সৃষ্টিমাঝে তুমি অমর রবে
বাঁ থেকে - কাজের ফাঁকে একান্ত আলাপচারিতায় প্রয়াত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং লেখক তাপস কুমার দত্ত - দৈনিক জাগরণ
তাপস কুমার দত্ত

একটি বিশেষ দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের চরিত্রে যে-কাউকে দিয়ে তো অভিনয় করানো যায় না। ‘অনুপ্রবেশ’ সিনেমা নির্মাণ করতে গিয়ে আমার প্রথমেই মনে হয়েছিল— এ চরিত্রের সবচেয়ে উপযোগী অভিনেতা হলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু সৌমিত্র তো আকাশের চাঁদ। আর আমি হলাম অতি সাধারণ নবীন এক চিত্রপরিচালক। তাও প্রথম ছবি আমার। ভীষণ কম বাজেট। সুতরাং সৌমিত্রকে কাস্টিংয়ের জন্য ভাবাটা স্রেফ বামন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার মতো অপরাধ। কিন্তু স্বপ্ন বলে কথা। স্বপ্নের তো কোনো লাগাম থাকে না। আমিও অর্বাচীণের মতো প্রস্তাব দিয়ে বসলাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে অনুপ্রবেশে অভিনয়ের জন্য। আমার স্ত্রী শর্মিষ্ঠা তখন কলকাতায়। ওর হাত দিয়ে স্ক্রিপ্ট পাঠালাম। উনি কয়েকদিন সময় চাইলেন।

আমার তখন জন্মও হয়নি, তারও দশ বছর আগে থেকেই তিনি বিখ্যাত। সত্যজিতের মতো পরিচালক শুধু তাঁকে নিয়েই ১৪টি ছবি নির্মাণ করেছেন। তিনি কতোখানি ভুবনখ্যাত, সেসব বিষয়ে তাঁকে নিয়ে লক্ষ লক্ষ লাইন ছড়ানো আছে আন্তর্জালে। ক্লিক করলেই যেকেউ বিশদে জানতে পারবেন। আমি কেবল শেয়ার করব তাঁর সঙ্গে আমার শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশের শেষ একক ছবিতে তিনি কবে অভিনয় করেছেন, সেটা তাঁকে জিজ্ঞেস করেও স্পষ্ট জানতে পারিনি। যৌথ প্রযোজনার ‘চুড়িওয়ালা’ ছবির কথা বলেছিলেন তিনি। সেটাও ২০০১ সালের ছবি। সুতরাং ‘অনুপ্রবেশ’ হলো বাংলাদেশের কোনো ছবিতে অভিনয় করা সৌমিত্রের শেষ ছবি। 

কলকাতায় আমার বয়সী তরুণেরা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ‘জেঠু’ ডাকেন, আমি অবশ্য ‘দাদা’ বলতাম। উনি বোধহয় ‘দাদা’ ডাক শুনতেই পছন্দ করতেন, কারণ অশীতিপর হলেও ভেতরে ভেতরে এক অপার তারুণ্যবোধে তিনি ঝলমল করতেন। আমার ছবির স্ক্রিপ্ট পড়ার পর উনি রাজি হলেন।

এটা সত্যিই আমার জন্য পরম আনন্দের! কোনোদিন ভাবতেও পারিনি লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন বলার সুযোগ ঘটবে তাঁর মতো মহীরুহের সামনে। অনুপ্রবেশ শুটিংয়ের বদন্যতায় তাঁর নিবিড় সঙ্গ পেয়েছি মোট ছয় দিন। শুটিংয়ের জন্য চার দিন সময় বরাদ্দ করলেন। সৌমিত্র-দাদার সহ-অভিনেতা ছিলেন আলতাফ স্যার ও পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। আমার স্পষ্ট মনে আছে, স্ক্রিপ্টের প্রতিটি লাইন তিনি প্রায় অক্ষরে অক্ষরে মনে রাখতে পারতেন। সে কারণে ডায়ালগ ঠিক থাকার পরও যদি কোনো দৃশ্যের সেকেন্ড টেক নিতে চাইতাম তবে তাঁর কাছে সেটার ব্যাখ্যা দিতে হতো। বলতেন, কেন? কোথায় ভুল হলো? আমি তখন দুরুদুরু বুকে বলতাম এটার আসলে এমন ইমোশন আসা উচিত। আমার মধ্যে তখন নাপিত-ডাক্তারের মতো সাহস কোথা থেকে যেন উদয় হয়েছিল! উনি হেসে সেটা মেনে নিতেন এবং দ্বিতীয় এমনকি তৃতীয় টেকও দিতেন। যদিও বেশির ভাগই এক টেক-এ ‘ওকে’ হয়ে যেত। কিছু ইংরেজি ডায়লগ ছিল। তিনি কী অদ্ভুত দক্ষতার সঙ্গে সেগুলো যথাযথ আবেগ ঢেলে বলে গেলেন। ডাবিংয়ের সময়ও তা-ই। কী আশ্চর্য!

আমি শুনেছিলাম উনি যথেষ্ট রাশভারি, রাগী। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। হয়তো নতুন পরিচালক বলেই, তিনি অপার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আরেকটা কারণ কি বাংলাদেশ? হতেও পারে। বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার চাটুজ্জে বাড়ির ছেলে তিনি। শিলাইদহের কাছে কয়া নামে একটি গ্রামে আদিবাড়ি ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়য়ের। যদিও দেশভাগের অনেক আগেই তাঁর পিতামহ পশ্চিমবঙ্গে নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে বসবাস শুরু করেন। কৃষ্ণনগরেই ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি জন্ম হয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের।

ক্যান্সার সারভাইভার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলতেন, ‘আমি অভিনয় করছি বলেই তো সুস্থ আছি।’ এজন্য করোনায় গৃহবন্দি থাকতে থাকতে তিনি সম্ভবত হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। কলকাতায় লডকাউন উঠতেই তিনি শেষ করেছেন নিজের বায়োপিক অভিযান-এর শুটিং। কাজ করেছেন একটি ডকুমেন্ট্রারি ফিল্মেও। কিন্তু শুটিং করতেই গিয়েই যেন নক্ষত্রপতন হলো। তিনি করোনায় আক্রান্ত হলেন। তারপর টানা চল্লিশ দিন যমে-মানুষে টানাটানি। অবশেষে গতকাল দুপুর সোয়া দুটোয় জাগতিক সকল চাওয়া পাওয়ার যবনকিা পতন ঘটল। হায় নায়ক! প্রিয় নায়ক! তোমার সৃষ্টিমাঝে তুমি অমর রবে। 

লেখক : সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার

সম্পাদনা : এস এম সাব্বির খান