• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২১, ১০:৫৪ এএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২১, ১০:৫৪ এএম

মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষা ও ভাষার আধিপত্যবাদ

মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষা ও ভাষার আধিপত্যবাদ


একটি প্রত্যন্ত গ্রামের নিম্নপ্রাথমিক বিদ্যালয়ের দৃশ্য। স্কুলটি বাংলা মাধ্যমের। ছাত্রদের অধিকাংশের মাতৃভাষা বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি। বাংলা ঠিকমতো লেখা বা পড়া দুরে থাক বুঝতেই পারে না। তাদের জায়গা হয় লাস্ট বেঞ্চে। বাঙালি ছাত্ররা তুখোড় বাংলায় যখন গড়গড় করে পড়া বলে, তারা তখন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।

তো এই স্কুলে পড়ানোর দায়িত্ব পেয়েছেন একজন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি শিক্ষক। কিন্তু তাকে পড়াতে হয় বাংলা ভাষায়। ক্লাসে এসে ভারিক্কি গলায় তিনি পড়া ধরেন, আচ্ছা কয়েকটা সুগন্ধি ফুলের নাম বলতো দেখি?

কাদুরা নামের ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়ে বলে, স্যার সুগন্ধি মানে কী? শিক্ষক নিচু স্বরে মাতৃভাষায় বুঝিয়ে দেন সুগন্ধি কী জিনিষ। 

কাদুরা উত্তর দেয়, আতর মালতি সিঙ্গারেই কাপকলেই চিকংলেই...। 

শিক্ষক ধমকে ওঠেন— তোর মাথা!

শিক্ষক: আচ্ছা বল দেখি কয়েকটা আঁশহীন মাছের নাম?
 
কাদুরা: ঙামুই, গতুপ, বামি, চাকচিরা..। 

শিক্ষক কান মলে দেন গর্দভ ছাত্রের। 

এবার ক্লাসের মেধাবী বাঙালি ছেলেটিকে ডাকেন শিক্ষক, সুবল তুমি বলো তো?

সুবল স্মার্টলি বলে, শিং, মাগুর, বোয়াল, পাবদা, ইত্যাদি। 

শিক্ষক পিঠ চাপড়ে দেন ছাত্রের, সাব্বাস!!

শিক্ষক এবার বলেন, দেখি বাক্য রচনা কর, কে পারবে বিড়াল দিয়ে বাক্য রচনা? 

কাদুরা ছেলেটি দাঁড়িয়ে বলে, স্যার আমি পারব। ‘বিড়াল হুকানা মাছ সব্দে’।
 
শিক্ষক রাগে দাঁত কামড়ান। ছেলেটিকে আরেকবার সুযোগ দেন, ‘আচ্ছা জল দিয়ে বাক্য রচনা কর’

কাদুরা এবার উত্তর দেয়, ‘জল পিলে টাটি ভাঙ্গে’।

শিক্ষক হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন, ‘তোর মাথা ভাঙ্গে’। তারপর বেত্রাঘাত শুরু করেন। 
কাদুরা চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, ‘অজা আমার মেকুর উগইতে হুকানা মাছ সব্দেরগতে!’

বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায়, স্যার আমাদের বিড়ালটি সত্যিই শুকনো মাছ ছোবল দিয়ে খায়!


পাতিয়ালা গণনাট্য সংঘ ১৯৬৮ সালে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষায় এই নাটকটি মঞ্চস্থ করে। নাম ‘ঘুমর আধার বাগিয়া’। নাটকটিতে বরাক উপত্যকার স্কুলগুলোর বাস্তব চিত্র উঠে আসে। কোমলমতি শিশুরা ঘরে এক ভাষায় কথা বলে স্কুলে গিয়ে অন্য ভাষায় পড়তে গিয়ে যে বিড়ম্বনা ও বৈষম্যের শিকার হয়, তারই প্রেক্ষিতে বরাক উপত্যকায় মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার আন্দোলন দানা বেঁধেছিল।


এই দেশে বাঙালি ভিন্ন যে সকল জাতিগোষ্ঠী আছে তাদের অধিকাংশই বাংলা ঠিকমতো বলতে পারে না। বলতে পারলেও উচ্চারণ সঠিক হয় না। বিশেষত যাদের ভাষা টিবেটান-বার্মিজ বা অস্ট্রো-এশিয়াটিক শ্রেণির তাদের ভাষাগত বিশেষত্বের কারণে বাংলার সাথে উচ্চারণ মেলে না। এই ব্যাপারটা নিয়ে সংখ্যাগুরু বাঙালিদের আমোদের শেষ নেই। স্কুলজীবন থেকেই শুরু হয় এই নিয়ে হাসিঠাট্টা ব্যঙ্গবিদ্রূপ ও ট্রল। ফলে শিশুকাল থেকে অবাঙালি শিশু হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে৷ সংখ্যাগুরু বাঙালি কখনও ভাবে না যে— সে যদি চাকমা, মারমা, গারো বা মণিপুরিতে কথা বলে তার উচ্চারণও একইভাবে হাস্যকর শোনাবে।


স্কুল পার হয়ে কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গিয়েও শান্তি আছে তা নয়। স্কুলের ট্রল করা আধাচুতিয়া ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে ফুল চুতিয়ায় পরিণত হয়। সে তখন আদিবাসী বা পাহাড়ি ছাত্র পেলে জানতে চায়, এই তোদের ভাষায় ‘আমি তোমাকে ভালবাসি, তোমার সাথে সেক্স করতে চাই’ এইটা কিভাবে বলে? কেউ জানতে চায় বিভিন্ন যৌন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নাম। এই যে অন্যের মাতৃভাষাকে অপমান করা, তুচ্ছার্থে দেখা— এই সংস্কৃতির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের সংবিধান কেবল বাংলা ভাষাকেই রাষ্ট্রের একমাত্র সাংবিধানিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমাদের সংবিধানের কোথাও বলা নাই যে, বাঙালি ছাড়াও অন্য এই এই ভাষাগোষ্ঠীর লোকজন এখানে বাস করে। ফলে এখানকার সংখ্যাগুরু শিশু ও ধেড়ে শিশুরা ‘এই দেশের ভাষা হইল বাংলা, বাকিগুলো ধইঞ্চা’ এইরকম আধিপত্যবাদী চিন্তা ও মনস্তত্ত্ব নিয়ে বেড়ে উঠে। ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন বা আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের গর্বে যাদের বুক ফুলে ওঠে, বাংলাদেশের অন্যান্য ভাষাভাষী মানুষদের মাতৃভাষার প্রসঙ্গ আসলে তারাই অবতীর্ণ হয় রাষ্ট্রের দালাল হিসেবে।


নিজের মাতৃভাষার পাশাপাশি অন্যের মাতৃভাষাকে সম্মান করুন। আপনার মাতৃভাষাটি যতোটা মহান, অন্যদের মাতৃভাষাগুলোও তাদের কাছে ঠিক ততোটাই মহান।