কান্না বাড়ছে বিরল রোগ ট্রি-ম্যান সিনড্রোমে আক্রান্ত আবুল বাজনাদারের। দিন যাচ্ছে, সেই সঙ্গে তার হাত-পাসহ দেহের বিভিন্নস্থানে শেকড় সদৃশ বস্তুও বড় হচ্ছে। অসহ্য জ্বালাপোড়া, স্বাভাবিক জীবন যাপনে তীব্র বাধার সাথে ভয়-হতাশা-আফসোসে দিন যাচ্ছে তার।
মঙ্গলবার (২৭ নভেম্বর) বিকালে আবুল জাগরণকে বলেন, ‘কেমন থাইকপো (থাকব) ভাই, শেকড়গুলান আবার হস্যে (হচ্ছে)।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে অবস্থান করে প্রায় আড়াই বছর একটানা চিকিৎসা গ্রহণ করেছিলেন আবুল। তখন ভূমিহীন ২৮ বছর বয়সী আবুলকে পাইকগাছায় কিছু জায়গা কিনে দান করেন প্রখ্যাত চর্মবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। সেই জায়গায় নির্মাণ করা বাড়িতে মা-বাবা, স্ত্রী-একমাত্র কন্যা সন্তানকে নিয়ে বাস করছেন আবুল।
২০১৬ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢামেকে ভর্তির পর চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, আবুল ‘এপিডার্মোডিসপ্লাসিয়া ভেরাসিফরমিস’ রোগে আক্রান্ত। রোগটি ‘ট্রি-ম্যান’ (বৃক্ষমানব) সিনড্রম নামে অধিক পরিচিত।
ঢাকা মেডিকেলে ভর্তির পর ছোট-বড় ২৩টিরও বেশি অস্ত্রোপচার হয়েছে আবুলের দুই হাত ও দুই পায়ে। সর্বশেষ অস্ত্রোপচার হয় গত বছরের ২৭ জুলাই।
এখন কী করবেন- জানতে চাইলে আবুল বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকরা তো অনেক চেষ্টা করছে। কিন্তু শেকড় তো আবার হস্যে। চাসসিলাম, অন্য কোথাও আরো ভালো চিকিৎসা করা যায় কি-না। ঢাকা মেডিকেল থেকে বলছে, এই রোগ নাকি ভালো হবে না। শেকড় বাড়লে কেটে ফেলতে হবে, এভাবেই নাকি সারাজীবন চলতে হবে।
'অন্য কোথায় চিকিৎসা করাতে চাচ্ছেন, সেখানে করলেই যে সুস্থ্য হবেন, নিশ্চয়তা কী'- এসব প্রশ্ন করা হলে আবুল বেশ দৃঢ় স্বরে বলেন, ঢাকা মেডিকেলে অপারেশন কইরা যেখান থেইকা শিকড় কাইটা দিতো, সেইখানে কিন্তু শিকড় আর গজায় নাই। এটা ভালদিক, আমার মন বলতেসে, আমি সুস্থ্য হবই। ঢাকার একজন বড় চর্ম ডাক্তারের সাথে কথা বলছি। তিনি বলেছেন, রোগটা জটিল আকার ধারণ করেছে। সময় নিয়ে চিকিৎসা চালালে সুস্থ্য হতে পারব। চিকিৎসা করাতে হবে বেসরকারি হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতালের খরচ নাকি আমাকে বহন করতে হবে। এটা তো আমার পক্ষে সম্ভব না।
এ প্রসঙ্গে আবুল আরও বলেন, ওই ডাক্তার আরও বলছে, হাসপাতালে থাকা-খাওয়া-ওষুধ খরচ হলেই উনি চিকিৎসা করবে। এজন্য ৫ লাখ টাকা যোগাড়ের কথা বলছেন তিনি। উনিসহ আরও যে ডাক্তররা কাজ করবে তারা নাকি কোনো পয়সা নেবেন না। কিন্তু এই ৫ লাখ টাকা আমি পাব কই।
এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন আবুল। বলতে থাকেন, আমার মেয়েটার জন্য আমি বাঁচতে চাই। আমারে বাঁচান। মানুষরে কন আমারে সহযোগিতা করতে...।
গত ২৭ মে আবুল ঢামেক বার্ন ইউনিটের ৬১১ নম্বর কেবিন থেকে খুলনা চলে যান। তার চিকিৎসার শুরু থেকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকারী শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা অধ্যাপক সামন্ত লাল সেন ২৮ মে জানিয়েছিলেন, এদিন সকালে চিকিৎসকরা কেবিনে গিয়ে আবুল বাজনাদারকে পাননি।
ঢামেক কর্তৃপক্ষ আবুলের কাগজপত্রে তাকে ফেরারি হিসেবে দেখায়। আবুল বলেন, ‘ডাক্তাররা বলেই দিসে, আমি ভাল হব না, তাইলে খালি খালি হাসপাতালে থাইকা লাভ কী? তবে ডাক্তাররা আমারে নিয়া অনেক খাটছে আমি বিশ্বাস করি।’
চিকিৎসাশাস্ত্র অনুযায়ী- ট্রি-ম্যান সিনড্রোমের কোনো চিকিৎসা নেই। এটা জিনঘটিত রোগ। আবুলের আগে পৃথিবীতে এই রোগে আক্রান্ত মাত্র তিনজনের সন্ধান পাওয়া গেছে। ২০০৭ সালের মার্চে রোমানিয়ায় সন্ধান পাওয়া যায় কৃষক আয়ন তোয়াদের। পৃথিবীতে সন্ধান পাওয়া প্রথম বৃক্ষ মানব তিনি। রেডিয়েশন চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। ২০১৩ সালের শেষ দিকে তার দেহে অস্ত্রপচার করা হয়। ধারণা করা হয়,পরে ক্যান্সার সংক্রমণের শিকার হয়েছিলেন আয়ন। তিনি জীবিত নেই।
২০০৭ সালের নভেম্বরে ইন্দোনেশিয়ায় সন্ধান পাওয়া যায় ৩৪ বছরের দেদে কসওয়ারার। ২০০৮ সালে অস্ত্রপচারের পর তার দেহ থেকে অপসারণ করা হয় ছয় কেজি ওজনের আঁচিল। বিরল সেই অস্ত্রপচার নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করে ডিসকভারি চ্যানেল। পরে অবশ্য দেদের শরীরে ফিরে আসতে থাকে রোগের লক্ষণগুলো। চিকিৎসকরা তাকে বছরে দুইবার করে অস্ত্রপচার করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তিনি সেই চিকিৎসা নিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনিও জীবিত নেই।
২০০৯ সালে ডিসকভারি চ্যানেল ‘ট্রিম্যান মিটস ট্রিম্যান’ শিরোনামে আরেক অনুষ্ঠানে ইন্দোনেশিয়ার আরেক ব্যক্তিকে হাজির করে। দেদে কসওয়ারার এলাকায় সন্ধান পাওয়া ওই ব্যক্তি চিকিৎসার পর এখন অনেকটাই স্বাভাবিক জীবনে।
এফসি