• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৪, ২০১৯, ০৭:১১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ২৪, ২০১৯, ০৭:১১ পিএম

বয়স্করা কিভাবে ভাল থাকবেন

বয়স্করা কিভাবে ভাল থাকবেন

আমি যখন এই লেখাটি লিখছি তখন আমার বয়স ৬০ ছুঁই ছুঁই করছে। অর্থাৎ আমি প্রবীণের কাছাকাছি। আর ৫/৬ বছর পরই বয়সস্কদের কোটায় পড়ে যাবে। তাই বয়স্কদের ব্যাপারে আমার উপলব্ধি বয়োকনিষ্ঠদের চেয়ে খানিকটা বেশি। বয়স্কদের নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে একটি মৌলিক চিন্তা। যে কোন মৌলিক চিন্তার ব্যাপারে আমার আগ্রহ অনেক বেশি। তার উপর আমার প্রৌঢ়ত্ব শেষ হচ্ছে। তাই এই লেখাটির ব্যাপারে আমার মন সতত উৎসারিত। ১লা অক্টোবর প্রবীণ দিবস গেল। ঐ প্রবীণ দিবসের উদ্দেশ্যে আমার এই লেখাটি।

আমরা যারা আজ প্রৌঢ় বয়সে পরিণত হয়েছি, তাদের বয়স্কদের পর্যায়ে পৌঁছতে আর বেশী সময় বাকী  নেই। তাই আমার মনে হয় যুবকদের চেয়ে আমরাই বেশী করে ভাববো কিভাবে বয়স্করা ভাল থাকবেন। বয়স্কদের প্রতি আমাদের করণীয় কি। আজ যারা বয়স্ক তারাই এক সময় ছিলেন যুবা এবং প্রৌঢ়। তারাই পরিবারের হাল ধরেছেন। অর্থাৎ তাদের ভূমিকা না থাকলে আমরা এই পর্যায়ে পৌঁছতামনা। সমাজ এবং রাষ্ট্র এই পর্যায়ে পৌছতো না। কিন্তু আজ তারা বয়সের ভারে, শরীরের ভারে ক্লান্ত হয়ে আছেন। শারীরিক শক্তি নেই। যে যেকাজে ছিলেন ঐ কাজ থেকে অবসরপ্রাপ্ত। তাই তাদের সমাজে বৈষয়িক অর্থে মূল্য নেই। যেহেতু তারা এখন ঘরবন্ধি, বাড়িবন্ধি, আয় রোজগার করেন না, তাই তাদের বয়োকনিষ্ঠরা তাদের মুখাপেক্ষী নন। যেহেতু তাদের মুখাপেক্ষী নন তাই তাদেরকে তেমন মূল্যায়ন করতে চান না।

কিন্তু এটা কি ঠিক! আমরা যদি আমাদের অতীতের দিকে তাকাই তা হলে কি দেখি!এই পৃথিবীর জলবায়ু আবহাওয়া আমরা কাদের দ্বারা উপলব্ধি করেছি। আমাদের শৈশবে কারা যত্ন নিয়েছেন। আমরা যখন নিজ হাত দিয়ে খেতে পারতামনা কে আমাদেরকে খাইয়েছেন?আমরা যখন হাটতে পারতামনা কে আমাদিগকে হাত ধরে হাঁটা শিখিয়েছেন?কার মাধ্যমে আমরা লেখাপড়া শিখেছি? এটা যদি ভাবি তাহলে যতদিন প্রবীণেরা বেঁচে থাকবেন ততদিন তাদেরকে মূল্যায়ন করতে হবে। এখন তাদেরকে প্রয়োজন নেই বলে তাদের প্রতি আমরা খেয়াল রাখবো না এটা হয় না। এটা অত্যন্ত অমানবিক। আমরা যতই যান্ত্রিক হই না কেন আমরা তো মানুষ। মানুষ হিসেবে আমাদের পরিপূর্ণ মানবিকতা থাকতে হবে। তাই তাদের প্রতি আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। মানুষ সম্মান এবং অনুভূতি দিয়ে গড়া(মানুষ=মান+হুশ, হুশ অর্থ অনুভূতি)। যদি মান সম্মানবোধ না থাকে তাহলে কিভাবে মানুষ হবে? মান না থাকলে মানাবিকতাও থাকতো না। অনুভূতি(হুশ) না থাকলেও প্রকৃত মানুষ হওয়া যায় না। তাই আমাদের অনুভূতি বাড়াতে হবে। বয়স্কদের সম্মান দিতে হবে।
এবার আসুন একে একে এগুলো আলোচনা করি। 


পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রগঠনে বয়স্কদের ভুমিকা :
পরিবারের ঘানি টেনে তারা ছেলে মেয়েদের বড় করেছেন। বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ করে সমাজের উন্নয়ন করেছেন। যেখানে স্কুল ছিল না স্কুল করেছেন। যেখানে মসজিদ মন্দির ছিলনা সেখানে মসজিদ মন্দির করেছেন। যেখানে রাস্তা ছিল না সেখানে রাস্তা করেন। এক সময়ে সরকারী যন্ত্রের ধারক এবং বাহক ছিলেন এই বয়স্করাই। তারাই ছিলেন রাষ্ট্রের কর্ণধার। প্রকৌশলীরা দেশের উন্নয়ন করেছেন, ডাক্তাররা চিকিৎসা দিয়েছেন। শিক্ষকরা লেখাপড়া শিখিয়েছেন, কৃষিবিদরা খাদ্য উৎপাদনে অবদান রেখেছেন।  আমলারা সবকিছু তদারকি এবং বাস্তবায়ন করেছেন। সাংবাদিকরা সংবাদ প্রবাহ বাড়িয়ে দিয়ে জনসচেতনতা বাড়িয়েছেন। রাজনীতিবিদরা পলিসি দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন। এভাবে যে যে সেক্টরে ছিলেন সেখানে হাল ধরেছেন। অর্থাৎ বয়স্করা দেশকে অনেক কিছু দিয়েছেন এখন তাদেরকে দেয়ার সময়। 

বয়স্কদের সেকাল, একাল এবং আগামীকাল :
আমাদের ছোট বেলায় আমরা বয়স্কদের যেভাবে ভাল থাকতে দেখেছি একালে বয়স্করা আর ঐভাবে ভালো নেই। তাদের আগামীকাল কিভাবে যাবে এটা নিয়ে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে এখনই ভাবতে হবে। একালের বয়স্করা কেন সেকালের তুলনায় ভাল নেই  তার কারণ সমূহ বিষদভাবে পর্যবেক্ষণ করলে যেটা পাওয়া যায়। তখনকার সময়ে পারিবারিক এবং সামাজিক প্রেক্ষিত অনেক পরিবর্তন। ঐ সময়কার মানবিক মূল্যবোধ এবং এখনকার মানবিক মূল্যবোধ আকাশ পাতাল ফারাক। তখনকার সময়ের ব্যস্ততা আর এখনকার ব্যস্ততা অনেক পার্থক্য। সে আমলের উপলব্ধিগুলো ছিল অনেক প্রকোট। তখনকার জীবন প্রবাহের গতির সঙ্গে এখনকার গতিতে অনেক অমিল। এই সবকিছুর ভুক্তভোগী হলেন এখনকার বয়স্করা। 
সংক্ষেপে ভাল না থাকার কারণ যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে যে উপাদানগুলো পাওয়া যায় তা হচ্ছে :
প্রথমত : বয়স্কদের ঔরসজাত উত্তরসূরী সংখ্যায় কমে যাওয়া।
দ্বিতীয়ত : পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন।
তৃতীয়ত : উত্তরসূরীদের জীবন প্রবাহে ব্যস্ততা।
চতুর্থত : অনুভূতি-মূল্যবোধের অবক্ষয়।
এই উপাদানগুলো একে একে আলোচনা করা যায়-

বয়স্কদের ঔরসজাত উত্তরসূরি সংখ্যায় কমে যাওয়া :
বয়স্কদের ঔরসজাত উত্তরসূরি সংখ্যায় কমে যাচ্ছে। সেকালে বয়স্কদের ঘেরাও করে নাতী-নাতনি ১৫/১৬ জন ছিল। বয়স্কদের ৩/৪ জন ছেলে ছিল। ছেলেদের ঘরে আরও ৩/৪ জন করে সন্তান ছিল। অনুপাত দাঁড়াত ১:৪:১৬। বর্তমানে পিতার ১ সন্তান তার ঘরে ১ সন্তান। অনুপাত দাঁড়াচ্ছে ১:১:১। তাই দেখভাল করার মত লোকজন কমে গেছে। 

পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন :
পরিবারগুলোর একান্নবর্তী থেকে মৌলিক পরিবারে পদার্পণ। তখনকার সময় ছিল একান্নবর্তী পরিবার। মা, বাবা, ভাই,  বোন, দাদা-দাদী, ফুফু, চাচাত ভাই, চাচাত বোন সবাইকে নিয়ে একান্নবর্তী পরিবার। এর মাঝে দাদা-দাদী মধ্যমণি হিসেবে কাজ করতেন। পরিবারের সকল কিছুই তাদের অনুমতি সাপেক্ষে হতো। এমন কি পাক ঘরের রান্না-বান্নার আইটেম সিলেকশনও তাদের অনুমতি সাপেক্ষে হতো। এতে করে বয়স্কদের মন মগজ থাকতো ফুরফুরে। 
কিন্তু আজকাল দেখা যাচ্ছে সেই একান্নবর্তী পরিবার আর নেই। পরিবারে লোক সমষ্টি যেটা চোখে পড়ে তা হচ্ছে স্বামী, স্ত্রী, একজন বা দুইজন সন্তান। সাথে কাজের বুয়া বা ছেলে। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই চাকুরী করেন। সন্তানদেরকে কাজের বুয়ার উপর দায়িত্ব দিয়ে যান। আর বুড়ো মা-বাপ বাড়ীতে অবহেলায়, অনাদরে একাকী সময় কাটান। ছেলে মেয়ে সবাই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে, নিজেদের ছেলে মেয়েকে নিয়ে। এই হচ্ছে আজকের পারিবারিক প্রেক্ষিত। 
প্রয়োজনের তাগিদে একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে আজ মৌলিক পরিবার হচ্ছে। এটাকে নেতিবাচক হিসেবে দেখলে হবে না। ৩/৪ পুরুষ পূর্বে এই দেশে বাড়ি বাড়ি শিক্ষিত লোক দেখা যেত না। যে যেখানে জন্মগ্রহণ করতো ওখানেই মৃত্যু বরণ করত। শিক্ষার উদ্যোগ বেড়েছে, মানুষ শিক্ষিত হয়েছে, উচ্চ শিক্ষার জন্য বাড়ি ছাড়তে হয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য চাকরি-বাকরির জন্য তাকে পৈত্রিক বাড়ি থেকে অনেক দূরে যেতে হচ্ছে। সূতরাং এক-ভাতে পরিবার থাকা আর সম্ভব হয়ে উঠে না। এতে করে বয়স্কদের জীবনে একটি ঘাটতি পড়ে। অন্যান্য উপাদান দিয়ে এই ঘাটতিকে পরিপূর্ণ করা যায়। 

উত্তরসূরিদের জীবন প্রবাহে ব্যস্ততা :
অতীতে জীবনের উপকরণগুলো ছিল সহজসাধ্য। জীবন যাপন ছিল অনাড়ম্বর। চাহিদা ছিল কম। ইচ্ছা শক্তি ততটা প্রকট ছিল না। দৈনন্দিন জীবনে শ্বাস ফেলার(Breathing space) সময় ছিল। অন্যদিকে তাকানোর ইচ্ছাও ছিল, সময়ও ছিল। যার ফলে অন্যের খোঁজ খবর রাখা যেত। অন্যের খোঁজ খবর রাখতে যেয়ে মা-বাবার কথা সবার আগে মনে পড়ত। বর্তমানে বেড়েছে Motion কেড়ে নিয়েছে Emotion । জীবনের চাহিদা বেড়ে গেছে, সাধ বেড়ে গেছে। সাধ পরিপূর্ণ করার জন্য অনন্তর চেষ্টা। এতে করে শ্বাস ফেলার মত ফুরসত নেই। অন্যের দিকে তাকানোর মত দৃষ্টি ভঙ্গিও নেই, ইচ্ছা শক্তিও নেই। পুরাতন কথায় বলে : চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। কবির কথায়- পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। লেখকের কথায়- অভাব যখন দুয়ারে এসে দাঁড়ায়, ভালবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়। 
 বেড়েছে বেগ, কেড়েছে আবেগ
নিজেকে নিয়ে কেবলই ব্যস্ত 
 করে রেখেছি মন সদা ত্রস্ত।
নাইগো সময় তাকাবার 
কে আপন কে পর পারিনা তা বুঝিবার। 
যাকে প্রয়োজন সেই আপন
রক্তকে করেছি পর
সময় নেই রাখিবারে মনে 
থাকি ব্যস্ত দিনভর।

অনুভূতি-মূল্যবোধের অবক্ষয় :
এবার আসা যাক অনুভূতির কথা। অনুভূতির সেই গভীরতা আর নেই। অতীতে অনুভূতি ছিল হৃদয় ছোঁয়া, হৃদয় যন্ত্রের ভিতর গেঁথে যাওয়া। আজকাল মনে হয় যেন সেই হৃদয়ের ভিতর জমাট বাঁধা অনুভূতি গুলো বাস্পায়িত হয়ে উড়ে যাচ্ছে। অনুভূতির সেই ধার আর নেই। অনুভূতিতে মরিচা পড়েছে। কিন্তু একটি কথা বার বার মনে ধাক্কা দেয় ঠিক আছে অনুভূতি নেই ব্যস্ততা অনেক বেশী, লোকবল সঙ্কট। তাই বলে কি নিজের ছেলে-মেয়েদের প্রতি মনোযোগ কমে গেছে? অবশ্যই না। ছেলেরা কিভাবে ভাল লেখাপড়া করবে, ভাল খাওয়া-দাওয়া করবে এ ব্যাপারে সেকালের বাবাদের চেয়ে একালের বাবারা অনেক বেশী সচেতন। ঔরসজাত সন্তানদের প্রতি যদি এতই সচেতন হওয়া যায়, তাহলে আপনি যার ঔরসজাত তার প্রতি এত অবহেলা কেন?মনে হয় কোথায় যেন একটি ফাঁকফোকর রয়েছে, একটি গলদ রয়েছে। এই ফাঁকফোকর, এই গলদটি হচ্ছে আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয়। আমাদের যৌক্তিক দায়িত্বশীলতার অবনতি। আমাদের মূল্যবোধ থেকে উৎসারিত দায়িত্বশীলতার(Moral responsibility) অবক্ষয়।


প্রবীণদের ভবিষ্যৎ : 
প্রবীণরা আজ অবহেলিত। তাদেরকে যথার্থ মূল্যায়ন করা হচ্ছেনা । যদি পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা প্রবীণদের প্রতি এভাবে চলতে থাকে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে প্রবীণেরা এক অমানবিক জীবন যাপনে চলে যাবে। তাদের দুর্দশার অন্ত থাকবেনা। কথায় বলে- যে পরিবারে প্রবীণেরা ভাল থাকে সে পরিবারে মানবিক মূল্যবোধ অনেক উচ্চ পর্যায়ে। সে পরিবারে শান্তির বাতাস বয়ে যায়, ভালবাসার নহর বয়ে যায়।  প্রবীণদের ভাল থাকা পরিবারের ভালবাসার সূচক। 
আমাদের করণীয় :
১. ব্যক্তি এবং পারিবারিক পর্যায়: 
বয়স্কদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে :
১. যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।
২. তাদের প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে।
৩. দায়িত্বশীল হতে হবে। 
৪. অনুভূতির গভীরে যেতে হবে। 
৫. মানবিক মূল্যবোধ বাড়াতে হবে। 

বয়স্কদের প্রতি মূল্যবোধকে শানিত করুন:
যে পরিবারে বয়স্ক মানুষজন আছেন সে পরিবারের বয়োকনিষ্ঠ উচিত হবে বয়স্কদেও নিয়ে নিগূঢ় ভাবে ভাবা শত ব্যস্ততার মাঝেও আর্থিক টানাপোড়েনের মাঝেও বয়স্কদের প্রয়োজনটাকে তাদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পূরণ করতে হবে। যদিও এ্ই সময়ে বৈষয়িক ক্ষেত্রে সেই বয়স্ক লোকটির আপনার প্রয়োজন নেই কিন্তু মানবিক, সামাজিক, নীতিগত দিক ও মূল্যবোধের দিক বিবেচনা করে তার প্রতি আপনার অনেক দায়িত্ববোধ রয়েছে। যখনই তার প্রতি দায়িত্বে কোন অনীহা বা অবহেলা আসবে তখনই আপনি ভাববেন এই বয়স্ক রোগী না হলে আমি পৃথিবীর আলো বাতাস দেখতে পারতামনা, এই পর্যায়ে আসতে পারতামনা। 

কিভাবে বয়স্কদের প্রতি নজর রাখবেন : 

১. তাদের প্রতি ভাল ব্যবহার :
বয়স্করা বাচ্চাদের মত। তারা খানিকটা আবেগ প্রবণ। অল্পতে ব্যথা পায়। অল্পতে খুশি হয়। ধৈর্য্যরে তাদের প্রতি ভাল ব্যবহার করতে হবে। তাদেও সাথে এমন ভাবে কথা বলতে হবে যাতে তারা মনে কোন কষ্ট না পায়। এমনকি কোন আপনার ব্যবহারে তারা যেন মন খারাপ করে বসে না থাকে এবং উফ শব্দটি না বলে। আপনি আপনার বাচ্চা আপনার স্ত্রীসহ বাড়িতে অবস্থিত বয়স্ক পিতা মাতার প্রতি ভাল ব্যবহারে কৃষ্টি কালচার তৈরি করুন। অফিসে যাওয়ার আগে উনার রুমে ঢুকে উনার মাথায়,পিঠে হাত বুলিয়ে উনার থেকে বিদায় নিবেন। অফিস থেকে আসার পর আবার উনার রুমে ঢুকে উনার সারাদিনের খোঁক খবর নিবেন। খাওয়া দাওয়া কি করেছেন, ঔষধ-পত্র ঠিক মত নিয়েছেন কি আপনার ছেলে-মেয়েদেরকে বলবেন দাদা-দাদু/নানা-নানুর খোঁজ খবর নিয়েছেন কিনা। আপনার স্ত্রীকেও তাই বলবেন। 
তাদের সাথে ধমকের সাথে কথা বলবেননা। এমনকি তাদেও প্রতি উহ্ শব্দটিও করবেননা। তাদেও সাথে সদাচরণ করবেন। তাদের সাথে সম্মানজনক ভাবে কথা বলবেন। তাদেও প্রতি দয়াপরবশ হয়ে বিনয়ের ডানা নত কওে দিবেন এবং মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি বলবেন, শৈশবে তারা আমাকে যেরূপ দয়া করে লালন পালন করেছেন আপনিও তাদের প্রতি সেরূপ আচরণ করুন। 

২. পরিচর্যা: 
ক) বয়স্কদের থাকার রুমটি যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন না হয়। আলো-বাতাসের অপ্রতুলতা যেন না থাকে। 
খ) আপনার যদি সাধ্যে কুলায় ঐ রুমে যেন সংযুক্ত বাথরুম থাকে। 
গ) মেঝে যেন পিচ্ছিল টাইলস না থাকে।
ঘ) ওয়াসরুমে যেন হাই কমোড থাকে। ওয়াসরুমে যেন স্টিলের বার থাকে।
ঙ) বিছানা বালিশ যাতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং ছিমছাম থাকে। 
চ) রাতে মশারি টাঙ্গিয়ে দিবেন, সকালে মশারি খুলবেন। 
ছ) উনারা যদি একা হন তাহলে রাতে বেলায় রুমে যেন একজন এটেন্ডেন্ট থাকে।
জ) নিয়মিত গোসল করানো।
ঝ) ভাল কাপড় চোপড় পরিধান করানো।
৩. খাওয়া :
ক) তাদেরকে তরল,নরম এবং সহজপাচ্য খাবার দেওয়া উচিত।
খ) শাকসব্জি, ফলমূল এবং মাছের প্রাধান্য থাকতে হবে। 
গ) মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতে হবে তারা কি খেতে চায়। ঐভাবে তাদের খাওয়া জোগাড় করতে হবে। 
ঘ) খাওয়ার ব্যাপারে সময়ানুভর্তিতা যথাযথভাবে বজায় রাখতে হবে। এটা মনে রাখতে হবে বয়স্করা ক্ষুধা সহ্য করতে পারেনা। ক্ষুধা লাগার আগেই তাদেরকে খাবার দিয়ে দিতে হবে। 
৪. চিকিৎসা এবং ঔষধ :
ক) তাদেরকে নিয়মিত ডাক্তার দেখাতে হবে। 
খ) ডাক্তার যে পরীক্ষা নিরীক্ষা দেন তাতে অবহেলা না করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হবে। এটা মনে রাখতে হবে যে রোগ প্রকাশ হওয়ার আগেই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ধরা পড়ে। 
গ) ঔষধের ব্যাপারে অবহেলা করা যাবেনা। 
ঘ) ঔষধ কেনার ব্যাপারে সংকোচিত হওয়া যাবেনা। মনে করুন আপনার টাকা পয়সার সীমাবদ্ধতা আছে, সেখানে আপনার অন্য কোন কম প্রয়োনীয় জিনিস বাদ দিয়ে হলেও ঔষধ কিনতে হবে। 
ঙ) ঔষধ খাওয়ার ব্যাপারে খুবই সচেতন হতে হবে। ঔষধগুলো রাখার জন্য তিনটি পাত্রের ব্যবস্থা করতে হবে, সকালের ঔষধ, দুপুরের ঔষধ এবং রাতের ঔষধ। সাধারণত সকালের ঔষধ বেশি থাকে,তারপর রাতের ঔষধ, দুপুরের ঔষধ কম থাকে। অনেক সময় বয়স্করা রাতের ঔষধ না খেয়ে ঘুমিয়ে যায়। খেয়াল রাখতে হবে এটা যেন কোন ভাবেই না হয়। অনেক সময় ঔষধ খাওয়াতে গিয়ে দেখে যে ঔষধ নেই। তাই ঔষধ শেষ হওয়ার আগেই ঔষধ কিনতে হবে। আপনার বাড়িতে চাল শেষ হওয়ার আগে যেমন আপনি যেমন চাল কিনে নিয়ে আসেন তেমনি ঔষধ শেষ হওয়ার আগেই ঔষধ কিনতে হবে। মনে রাখতে হবে চালের চেয়ে ঔষধের মূল্য কোন অংশেই কম নয়।  

৫. বিনোদন : 
ক) বয়স্করা বেশি বিনোদন চায় না।
খ) তারা চায় তাদের সাথে একটু হাসিমুখে কথা বলা। 
গ) বিভিন্ন উৎসবে তাদেরকে মনে করা, স্মরণ করা।
ঘ) তাদের খোজ খবর নেওয়া, দেখবাল করা।
ঙ) যা পেলে তারা খুশি হয় এধরনের আইটেম মাঝে মাঝে তাদেরকে দেয়া। 
চ) তার ঔরসজাত উত্তরসূরীরা, আত্মীয় ¯^জনরা তার সাথে যেন মাঝে মাঝে একটু দেখা করে, গল্প-গুজব করে। 
ছ) কোন বয়স্ক মানুষকে দেখতে গেলে তার হাতের মুঠে কিছু টাকা দিয়ে আসা। কিছু ট্কাা দিয়ে আসলে তিনি খুবই খুশি হন। 
জ) যদি আপনি নিয়ম করে বয়স্কদের দেখতে নাও যেতে পারেন, তাহলে টেলিফোন হলেও তার খোঁজ নিবেন।
* আপনিওতো  একজন মানুষ এটা স্বাভাবিক যে বয়স্কদের পরিচর্যা করতে যেয়ে আপনার মধ্যে বিরক্তির ভাব আসতে পারে। যখন আপনার মাঝে বিরক্তির ভাব আসবে তখন আপনি এতিমদের কথা ভাববেন এবং নিজের সৌভাগ্যেও কথা চিন্তা করবেন। মনে মনে ভাববেন যে, সৃষ্টিকর্তা আপনাকে যে সুযোগ দিয়েছেন বুড়ো মা-বাবাকে সেবা করার, ঐ সুযোগের সদ্ব্যবহার করবেন। মা-বাপ চলে গেলেই বুঝতে পারবেন যে মা-বাপ কি ছিল। ঐ দিনটি আসার আগেই যা পারেন আপনি আদায় করে নিন। 
২. সামাজিক পর্যায়ে :
* প্রতিটি গ্রামে মহল্লায় যুব, প্রৌঢ়া প্রবীণদের খোঁজ রাখতে হবে।
* তাদের অসহায় অবস্থায় এগিয়ে আসতে হবে।
* তাদের চিকিৎসায় এগিয়ে আসতে হবে।
* সমাজের যে কোন অনুষ্ঠানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যথাযথ সম্মান দেখাতে হবে। যেহেতু প্রতিটা পরিবারের লোকসংখ্যা কমে গেছে তাই সমাজবদ্ধভাবে গ্রামের কয়েক বাড়ীর যুবকরা মিলে প্রবীণদের যে সমস্যা সে সমস্যা সমাধান করতে হবে। যুবকরা এখন বুঝতে হবে বয়স্করা কেবল একজন বাড়ীর সদস্য নয় তারা একটা সমাজেরও সদস্য। অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনীয়তা(ইধংরপ হববফ) পূরণ করার পর প্রয়োজন হলে তাদের জন্য প্রতিটা মহল্লা গ্রামে ছোট্ট পরিসরে তাদের জন্য একটি বিনোদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যেখানে তারা প্রত্যহ মিলে গল্প-গুজব করতে পারে। নিজেদের ধারণা প্রকাশ করতে পারে।  
৩. রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে :

* বয়স্ক ভাতার পরিসর এবং পরিবার বাড়াতে হবে। 
* আইন তৈরি করতে হবে যাতে করে পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালন করে।
* প্রতিটি গ্রামে/ইউনিয়নে/উপজেলায় প্রবীণ বিনোদন কেন্দ্র তৈরি করতে হবে। বিনোদন কেন্দ্রে বই এর ছোট লাইব্রেরী থাকতে হবে, উপাসনালয়ের জন্য জায়গা থাকতে হবে। প্রতিদিনের পত্রিকা থাকতে হবে। বিশ্রাম নেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। 
* প্রবীণদের জন্য বিভিন্ন দিবসের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকতে হবে যাতে করে সেখানে অংশগ্রহণ করে অতীতের স্মৃতি চারণ করতে পারে।
* বিভিন্ন উৎসব ভাতা দিতে হবে।
* ইউনিয়ন/উপজেলায় ফ্রি চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকতে হবে।
* জাতীয় পর্যায়ে একটি ইনস্টিটিউট অব ইন্টারনাল মেডিসিনথাকা প্রয়োজন যেখানে বয়স্কদের সমš^য় চিকিৎসা দেয়া যেতে পারে। 

  লেখক : প্রাক্তন অধ্যাপক, মেডিসিন , ঢাকা মেডিকেল কলেজ