ইতিহাসের আলোকে রোহিঙ্গা ইস্যু
..............
মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রী উ কিয়াও তিনের এক মন্তব্যে আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে ‘রোহিঙ্গা ইস্যু’তে বাংলাদেশ সম্পর্ক দেশটির ইতিহাস বিকৃতি ও মিথ্যাচারের বিষয়টি।
সদ্য সমাপ্ত ন্যাম সম্মেলনে উ কিয়াও তিন তার বক্তব্যে ‘ধর্মীয় নিপীড়ন’, ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ ও ‘গণহত্যার’ মতো শব্দ জুড়ে দিয়ে রোহিঙ্গা সঙ্কটকে ‘ভিন্নভাবে’ চিত্রায়ণ করেছেন বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে। দেশটিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বঞ্চিত করার কারণ ব্যাখ্যাকালে এই জনগোষ্ঠীকে ‘বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকৃত অবৈধ অভিবাসী’ বলেও আখ্যায়িত করেন তিনি।
অতীতে বহুবার মিয়ানমার সরকারের এই সচেতন মিথ্যাচারে-ভরা বানোয়াট ইতিহাসের বুলি শোনার প্রেক্ষিতে রোহিঙ্গাদের গৎবাধা ইতিহাসের একটি অংশ তুলে ধরেই সত্য জানানোর দায়িত্ব সম্পন্ন করার প্রবণতা চোখে পড়েছে। সেক্ষেত্রে কিসের ভিত্তিতে, কোন যুক্তিতে তারা এমন ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে সেগুলো খুঁজে নিয়ে তার বিপরীতে প্রকৃত সত্য উপস্থাপনের কাজটি অসম্পন্নই থেকে গেছে।
সঙ্গত কারণেই রোহিঙ্গাদের আদি ইতিহাস ও এ সংক্রান্ত নানা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে অতীতে বহু আলোচনা হলেও সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে সেগুলো পুনর্বিবেচনা করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। আলোচ্য প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইতিহাস বিশ্লেষণে প্রাপ্ত তথ্যসমূহ ও তাদের যৌক্তিক ব্যাখ্যার আলোকে দেখা নেয়া যাক- বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের আনা অভিযোগের যৌক্তিক সত্যতা কতটুকু।সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেয়ার পাশাপাশি জানতে হবে রোহিঙ্গাদের আদি ইতিহাস।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের প্রধান যে ২টি অভিযোগ
নিজেদের দাবির পক্ষে যে অকাট্য দলিলের উদ্ধৃতিকে দৈববাণী বলে ধারণ করে মিয়ানমার সেটি হলো- সেদেশের ইতিহাসবিদ খিন মং শ রচিত ‘Geopolitics of the Powers and the Bengali Problems in Burma’ নামক একটি ইতিহাস অনুসন্ধানী বিশেষ গবেষণা প্রতিবেদন।
সম্ভবত, সচেতনভাবে ইতিহাস বিকৃতির এমন আদর্শ উদাহরণ সারা বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। এই দাবির পক্ষে যথার্থ যুক্তি ও নির্ভরশীল তথ্যও রয়েছে।
বরাবরের মত এবারও মিয়ানমার সরকার দাবি করেছে রোহিঙ্গারা সে দেশের নাগরিক নয় বরং তারা বাংলাদেশি। আর অপর অভিযোগটি হচ্ছে- মিয়ানমারে কোনও জাতিগত নিধন চলে নি, সেগুলো বাংলাদেশের মনগড়া মিথ্যা অপপ্রচার। মিয়ানমারের এ সকল অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আদি ইতিহাস। আর তার তথ্য সমূহের বস্তুনিষ্ঠতাও যাচাই করতে হবে।
কেন রোহিঙ্গাদের বাঙালি পরিচয় যৌক্তিক মনে করে মিয়ানমার
মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয় না। বরং সেদেশে অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি বলে দাবি করা হয়। এর প্রেক্ষিতে যে ৩টি মূল বিষয় উপস্থাপন করা হয় তা হলো—
১. বৌদ্ধ অধ্যুষিত মিয়ানমারের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষ এই রোহিঙ্গারা মুসলমান সম্প্রদায়ের। তাদের যুক্তি, আদিবাসী হলে রোহিঙ্গাদের আদি পরিচয়ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হওয়ার কথা। তারা মুসলমান হতেই পারে না। তাদের মতে, যেহেতু নিকটবর্তী রাষ্ট্র বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান। অতএব এই মুসলমানরা সেখান থেকেই এসেছে।
২. রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাখাইন উপজাতির জনগোষ্ঠীর কিছুটা মিল রয়েছে। ফলে তাদের ধারণা, রোহিঙ্গারা আসলে বাংলাদেশের রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত।
৩. রোহিঙ্গারা কিছু কিছু বাংলা ভাষার শব্দ ব্যবহার করে থাকে যা তাদের আদি বাঙালি বলে দাবি করার অন্যতম একটি কারণ। তাছাড়া এই রোহিঙ্গা শব্দটিও বাংলা ভাষার শব্দ।
এ কথা অনস্বীকার্য যে তাদের এই দাবিগুলো সত্য। তবে আংশিক। আর নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে এই আংশিক সত্যকে পূর্ণ সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতেই তাদের এত সব সচেতন মিথ্যাচার। এক্ষেত্রে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে পুরো বিষয়টি বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে প্রকৃত সত্য কী।
ইতিহাসের পাতায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আদিমূল অনুসন্ধান
প্রাচীন ভারতবর্ষ ও ঔপনিবেশিক আমলের বর্ণিত ইতিহাসের তথ্য মতে, অষ্টম শতাব্দীর দিক থেকে বর্তমান আরাকান অঞ্চলে হজরত মোহাম্মদ (স.) এর অনুসারি তথা আরব মুসলিমদের বসবাস শুরু হয় বলে তথ্য পাওয়া যায়। যাদের বসবাস আরাকানের নিকটবর্তী ম্রক-ইউ এবং কাইয়্যুকতাও শহরতলীতেই বেশি ছিল। পরবর্তীতে অত্র অঞ্চলের আদি জনগোষ্ঠীটিই আরাকান মুসলিম জনগোষ্ঠী তথা রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সে মতে বলা যায়, এ অঞ্চলের প্রধান মুসলিম জনগোষ্ঠীটি অত্র অঞ্চলের আদিগোষ্ঠী। আর বহিরাগত মুসলমান যারা তারা এ অঞ্চলে অনুপ্রবেশকৃত বাঙালি মুসলমান নয় বরং আরব মুসলমান।
বর্তমানে আরাকান রাজ্যটি মিয়ানমার রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত হলেও এর অতীত একেবারেই ভিন্ন। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ফ্রান্সিস বুকানন ও লুই ফরিসের ইতিহাস গবেষণার আলোকে উইকিপিডিয়ায় সংযোজিত তথ্য বলছে, ‘‘আরাকান ছিল সমৃদ্ধ বৌদ্ধ অধ্যুষিত স্বাধীন রাজ্য, যা ইতিহাসে ইঙ্গো-চীনা ভাষাগোষ্ঠীর একটি শাখা সম্ভ্রান্ত ম্রক-ইউ জনগোষ্ঠীর সাম্রাজ্য হিসেবে পরিচিত। আর এই রাজ্যে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর নামই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। যা এ অঞ্চলের প্রধান ‘মগ’ জনগোষ্ঠীর একটি উপশাখা।’’
ধারণা করা হয়, রোহিঙ্গা নামটি এসেছে আরাকানের রাজধানীর নাম ‘ম্রোহং’ থেকে। ম্রোহং>রোয়াং (ম্র>র)>রোয়াইঙ্গিয়া>রোহিঙ্গা।
ইতিহাসবিদদের এই তথ্য যথেষ্ট সত্য এবং যৌক্তিক বলেই গ্রহণযোগ্য। কারণ, আরাকান তথা মিয়ানমারের প্রাচীন ইতিহাসে আরাকানের ম্রোহং নগরী ও আদিমূল জনগোষ্ঠী মগেদের শ্রেণিবিন্যাস হতে ‘রোয়াং মগ’ নামক একটি জনগোষ্ঠীর উল্লেখ পাওয়া যায়। রোহিঙ্গা নামকরণের সঙ্গে এই দুটি আদি তত্ত্বের সম্পৃক্ততা যুক্তিসঙ্গতভাবেই আরাকান অঞ্চলের আদি অধিবাসী হিসেবে তাদের বাংলাদেশ নয় বরং মিয়ানমারের নাগরিকত্বের ন্যায্য দাবিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে।
ম্রক-ইউ শাসনে এ অঞ্চলে বর্মী (মগ জলদস্যু) নামক অপর একটি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেলেও মার্মা/বার্মা/মিয়ানমার নামক কোনও ভূখণ্ডের অস্তিত্বই ছিল না। বর্মীরা দস্যুরা একাধিকবার আরাকান দখলের উদ্দেশে আক্রমণ করেছে বলে ইতিহাস হতে জানা যায়। ১৪৩০ সালের দিকে ম্রক-ইউ সম্রাট নারামেখলার শাসনকালে বর্মীদের হামলায় এ অঞ্চল ছেড়ে প্রাণ ভয়ে পলায়ন করে রোহিঙ্গা বা রোয়াংরা সম্রাট নারামেখলাসহ তৎকালীন গৌড় (বাংলা) অঞ্চলে নির্বাসিত হয়। সে সময় বাংলার শাসক সুলতান গিয়াসউদ্দিন মুহম্মদ শাহ এই রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান করেন। তার মৃত্যুর পর বাংলার সুলতান হন জালালউদ্দিন মুহম্মদ শাহ। দীর্ঘ প্রায় ২৪ বছর বাংলায় নির্বাসিত থাকার পরে সুলতান জালালউদ্দিন, সম্রাট নারামেখলার সঙ্গে অন্যায় হয়েছে বলে দাবি করেন এবং তাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন।
পরবর্তীতে সুলতানের নির্দেশে ৩০ হাজার মুসলিম সেনার একটি চৌকস বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য আরাকান আক্রমণ করেন সম্রাট নারামেখলা। অল্প সময়ের মধ্যে মুসলিম সেনারা বর্মীদের পরাজিত করে আরাকান দখল করে নেয় এবং সম্রাটকে ক্ষমতায় পুনর্প্রতিষ্ঠা করে। সে সময় বাংলার মুসলিম সুলতানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশস্বরূপ সম্রাট নারামেখলা নিজে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং মোহাম্মদ সোলায়মান শাহ্ নামে আরাকানের সিংহাসনে আসীন হন। এরপর বংশানুক্রমে আরাকানে মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিস্তার শুরু হয়। এ সময় যে সব বাঙালি সেনারা সম্রাটের সাথে এসেছিল তারা নারামেখলার অনুরোধে আরাকানে বসবাস করতে শুরু করেন। সম্রাট নারামেখলা বাংলার সুলতানের দেয়া কিছু অঞ্চল ও আরাকানের ওপর সার্বভৌমত্ব অর্জন করেন। এই ম্রাউক-উ রাজবংশ ১০০ বছর আরাকান শাসন করেছে।
কিন্তু ১৭৮৪ সালে বর্মী রাজা বোডপায়া আরাকান দখল করে বার্মার অধীনস্ত করদ রাজ্যে পরিণত করেন। অর্থাৎ বার্মার উৎপত্তি আরাকানের বহু পরে। এই তথ্য সুস্পষ্টতই এ অঞ্চলের আদিবাসী হিসেবে রোহিঙ্গাদের পরিচয় প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক সাক্ষী বহন করে। এরপর থেকেই আরাকানের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর শুরু হয়ে নির্মম ব্যাভিচার ও জাতিগত নিধন। লক্ষ্য- এই রোহিঙ্গা জাতি এবং তাদের সাহায্যকারী বাংলার মুসলিম শাসকগোষ্ঠীর সহায়তা নিয়ে এককালে এই বর্মী জনগোষ্ঠির পূর্বপুরুষদের বিতাড়িত করার প্রতিশোধ নেয়া। যা আরাকানের রোহিঙ্গা নামক মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর কট্টর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বর্মীদের রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসারই বহির্প্রকাশ। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল রোহিঙ্গাদের তাদের মূল আদিভূমি হতে উচ্ছেদ করে এই জনগোষ্ঠির অস্তিত্ব শেষ করে দেয়া।
ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের নির্লজ্জ মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক—
১. রোহিঙ্গাদের ইতিহাস বর্ণনায় এই জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাখাইন জনগোষ্ঠীর বলে দাবি করে মিয়ানমার। তাদের তত্ত্বমতে, রাখাইন থেকে রোহিঙ্গা নামের উৎপত্তি। কিন্তু কোন ভাষারীতি অনুসারে তারা এই নামকরণের ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছে বা এই নামের বাংলা আদিমূল কি সে সম্পর্কে বিস্তারিত কোনও তথ্যই দেয়া হয় নি।
পক্ষান্তরে- ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটির উৎপত্তি অনুসন্ধানে যৌক্তিকভাবেই দেখা যায়, এর আদিমূল বর্তমানের মিয়ানমার অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ভাষারীতির মূলে গ্রোথিত। যা এই রূপ— বর্তমানে আরাকান রাজ্যটি মিয়ানমার রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত হলেও এর অতীত একেবারেই ভিন্ন। আরাকান ছিল সমৃদ্ধ বৌদ্ধ অধ্যুষিত স্বাধীন রাজ্য, যা ইতিহাসে সম্ভ্রান্ত ম্রক-ইউ জনগোষ্ঠীর সাম্রাজ্য হিসেবে পরিচিত। আর এই রাজ্যে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নামে পরিচিত। ধারণা করা হয়, রোহিঙ্গা নামটি এসেছে আরাকানের রাজধানীর নাম ম্রোহং থেকে। ম্রোহং>রোয়াং (ম্র>র যেমন- সিন্ধু>হিন্দু>হিন্দ-হিন্দুস ভ্যালি>ইন্দ-ইন্দাস ভ্যালি>ইন্ড)>রোয়াইঙ্গিয়া>রোহিঙ্গা।
অপর একটি তথ্য মতে, রইয়ন বা রোয়ান (নদী তীরবর্তী) ও ইঙ্গম বা সঙ্গম (মোহনা) এই দুইটি মূলশব্দ থেকে উৎপন্ন। তবে মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যে আরাকানকে ডাকা হতো ‘রোসাং’ নামে।ইঙ্গো-আর্য ভাষা-ভাষি জনগোষ্ঠীর আদি ভাষাতত্ত্ব (উইকিপিডিয়া)।
২. বর্মী ইতিহাসবিদদের দাবি— রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব যদি মিয়ানমারের আদিবাসী হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হতো তবে ঔপনিবেশিক শাসনামলে বর্ণিত ইতিহাসের কোথাও এই নামের উল্লেখ নেই কেন? তার মানে রোহিঙ্গা বলে মিয়ানমারের ইতিহাস সংশ্লিষ্ট কোনও কিছু নেই। অথচ ১৭৯৯ সালে রচিত ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ফ্রান্সিস বুকানন আরাকানের আদি জনগোষ্ঠী হিসেবে এই রোহিঙ্গাদের কথা উল্লেখ করেছেন। যাদের একটি বড় অংশ ছিল মুসলমান।
এ কথা সত্য ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি সরাসরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাসে উল্লেখ নেই। কারণ, রোহিঙ্গা এ অঞ্চলের বহু স্থানীয় আদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি গোষ্ঠীর আঞ্চলিক ভাষায় রচিত নাম। আর ব্রিটিশরা প্রতিটি জনগোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন নয় বরং বৃহত্তর অঞ্চলভেদে নামকরণ ও পরিচয় প্রদান করতো। যেমন- গাঙ্গত্রী>গঙ্গারিডাই>গঙ্গারিড/রিজ, বঙ্গ>বেঙ্গল, সিন্ধ>হিন্দ(হিন্দুস্তান)> ইন্দ/ইন্ড(ইন্ডিয়া)।
একইভাবে এই রোহিঙ্গারা ব্রিটিশ ইতিহাসে আরাকান (অরখং/অরখাং>আরকান/আরাকান) রাজ্যের অধিবাসী হিসেবে পরিচিত। যাদের ‘আরকান’ জনগোষ্ঠী হিসেবে ১৯৩১ সালের আদমশুমারিতে অন্তর্ভূক্ত করে ব্রিটিশ রাজ। যার ৩৬% ছিল মুসলিম। আর এই মুসলিম জনগোষ্ঠীটির আদিমূল কোথায় তা আগেই বর্ণিত হয়েছে।
৩. বর্মী ইতিহাসের তথ্যমতে, যদি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আদিভূমি সত্যিই বঙ্গীয় বা গৌড় অঞ্চল হতো, তবে তাদের সাম্প্রদায়িক পরিচিতির ক্ষেত্রে সনাতন ধর্মের প্রাধান্য বেশি থাকতো। কারণ, বঙ্গীয় অঞ্চলের আদিমূল অনুসন্ধানে দেখা যায়, এ অঞ্চলের মানুষের সাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্য— তারা সনাতন ধর্মাবলম্বী।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসের তথ্য মতে দেখা যায়, তারা বৌদ্ধ ধর্মের একনিষ্ট ধারক। অর্থাৎ তাদের মূলে সনাতনতত্ত্ব নয় বরং ইঙ্গো-চীনা ধারার অন্তর্গত মোঙ্গলীয় ধর্মতত্ত্বের অস্তিত্বই বিরাজমান। যার প্রভাব তাদের ভাষারীতিতেও বিদ্যমান। ধারণা করা হয়, এই মোঙ্গলীয় জাতিগত পরিচিতির ধারক হওয়াতেই এই অঞ্চলের মানুষ বাংলা ভাষায় ‘মগ’ নামে পরিচিত ছিল। সেক্ষেত্রে কি করে তারা বঙ্গীয় অঞ্চলের আদিগোষ্ঠী হতে পারে?
ইতিহাস বলছে, আরাকানের মুসলমানরা বার্মিজ মগদের চেয়ে সুপ্রাচীন। বর্মীদের কয়েক শ বছর আগে থেকে সেখানে মুসলমানদের বসবাস। ইতিহাসের ব্যাখ্যা মতেও এই তথ্য সঠিক। বর্মীরা যখন আরাকান দখল করে স্থায়ী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে তখন সম্রাট নারামেখলা ধর্মান্তরিত মুসলিম শাসক হিসেবে ক্ষমতায় ছিলেন। তারও আগে অষ্টম শতকেই আরব মুসলিমরা এ অঞ্চলে বসবাস শুরু করেছিলেন বলে ইতিহাসে তথ্য রয়েছে। ইতিহাসবিদ জি ই হার্ভে উল্লেখিত আরাকানি সূত্রে জানা যায়, ‘‘আরাকানে ১০ কিংবা ১২ শতকের আগে বর্মী অনুপ্রবেশ ঘটে নি। এ তথ্য অনুসারি ৮ম শতকের আরাকানবাসী রোয়াং মগ তথা রোহিঙ্গারাই এ অঞ্চলের আদি অধিবাসী হিসেবে প্রমাণিত। (Harvey, G E, History of Burma. p-137-313)
এদিকে যৌক্তিকভাবেই, বর্মীরা যে (বর্তমান মিয়ানমারের প্রধান জনগোষ্ঠী) রোহিঙ্গাদের আদিমূল জানে না তা প্রমাণ হয়। সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ ভা অন্য কোনও অঞ্চলের আদি জনগোষ্ঠী বিবেচনায় তারা বহিরাগত বলে দাবি করতে পারে না। বরং তারাই মিথ্যাচার ও প্রহসন সৃষ্টির মাধ্যমে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আদি ইতিহাসকে প্রত্যাখান করছে, নিজেদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।
৪. আরাকানের রোহিঙ্গারা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বার্মায় অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশী শরণার্থী হিসেবে দাবি করার বিষয়টিও যে একেবারে অবান্তর, তারও প্রমাণ রয়েছে ইতিহাসে। মিয়ানমারের ভাষ্যমতে, একাধিকবার বাংলাদেশিরা সে দেশে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশটির অনুপ্রবেশ ঘটে ১৯৭১ সালে। আর তারাই আজকের রোহিঙ্গা।অথচ ১৯৭১ সালে রচিত বাঙালির সেই সংগ্রামী ইতিহাসের প্রেক্ষাপট সে সময় বিশ্বব্যাপী
আলোচিত ছিল। যার প্রেক্ষিতে যে সকল ইতিহাসভিত্তিক দলিলাদি রয়েছে তার সর্বত্র উল্লেখ রয়েছে বাঙালি শরণার্থীদের ভারতে যাওয়ার বিষয়টি। সে সময় তিন লক্ষাধিক বাঙালি যদি বার্মা গিয়ে থাকতো, তার উল্লেখ কোথাও না কোথাও অবশ্যই থাকতো। অথচ এমন কোনও ভূতুরে ইতিহাসের অস্তিত্ব কোথাও নেই।
পক্ষান্তরে, ১৯৭৮, ১৯১৯-৯২, ২০১২, ২০১৫ এবং ২০১৬-১৭ সালে ততোধিকবার মিয়ানমার সামরিক জান্তার নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সুস্পষ্ট তথ্য ইতিহাসে বিদ্যমান। তথ্যসূত্র- অ্যামিনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল/ইউএনএইচসিআর/ইউএন।
জ্ঞানপাপী ‘জিন্নাহ’র আরও একটি ঐতিহাসিক ভুল
বিশ্লেষকরা মনে করেন, জিন্নাহ আরাকানের ব্যাপারে সঠিক ভূমিকা গ্রহণ করলে আজ রোহিঙ্গাদের ইতিহাস ভিন্ন হতে পারত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে আরাকান মিয়ানামার থেকে আলাদা হতে চেয়েছিল। কেননা ঐতিহাসিকভাবে আরাকান মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের অংশ ছিল না। বার্মিজরা এক সময়ের স্বাধীন আরাকান দখলে নেয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) সঙ্গে একীভূত হতেও মত দেয় আরাকান নেতৃত্ব। নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে ১৯৪৬ সালে ‘আরাকান মুসলিম লীগ’ গঠন করে তারা। কিন্তু জিন্নাহর ঐতিহাসিক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আরাকান বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে নি। পারে নি তার স্বাধীন অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনতে। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত না করলেও সে সময় তাদের স্বাধীন থাকার সুযোগ করে দেয়া যেত। কিন্তু এ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। এর দায় জিন্নাহর। তিনি আদৌ মুসলিম ছিলেন কি না, সে ব্যাপারেই অনেকের সন্দেহ।
জিন্নাহ ছিলেন খোজা মুসলিম। হিন্দু লোহানা জাতি থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছে তারা। এরা শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। বার্নার্ড লিউইস খোজাদের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘এরা মুসলিম আচ্ছাদনের তলায় হিন্দু মনোভাবাপন্ন।’ তথ্যসূত্র- যশোবন্ত সিংহ, ‘জিন্না ভারত দেশভাগ স্বাধীনতা’, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, পৃষ্ঠা : ৬২।
ইতিহাসের অকাট্য দলিলাদির প্রেক্ষিতে মিয়ানমারের ইতিহাস বিকৃতি, বাংলাদেশ সম্পর্কে বানোয়াট মিথ্যাচার ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে অবান্তর তথ্য উপস্থাপনের নির্লজ্জতা থামবে কি না তা বলা কঠিন। তবে তাদের এই উদ্ভ্রান্ত মিথ্যাচার যে সত্য প্রতিষ্ঠা করে তা হলো, ন্যায্যত রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের আদি জনগোষ্ঠী হিসেবে সেদেশের নাগরিকত্ব এবং নাগরিক অধিকার প্রাপ্য। আর সেই অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করে, গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের মত ন্যাক্কারজনক বর্বতার শিকারে পরিণত করার অপরাধে অং সাং সু চি ও তার সামরিক জান্তা সরকার দোষী-সাব্যস্ত হয়।
পাশাপাশি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি সৃষ্টির ধৃষ্টতা ও ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের জন্য মিয়ানমারের শক্ত জবাবদিহি আবশ্যক। বাংলাদেশ সরকার এবং এদেশের মানুষের নিরবতাকে দুর্বলতা হিসেবে মূল্যায়ণ করা তাদের নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। মিয়ানমার সরকারের ভুলে গেলে চলবে না, তারা এমন একটি জাতি সম্পর্কে মিথ্যাচার করছে যে জাতির আদর্শ মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। যাদের ইতিহাসের সৌর্য্য বিশ্বনন্দিত। তারা এমন একটি শান্তি প্রিয় জাতিকে সামরিক আগ্রাসনের প্রচ্ছন্ন হুমকি দেয়ার অপচেষ্টা করছে যারা মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব রক্ষায়, হিংস্র বাঘের মত আগ্রাসি হয়ে উঠতে জানে।
ইতিহাস সাক্ষী ষড়যন্ত্র, অপবাদ, মিথ্যাচার বা অন্যায় পেশির জোর- কোনও কিছু দিয়েই বাঙালি জাতিকে কেউ কখনও দাবিয়ে রাখতে পারে নি, কোনওদিন পারবেও না।
তথ্যসূত্র সহায়ক ● রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস- ইতিহাস গবেষক এন. এম. হাবিব উল্লাহ্, এপ্রিল-১৯৯৫ * বৈদিক ভারত - ভাষাতাত্ত্বীক ও প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস গবেষক মাসুম খান * "Myanmar wants ethnic cleansing of Rohingya - UN official"- BBC * "Meet the most persecuted people in the world"- Lennart Hofman * "The Rohingya people of Myanmar: health, human rights, and identity"- Mahmood, W. Wroe & J. Fuller * Harvey, G E, History of Burma. * The History of Rohinga People- WIkipedea * Amnesty Internationa, UNHCR, UN.
এসকে/এসএমএম