• ঢাকা
  • সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১, ২০২০, ০১:৩৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ১, ২০২০, ০১:৪১ পিএম

চীনা গবেষকদের ‍‍‘ভারতীয় করোনা তত্ত্ব‍‍’ ভিত্তিহীন

চীনা গবেষকদের ‍‍‘ভারতীয় করোনা তত্ত্ব‍‍’ ভিত্তিহীন
- প্রতীকী ছবি

সম্প্রতি করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে একদল চীনা গবেষকের প্রচারিত তথ্য নিয়ে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। তারা বলছেন এক নতুন গবেষণার ভিত্তিতে তারা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন। সেটি হলো, চীন নয় বরং দক্ষিন এশিয়ার দেশ ভারত থেকে উৎপত্তি ঘটেছে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মহামারি রুপে বিস্তার লাভ করা প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। হংকংভিত্তিক সংবাদমাধ্যম চায়না মর্নিং পোস্ট এবং ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ডেইলি মেইল প্রকাশিত প্রতিবেদনে এই বিষয়টি উল্লেখিত হয়।

বাংলাদেশ ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে এই সংবাদটি গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা মতও প্রচারিত হচ্ছে। তবে চীনা গবেষকদের এই দাবির সত্যতা যাচাইয়ে দেখা গেছে, ভারতে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি সম্পর্কিত যে ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং অগ্রহণযোগ্য।

যে দাবি উত্থাপন করছে চীনা গবেষক দল :
নামকরা আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা এলসিভিয়ারের মালিকানাধীন প্রি-প্রিন্ট সার্ভার সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ নেটওয়ার্ক (এসএসআরএন)-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা নিবন্ধে চাইনিজ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসের বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন, চীনের উহান শহর নয় বরং দক্ষিন এশিয়ার দেশ ভারত থেকে উৎপত্তি ঘটেছে করোনাভাইরাসের। এই দাবির প্রেক্ষিতে দলটি বলছে, গত গ্রীষ্মে ভারতব্যাপী যে তাপপ্রবাহ সৃষ্টি হয় সেই সময় উৎপত্তি ঘটে করোনাভাইরাসের। সে সময় প্রচণ্ড গরমে মরিয়া হয়ে মানুষ ও প্রাণীরা বিভিন্ন অঞ্চলের জলাশয়গুলো থেকে পানি পান করে। একই জলের উৎস হতে মানুষ ও বিভিন্ন পশু-পাখি পানি পান করার মাধ্যমে ক্রমাগত বিস্তার ঘটতে থাকে করোনার। এক পর্যায়ে সেটি ব্যাপক আকার ধারন করলে প্রকাশ্যে চলে আসে ঘাপটি মেরে থাকা ভাইরাসটির তথ্য। পরবর্তীতে সেটি নিকটবর্তী রাষ্ট্র বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হয় এবং ধীরে ধীরে এই দুই রাষ্ট্র থেকে ব্যাপক হয়ারে ছড়াতে শুরু করে।

তারা বলছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে উহানে প্রথম যে সংক্রামক করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়, তার মিউটেশন বেশি ছিল। ওই নমুনার চেয়েও কম মিউটেশনের ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে আটটি দেশে: বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, গ্রিস, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইতালি, চেক রিপাবলিক, রাশিয়া এবং সার্বিয়া। সর্বকোষীয় ভাইরাস পুনরুৎপাদনের জন্য প্রাকৃতিকভাবে নিজেদের পরিবর্তন করে। এর অর্থ তাদের ডিএনএ’তে প্রতিবার ছোট ছোট যে পরিবর্তন হয়, তার মাধ্যমে তারা নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করে।

এই যুক্তিকে সামনে এনে চীনা বিজ্ঞানীরা বলেন, সবচেয়ে কম পরিবর্তন বা মিউটেশনের নমুনা শনাক্ত করে ভাইরাসের ‘আসল ভার্সন’ পাওয়া যাবে। তাদের দাবি, ভারত এবং বাংলাদেশে যে স্ট্রেইন পাওয়া গেছে, তাতে অনেক কম মিউটেশন। মানে সেখান থেকে আগে ছড়িয়ে থাকতে পারে। দুটি দেশ যেহেতু ভৌগোলিকভাবে পাশাপাশি তাই এই মহাদেশে সম্ভাবনা বেশি দেখছেন তারা।

বিজ্ঞানীরা নিবন্ধে লিখেছেন, ‘উহান শহরে সার্স-কভ-২ ভাইরাসের যে স্ট্রেইন শনাক্ত হয়, তা সব সার্স-কভ-২ ভাইরাসের পূর্বপুরুষ হওয়া অত্যন্ত অসম্ভব। কম মিউটেশনের স্ট্রেইন যে আটটি দেশে পাওয়া গেছে, তার যেকোনোটিতে নতুন করোনাভাইরাসের জন্ম হতে পারে।’ যে আটটি দেশের কথা বলা হচ্ছে, এর মধ্যে আবার বাংলাদেশ-ভারতকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হচ্ছে।

যে কারণে ধোপে টিকছে না চীনা গবেষকদের 'ভারতীয় করোনাভাইরাস' তত্ত্ব :
করোনাভাইরাসের উৎস সম্পর্কে চীনা গবেষকদের  এই চাঞ্চল্যকর তথ্য এরইমধ্যে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। বিশ্বের একাধিক গবেষক ও গবেষনা কেন্দ্রগুলো এই দাবিকে বলছেন, ভারত বিরোধী অপপ্রচারের লক্ষ্যে চীনা গবেষকদের হাস্যকর প্রয়াস মাত্র'। যার সত্যতা পাওয়া যায় গবেষনা পত্রে উল্লেখিত তথ্যের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপুর্ণ কয়েকটি বিষয়ের অনুসন্ধানে।

প্রথমত এই গবেষক দলের দাবি অনুস্বারে 'ভারতে গত তাপপ্রবাহ চলাকালীন করোনা উৎপত্তির যে তথ্য দেয়া হয়েছে তার প্রেক্ষাপট অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২০ সালে ভারতব্যাপী যে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ সৃষ্টি হয়, তা প্রকট হয় মার্চের শেষ নাগাদ। আর এপ্রিলের শুরু থেকে সেটি ব্যাপক রূপ ধারণ করে। সে সময় ভারতের সংকটাপন্ন পরিস্থিতি তুলে ধরে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স। ৯ এপ্রিল প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনের শুরুতেই ভারতের পরিস্থিতি তুলে ধরে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করা করোনাভাইরাস সংক্রমণের জেরে লকডাউনে অবরূদ্ধ ভারত প্রচণ্ড সংকটের মাঝে রয়েছে। একদিকে লকডাউনের ফলে স্থবির জীবন, তার ওপর পরিস্থিতি প্রকট করে তুলেছে ভয়াবহ তাপপ্রবাহ। অর্থাৎ, যে সময় এই প্রকট তাপপ্রবাহ ভারতজুড়ে বইতে শুরু করে; তারও আগেই করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে লকডাউনে অবরুদ্ধ ছিল দেশটি।

দ্বিতীয়ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণা সংস্থা - মায়ো ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞ ড. উইলিয়াম এফ মার্শাল করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও এর বিস্তার সংক্রান্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। মায়ো ক্লিনিকের অফিশিয়াল ওয়েব পেজে প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত নানা প্রশ্নের উত্তর প্রদান ও জরুরি তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে। এই প্রতিবেদনটিতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট কোভিড-১৯ পানিবাহী রোগ বা এটি সম-উৎসের পানি ব্যবহারের ফলে এক দেহ থেকে অন্য দেহে সংক্রমণ সৃষ্টি করতে পারে- এ ধরনের কোনো তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি। তাছাড়া এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণায় এই বিষয়ে গ্রহণযোগ্য কোনো ধারণাও প্রতিষ্ঠিত নয়। 

আরো কয়েকটি গ্রহণযোগ্য সূত্রের তথ্য অনুসন্ধানে ড. মার্শালের মতো একই তথ্য জানা গেছে । তাছাড়া করোনাভাইরাস যদি পানিবাহী বা একই উৎসের পানি ব্যবহারের কারণে সংক্রমণ সৃষ্টি করতো, তাহলে এতদিনে নিশ্চয়ই বিষয়টি আমলে নিয়ে তা গুরুত্বের সঙ্গে নিজেদের নির্দেশনাপত্র ও করোনাভাইরাস সংক্রান্ত অনুসন্ধানে উল্লেখ করতো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। অর্থাৎ একই জলাশয় থেকে পানি পানের ফলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সৃষ্টির এই চীনা তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাটিও ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়, যা তারা ভারতের ক্ষেত্রে প্রয়োগের চেষ্টা চালিয়েছে।

বিশেষজ্ঞ অভিমত :
চীনা বিজ্ঞানীদের এমন দাবি মূলত নতুন কিছু নয়। করোনার জন্য অন্য দেশকে দায়ী তারা অনেক আগে থেকেই করছে। ভারত-বাংলাদেশের নব্যতত্ত্ব প্রচারের আগে করোনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দোষী দাবি করেছিল দেশটির সরকার।
স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞ ডেভিড রবার্টসন ডেইলি মেইলকে বলেছেন, ‘এই পেপার খুবই ত্রুটিপূর্ণ। করোনা নিয়ে আমাদের ধারণার সঙ্গে এটি নতুন কিছুই যোগ করতে পারেনি।’

মেইল অনলাইনের কাছে পাঠানো বিবৃতিতে প্রফেসর রবার্টসন বলেছেন, ‘তুলনামূলক কম মিউটেশনের ভাইরাস সিকোয়েন্স শনাক্ত করতে লেখকদের যে প্রচেষ্টা দেখা গেছে, সেটি স্পষ্ট পক্ষপাতদুষ্ট।’

‘এই গবেষকেরা ব্যাপক মহামারির ডেটা এড়িয়ে গেছেন। বিস্তৃত মহামারির তথ্য থেকে খুব সহজে বোঝা যায় রোগটি চীন থেকেই ছড়িয়েছে।’
এই নিবন্ধের মূল্য কতটুকু: এলসিভিয়ারের যে সার্ভারে এটি প্রকাশিত হয়েছে, সেটি মূলত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণা সাময়িকী দ্য ল্যানসেটের প্রিপ্রিন্টস। অর্থাৎ ল্যানসেটে প্রকাশিত হওয়ার আগে এখানে বিজ্ঞানীরা তাদের ফলাফল প্রকাশ করেন। এটি পিয়ার রিভিউড জার্নাল নয়।
উল্লেখ্য, যেকোনো গবেষণার জন্য পিয়ার রিভিউড (স্কলারলি বা রেফারিড) জার্নাল খুব গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এখানে বিশেষজ্ঞদের যেসব আর্টিকেল প্রকাশ করা হয়, তা প্রকাশিত হওয়ার আগে এই বিষয়ের একাধিক বিশেষজ্ঞ (রেফারি হিসেবে যারা কাজ করেন) বার বার পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এই ধরনের জার্নালে প্রকাশিত আর্টিকেলকে ‘সর্বোচ্চ’ মানের ধরা হয়।

এদিকে ঢাকাস্থ চীনের উপরাষ্ট্রদূত ইয়ান হুয়ালং তার ফেসবুক পেজে  এ সংক্রান্ত ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি সংবাদের লিংক শেয়ার করে ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘ফেইক নিউজ!’

হুয়ালংয়ের কমেন্টে কয়েকজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘এ ধরনের নিউজ ভারতের মিডিয়া ছড়াচ্ছে। তাই চীনের উচিত একটা বিবৃতি দেয়া।’ যাতে দেখা যাচ্ছে, 'ভারত করোনার উৎস' এই দাবি ভিত্তিহীন প্রমাণ হলেও এবার 'ভুয়া সংবাদ প্রচার করে ভারত ফায়দা নিতে চাচ্ছে'- এমন একটি পরোক্ষ প্রচারণার প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হচ্ছে। যেখানে কিনা এই সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ডেইলি মেইল ও হংকং-ভিত্তিক গণমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে।

এসকে