• ঢাকা
  • সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২২, ০৩:৫৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২২, ০৩:৫৫ পিএম

ইউক্রেন নিয়ে উত্তেজনার মধ্যেই বেইজিং সফরে পুতিন

ইউক্রেন নিয়ে উত্তেজনার মধ্যেই বেইজিং সফরে পুতিন

ইউক্রেন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে উত্তেজনার মধ্যেই চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে গেলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

শুক্রবার শীতকালীন অলিম্পিকসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আমন্ত্রণে এই সফরে গেলেন তিনি।

কিন্তু ইউক্রেন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পুতিনের এই চীন সফর বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছে। অলিম্পিকসের উদ্বোধনের চেয়ে এই দুই নেতার মধ্যে কী কথা হচ্ছে, তা নিয়েই আগ্রহ বিশ্বের।
 
প্রেসিডেন্ট পুতিন ও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং শুক্রবার যে বৈঠক করবেন, তাতে যে ইউক্রেন নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতিই প্রাধান্য পাবে তা নিয়ে পর্যবেক্ষকদের মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নিজে গত দুই দিনে চীনা বিভিন্ন মিডিয়াকে যেসব সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তা থেকেও স্পষ্ট যে 'আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক' পরিস্থিতি নিয়ে চীনা প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলার অপেক্ষায় রয়েছেন তিনি।

ব্যবসা, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তাসহ নানা ক্ষেত্রে, বিশেষ করে গত এক দশকে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক যে মাত্রায় বেড়েছে, তাতে দুইপক্ষের মধ্যে কথা বলার বিষয়ের কোনো অভাব নেই।

তবে ইউক্রেন নিয়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার হুমকির মুখে পাশে থাকার জন্য চীনের কাছ থেকে তিনি যে স্পষ্ট একটি অঙ্গীকার শুনতে চাইবেন, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কারণ তিনি জানেন যে একমাত্র চীনই তার দেশকে সম্ভাব্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থেকে বাঁচানোর ক্ষমতা রাখে।

নিষেধাজ্ঞায় ভরসা কেন চীন?
২০১৪ সালে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া নিয়ে নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলো যখন রাশিয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেয়, তখনও প্রেসিডেন্ট পুতিন চীনের দিকে তাকিয়েছিলেন এবং সাড়া পেয়েছিলেন।

আমেরিকার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বেইজিং শুধু তেল এবং গ্যাস কেনা নিয়েই মস্কোর সাথে চারশো' বিলিয়ন ডলারের (৪০,০০০ কোটি ডলার) চুক্তি সই করে, যা সেই সময়ে রাশিয়াকে অর্থনৈতিক ভরাডুবি থেকে থেকে বাঁচিয়েছিল।
 
অবশ্য অনেক পর্যবেক্ষক বলেন, রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল নিয়ে চীন অস্বস্তিতে পড়লেও সস্তায় এবং সহজ শর্তে রাশিয়ার জ্বালানি সম্পদ কেনার সুযোগ তারা তখন হাতছাড়া করেনি।

কিন্তু সম্ভাব্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে আবারও পুতিনকে সেই ভরসা কি দেবেন শি জিনপিং?

যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট (আইপিআরআই)-এর ইউরেশিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক ক্রিস মিলার মনে করেন যে চীন এবং রাশিয়ার মধ্যে 'অবিচল ভূ-রাজনৈতিক মৈত্রী এবং ঐক্যের' একটি বার্তা বেইজিংয়ের বৈঠক থেকে দেয়া হবে।

আইপিআরআই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে তিনি লিখেছেন, প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের ইস্যুতে ২০১৪ সালের পর গত আট বছরে চীন এবং রাশিয়া দিন দিন আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে।

অভিন্ন শত্রু আমেরিকা
ক্রিস মিলার বলেন, ‘স্ট্যালিন এবং মাও সে তুংয়ের পর দুই দেশের মধ্যে এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কখনই হয়নি, এবং এর পেছনে কাজ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দুই দেশের রেষারেষি। দুই দেশই দেখেছে তাদের পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা নীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ একটি দেশ, তাদের প্রধান সমস্যার কেন্দ্র অভিন্ন - যুক্তরাষ্ট্র।’

এই অভিন্ন শত্রুকে মোকাবেলার কৌশল হিসাবে ঐক্যের তাড়না থেকে ব্যবসা-অর্থনীতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়ার সম্পর্ক গত বছরগুলোতে দ্রুতগতিতে বাড়ছে।
 
চীন এখন রাশিয়ার তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রধান ক্রেতা, আধুনিক অস্ত্রের বড় ক্রেতা। রাশিয়ার রফতানি আয়ের ২৫ শতাংশ আসে চীন থেকে।

গত বছর দুই দেশের মধ্যে ব্যবসার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০১৫ সালে ছিলো ৬৮ বিলিয়ন ডলার।

২০১৯ সাল থেকে পাইপলাইন দিয়ে চীনে রাশিয়ার গ্যাস যাচ্ছে। দ্বিতীয় আরেকটি পাইপলাইন বসানোর চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

পুতিন-শি ঘনিষ্ঠতা
রাশিয়া আর চীনের নেতারা তাদের সম্পর্ক নিয়ে আবেগ প্রকাশে কোনও দ্বিধা করেন না।
চীনের সবচেয়ে প্রভাবশালী কূটনীতিক ইয়াং জিয়েচি সম্প্রতি রুশ-চীন সম্পর্ককে ‘ইতিহাসের সর্বোত্তম’ বলে বর্ণনা করেছেন। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ এই সম্পর্ককে ‘২১ শতকের দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার একটি মডেল’ বলে মন্তব্য করেছেন।

শি জিন পিং রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে তার 'সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু' সম্বোধন করেন। পুতিনও চীনের প্রেসিডেন্টের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তার মতে, চীনা নেতা একজন 'অত্যন্ত মেধাবী' বিশ্বনেতা।

দুই প্রেসিডেন্ট নিয়মিত নিজেদের মধ্যে কথা বলেন। ২০১৩ সাল থেকে তারা দুজন কখনও মুখোমুখি আবার কখনও ভিডিও কনফারেন্সে ৩৭ বার কথা বলেছেন। বেইজিংয়ে শুক্রবারের বৈঠকটি হবে তাদের মধ্যে ৩৮তম।

চীনের নিজের স্বার্থ
অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, শুধু সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বা রাশিয়ার চাওয়া নয়, ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিনের পক্ষ নিয়ে আমেরিকাকে কোণঠাসা করার পেছনে চীনের নিজস্ব ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে।

ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের ক্রিস মিলার বলেন, ইউক্রেন নিয়ে আমেরিকার আপোষহীন অবস্থান দেখে চীন তাইওয়ান নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে।
 
ক্রিস মিলার বলেন, ‘ইউক্রেন নিয়ে আমেরিকা যে কট্টর অবস্থান নিয়েছে, সেটাকে বেইজিং একটি বার্তা হিসাবে দেখছে। চীন মনে করছে তাইওয়ান বা দক্ষিণ চীন সাগরের ইস্যুতেও যে তারা এমন কঠোর অবস্থান নেবে, সেই ইঙ্গিত যুক্তরাষ্ট্র দিচ্ছে।’

সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন নিয়ে রেষারেষিতে সফল হোক চীন তা চায় না।

ফলে মিলার মনে করেন, ইউক্রেনের সাথে চীনের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকলেও বা সেদেশে রুশ সামরিক অভিযানে অস্বস্তি বোধ করলেও, কোনো যুদ্ধ বাধলে চুপ করে থাকা চীনের জন্য এ দফায় শক্ত হবে।

তবে এই সংকট নিয়ে চীনা নেতারা যেসব কথা বলছেন বা চীনা সরকারি মিডিয়াতে যেসব কথা বলা হচ্ছে, তাতে আক্রমণ করা হচ্ছে শুধু যুক্তরাষ্ট্রকে। ইউক্রেনের কথা তারা বলছেন না।

চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়াং ই গত সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে টেলিফোন করে বলেছেন যে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণ নিয়ে রাশিয়ার উদ্বেগ যথার্থ এবং তাকে বিবেচনা করতে হবে।

খুব শক্ত কথা এখনো চীন বলেনি, তবে গবেষণা সংস্থা কার্নেগির মস্কো সেন্টারের গবেষক আলেকজান্ডার গাবুয়েভকে উদ্ধৃত করে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ইউক্রেন নিয়ে সৃষ্ট টানাপোড়েনে চীনের গভীর স্বার্থ জড়িয়ে আছে, এবং চীন সময় ও সুযোগমত তৎপর হবে।

গাবুয়েভের মতে, দুই দিক থেকে চীনের স্বার্থ জড়িত।

তিনি বলেন, ‘প্রথমত, ইউরোপে কোনো বড় সংকট তৈরি হলে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে এতটাই জড়িয়ে পড়বে যে চীনকে কোণঠাসা করার দিকে নজর রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। আর দ্বিতীয় লাভটি হচ্ছে, রাশিয়া চীনের আরও কাছাকাছি চলে আসতে বাধ্য হবে এবং চীনের শর্ত মেনেই তাদের আসতে হবে।’

তবে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন বিশ্ব ব্যবস্থায় মার্কিন প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ করার কৌশল হিসাবে ১৯৯৬ সাল থেকেই চীন এবং রাশিয়া একটি অভিন্ন প্লাটফর্ম তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করে। এর পেছনে দুই দেশের সমান স্বার্থ রয়েছে।
 
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর রাশিয়ার পক্ষ থেকে পশ্চিমা বিশ্বের কাছাকাছি আসার চেষ্টা স্বত্বেও যেভাবে আমেরিকা পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণ করে গেছে, সেই ভীতি থেকে মস্কো চীনের দিকে ঝুঁকেছে।

১৯৯৬ থেকে পরের কয়েক বছরে চীন ও রাশিয়া তাদের সীমান্ত সমস্যাগুলো সমাধান করে ফেলে। তারপর ২০০১ সালে তারা একটি মৈত্রী চুক্তি করে। এবং তার ওপর ভিত্তি করে দুই দেশ কৌশলগত সম্পর্কের কিছু কাঠামো তৈরি করে ফেলেছে। সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) তেমন একটি প্রতিষ্ঠান।

নিজেদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে - যেমন ইরান, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া - দুই দেশ এখন অভিন্ন সুরে কথা বলছে। যুক্তরাষ্ট্রের তোয়াক্কা না করে ইরানকে গত বছর এসসিওর পূর্ণ সদস্য করা হয়েছে। এমনকি সম্প্রতি কাজাখস্তানে রুশ সৈন্য মোতায়েনকে সমর্থন করেছে চীন।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এশিয়া এবং ইউরোপে জোট তৈরির এবং তৎপরতা বাড়ানোর যত চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র করবে চীন ও রাশিয়া ততই ঘনিষ্ঠ হবে। কারণ, বিশ্ব ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য নিজেদের ঐক্যকে একটি অস্ত্র হিসাবে বিবেচনা করছে এই দুই দেশ।

ডিসেম্বরে তাদের মধ্যে সর্বশেষ যে ভার্চুয়াল বৈঠক হয়, সেখানে পুতিন এবং শি এমন একটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংকল্প করেন, যেখানে 'যুক্তরাষ্ট্রও ডলারের' প্রাধান্য থাকবে না।

এই ধরণের পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন।

মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস তাদের বৃহস্পতিবারের সংস্করণে সরকারি সূত্র উদ্ধৃত করে লিখেছে, শুক্রবার প্রেসিডেন্ট শি রাশিয়াকে কতটুক সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেন, তা নিয়ে বাইডেন প্রশাসন চিন্তিত।

কারণ মার্কিন কোনো নিষেধাজ্ঞা চীন গ্রাহ্য করবে, নাকি রাশিয়াকে সেই নিষেধাজ্ঞার পরিণতি থেকে রক্ষা করবে - তার ওপরই নির্ভর করবে ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়াকে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে একঘরে করার নীতি কতটা কাজ করবে।

সূত্র : বিবিসি
ইউএম