• ঢাকা
  • সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ২০, ২০১৯, ০৪:০১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ২০, ২০১৯, ০৪:০৭ পিএম

ফের আলোচনায় বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা

ফের আলোচনায় বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা

সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চের ‘অস্বাভাবিক আদেশে’র বিষয়ে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ৭ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চে গত  ১৬ মে (বৃহস্পতিবার) অভিযোগ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল সংশ্লিষ্ট হাইকোর্ট বেঞ্চের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বিষয়টি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোরও পরামর্শ দেন।

২০১৭ সালে বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী এবং বিচারপতি এ কে এম  জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ অর্থঋণ আদালত সংক্রান্ত এক রিট মামলায় ৩৭, দিলকুশার এম আর ট্রেডিং কোম্পানির (মিজানুর রহমানের  মালিকানাধীন) অনুকূলে একটি আদেশ দেন। ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যায় ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড।

আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের ওই আদেশ নাকচ করে বিষয়টি নিষ্পত্তি করে।

এই মামলায় অনিয়মের অভিযোগ ওঠার প্রেক্ষাপটে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফ, খন্দকার মাহবুব হোসেনও ওইদিন আদালতে অভিমত দেন।

পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনজীবী হাসান আরিফ বলেন, ‘‘হাইকোর্টের বেঞ্চ এমন একটি অর্ডার হয়েছিল, যে বিষয়ে ঠিক সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে নয়, রাষ্ট্রপতির কাছে বিষয়টি পাঠানো যেতে পারে  বলে অ্যাটর্নি জেনারেল নিবেদন করেছেন। আমি ও আরও দুজন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল (এ জে মোহাম্মদ আলী ও ফিদা এম কামাল) এবং বারের প্রেসিডেন্ট-সকলেই সমস্বরে তাতে সমর্থন জানিয়েছি।

বিষয়টিতে আদালত (আপিল বিভাগ) সংক্ষুব্ধ হয়েছে। এই ধরনের অস্বাভাবিক (প্রিপস্টারাস) আদেশে আদালতের মর্যাদা অবনমিত হয়। আমরা আদালতের কাছে আবেদন রেখেছি, এই বিষয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে বা আদালত অন্য যেভাবে উপযুক্ত মনে করেন, সেভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য।

বেঞ্চের বিচারকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শের পরিপ্রেক্ষিতে ‘বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা’ নিয়ে ফের আলোচনা চলছে আইন, আদালত ও বিচারাঙ্গনে।

বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া ওই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এই বিষয়ে জানতে চাইলে এ সংক্রান্ত মামলার রিটকারীর পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ দৈনিক জাগরণকে বলেন, বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়া সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করেছিল আপিল বিভাগ। যার ফলে বিচারপতি অপসারণে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা পুর্নবহাল হয়েছে।

আপিল বিভাগের ওই আদেশের বিরুদ্ধে রিভিউ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ- এই প্রশ্নের জবাবে আইনজীবী বলেন, হ্যা করেছে তবে ওই সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আদালতের কোনও স্থগিতাদেশ নেই। তাই বিচারপতি অপসারণে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থাই এখন চালু আছে। 

বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে পাস হয়। এটি ছিল সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী।

পরে সুপ্রিম কোর্টের ৯ জন আইনজীবীর এক রিট আবেদনে হাইকোর্ট ২০১৬ সালে সংবিধানের ওই সংশোধনী ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে।

পরের বছর ২০১৭ সালের ৩ জুলাই আপিল বিভাগেও ওই রায় বহাল থাকে, যার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ পায় ওই বছরের ১ আগস্ট। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ওই রায়ের ফলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের  অপসারণের ক্ষমতা আবারও জাতীয় সংসদ থেকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে যায়।

বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই রাখা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর আমলে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনের পর বিচারক অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়।

পঁচাত্তরের পট-পরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় গিয়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধন এনে বিচারক অপসারণের বিষয় নিষ্পত্তির ভার দিতে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করেন।

সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আদালত অবৈধ ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনলেও তাতে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধানে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়, যাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ফিরে পায় সংসদ। বিলটি পাসের পর ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।

হাইকোর্টের ওই রায় দিয়েছিল তিন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ। বেঞ্চের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন। অন্য বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল তাতে ভিন্নমত জানিয়ে আলাদা রায় দেন।

সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের দেয়া ওই রায়ে বলা হয়, “বলতে দ্বিধা নেই, ষোড়শ সংশোধনী একটি কালারেবল লেজিসলেশন (কোনো কাজ সংবিধানের মধ্যে থেকে করার সুযোগ না থাকলে আইনসভা যখন ছদ্ম-আবরণে ভিন্ন প্রয়োজনের যুক্তি দেখিয়ে একটি আইন তৈরি করে), যা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নীতির লঙ্ঘন।”

“এটা সংবিধানের দুটি মূল কাঠামো ৯৪(৪)ও ১৪৭(২) অনুচ্ছেদেরও লঙ্ঘন। একইসঙ্গে সংবিধানের ৭(বি) অনুচ্ছেদকেও আঘাত করে।”

“সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে রুল যথাযথ (অ্যাবসলিউট) ঘোষণা করা হল। ষোড়শ সংশোধনী আইন ২০১৪ কালারেবল, এটি বাতিল এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হল।”

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে ২০১৭ সালের ৮ মে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়। সব মিলিয়ে ১১ দিন রাষ্ট্র ও রিট আবেদনকারীর বক্তব্য শোনেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সর্বোচ্চ আদালত।

গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির শুনানিতে আপিল বিভাগ অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে ১০ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর বক্তব্য শোনে। তাদের মধ্যে কামাল হোসেনসহ ৯ জনই সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের পক্ষে অর্থাৎ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে মত দেন।

ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে একই মত পোষণকারীরা হলেন- টি এইচ খান, এ এফ এম হাসান আরিফ, এম আমীর উল ইসলাম, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল, এ জে মোহাম্মদ আলী, এম আই ফারুকী ও আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া। আর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনের পক্ষে অর্থাৎ বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকার পক্ষে অবস্থান জানান শুধু আজমালুল হোসেন কিউসি।

আদালত মোট ১২ জন আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দিলেও তাদের মধ্যে রফিক-উল হক ও শফিক আহমেদ মতামত দেননি। তাদের বাইরে ‘ইন্টারভেনার’ হিসেবে সংবিধানের এই সংশোধনের পক্ষে যুক্তি দেখান সাবেক আইনমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য আবদুল মতিন খসরু।

শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে ৭ বিচারকের আপিল বিভাগ ২০১৭ সালের ৩ জুলাই যে রায় দেয়, তাতে হাইকোর্টের রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ এক্সপাঞ্জ (বাদ দিয়ে) করে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল ‘সর্বসম্মতভাবে’ খারিজ করে দেয়া হয়।

এদিকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের ওই রায় ও পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পদত্যাগকে ঘিরে জাতীয় নির্বাচনের আগের বছর ২০১৭ সালের শেষ দিকে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজনৈতিক অঙ্গন। সর্বত্র ছিল আলোচনা-সমালোচনা-পর্যালোচনা। একদিকে ক্ষোভ-হতাশা, আরেক দিকে উল্লাস, পাল্টাপাল্টি বক্তব্য। রায়কে দুঃসময়ে আশার আলো হিসেবে দেখে স্বস্তির ছাপ পড়েছিল বিএনপিপন্থী রাজনীতিবিদদের মধ্যে। এমনকি রায়ের পর সরকারের পদত্যাগও দাবি করেন দলটির নেতারা। যদিও সরকারের তরফে এ রায়ের বিষয়ে হতাশার পাশাপাশি অসম্মানজনকও বলা হয়। সরকারের মন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের বক্তব্যে ক্ষোভও প্রকাশ পায়। আলোচনা থেকে বাদ যাননি আইন-বিচারসংশ্লিষ্টরাও। রাজনৈতিক ও বিচারাঙ্গনে ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপক উত্তাপ।

সর্বশেষ তিন মাসের নাটকীয় নানা ঘটনার পর পদত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। বিচারক অপসারণ নিয়ে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তাকে নিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্ট হয়, পদত্যাগের মাধ্যমে তার ইতি ঘটে।

ওই রায়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার দেয়া বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছিলেন মন্ত্রী, দলীয় নেতা ও সরকারপন্থী আইনজীবীরা। তারা প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবিও তোলেন। 

সমালোচনার মধ্যেই রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা হঠাৎ করেই এক মাসের ছুটির কথা জানিয়ে চিঠি দেন। পরের দিন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞাকে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়। পরে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতির এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার ছুটি বাড়ানো হয়। এরপর অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন প্রধান বিচারপতি।

দেশ ছাড়ার আগে প্রধান বিচারপতি তার বাসভবনের সামনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘আমি অসুস্থ নই। বিচার বিভাগের স্বার্থে ফিরে আসব। ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে একটি মহল প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়েছেন।’’ তিনি একটি লিখিত বিবৃতিও সাংবাদিকদের দিয়ে যান। 

পরের দিন সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ১১টি অভিযোগ ওঠার পর তার কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এ কারণে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসতে চাননি আপিল বিভাগের বিচারপতিরা। এ অবস্থায় প্রধান বিচারপতির দেশে ফেরা নিয়ে ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়।

বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ছুটিতে গেলে সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল বিভাগের প্রবীণতম বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতি কার্যভার পালনের জন্য নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। পরে বিদেশে অবস্থানকালেই পদত্যাগপত্র পাঠান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। সিঙ্গাপুর থেকে ওই পদত্যাগপত্র পাঠান তিনি।

এমএ/এসএমএম