• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৪ মে, ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ২৩, ২০১৯, ১০:০২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ২৩, ২০১৯, ১০:১৪ পিএম

১৯ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ

নিয়ন্ত্রণে আসছে না ডেঙ্গু, বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে

নিয়ন্ত্রণে আসছে না ডেঙ্গু, বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে

১৯ বছরে (২০১৯ এর ২৩ জুলাই পর্যন্ত) ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত ও হাসপাতালে ভর্তির রেকর্ড হয়েছে এবার। সর্বশেষ ২২ জুলাই সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৭৩ জন। এসব তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের। 

যদিও বাংলাদেশের পূর্ব ও বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা অনুমান করে বলছে- আক্রান্তের সংখ্যা ৩ লাখ ছাড়িয়েছে। আক্রান্ত সব রোগী সরকারের নজরদারিতে নেই। চিকিৎসা নিতে আসা মাত্র ২ শতাংশ রোগী সরকারি নজরদারিতে পড়ছে। ৯৮ শতাংশের কোনো তথ্য থাকে না, আক্রান্তদের মধ্যে ৮৫ শতাংশই চিকিৎসা নেয় না। আগামী মাসে রোগীর সংখ্যা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

ভবিষ্যতে ডেঙ্গু আরও ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে- এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার প্রাক্তন পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ দৈনিক জাগরণকে বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টিও একদিনে বা স্বল্পসময়ে হয়নি। গত প্রায় ২০ বছর ধরে বাংলাদেশে যে ডেঙ্গু সংক্রমণ হচ্ছে এর ধারাবাহিকতায় এরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯ বছরে (২০০০ থেকে ২০১৯ এর ২৩ জুলাই পর্যন্ত) সর্বোচ্চ আক্রান্তের ঘটনা ছিল ২০১৮ সালে। এসময় রাজধানীর ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়। এ বছর ২৩ জুলাই পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭,৬৭২ জনে। জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত যে হারে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে, তা অব্যাহত থাকলে এবার ২০ হাজার ছাড়াবে।

বর্তমানে রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে ভর্তি আছেন ১,৭৯৪ জন। অন্যদিকে, এবার এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৫ জনের মৃত্যুর কথা বলছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম। যদিও রোগ নিয়ন্ত্রণ, রোগতত্ত্ব ও গবেষণা কেন্দ্র (আইইডিসিআর) বলছে, ডেঙ্গুতে ১০ জনেরও বেশি মারা গেছেন। এরইমধ্যে হবিগঞ্জ জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. শাহাদৎ হোসেন হাজরা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। গত শনিবার ৩৪ দিন বয়সী শিশু মুসা মৃত্যুবরণ করে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অ্যান্ড অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের তথ্য বলছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২০০০ সালে সবচেয়ে বেশি, ৯৩ জনের মৃত্যু ঘটে। ২০০২ সালে ৫৮ জন, ২০০১ সালে ৪৪ জন ও ২০১৮ সালে প্রায় ৩০ জনের মৃত্যু ঘটেছে।

সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত ৪৭৩ জনের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯৯ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ৫২ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ১৬ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৪৩ জন, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ৬০ জন, বারডেম হাসপাতালে ১৫ জন, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ১৩ জন, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৬ জন, বিজিবি হাসপাতালে ৫ জন, কুর্মিটোলা হাসপাতালে ১ জন ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।

ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি টাইপ আছে।
এসব হচ্ছে- DENV-1, DENV-2, DENV-3 এবং DENV-4।

এছাড়া বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৯ জন, ইবনে সিনা হাসপাতালে ১৪ জন, স্কয়ার হাসপাতালে ৬ জন, সেন্ট্রাল হাসপাতালে ১৪ জন, কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ১২ জন, ইউনাইটেড হাসপাতালে ১৯ জন, খিদমা হাসপাতালে ১৩ জন, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৮ জন, সালাউদ্দিন হাসপাতালে ১৪ জন, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০ জন ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।

এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ও চিকিৎসক আয়েশা আক্তার।

গত ২১ জুলাই (সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায়) ৪০৩ জন, ২০ জুলাই ২৮৫ জন এবং ১৯ জুলাই ২৩৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল চিকিৎসা নিয়েছে।

ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি টাইপ আছে। এসব হচ্ছে- DENV-1, DENV-2, DENV-3 এবং DENV-4।

বে-নজির আহমেদ বলেন, কেউ যদি এই চারটির যে কোনো একটিতে আক্রান্ত হন, তাহলে সেই একটি টাইপ দ্বারা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আর সংক্রমণ হবে না। তবে নতুন টাইপ দিয়ে তিনি আক্রান্ত হতে পারেন। যদি হয়েই যান, তাহলে নতুন টাইপ পূর্বতন সংক্রমণে সৃষ্ট ইমিউনোগ্লোবিউলিনের সঙ্গে বিক্রিয়ায় সেই ব্যক্তির মাঝে একটা রিঅ্যাকশন সৃষ্টি করে, যেটা জটিল ডেঙ্গু রোগের প্রকাশ ঘটাতে পারে এবং কখনও কখনও সেটা ভয়াবহ রূপও নিতে পারে। 

এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, হয়ত এবার যারা মৃত্যুবরণ করেছেন অথবা প্রবল ঝুঁকিতে আছেন তারা আগে যে টাইপের ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিলেন, এবার সেই টাইপের নয়, অন্য টাইপের ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন।

আশঙ্কা প্রকাশ করে বে-নজির আহমেদ বলেন, এবার রোগীরা যে টাইপের ভাইরাসে সংক্রমিত হলেন, পরে যদি আক্রান্ত হন, সেটা হবে অন্য টাইপের ভাইরাস দিয়ে। সেটাই হবে ভয়ের জায়গা। এজন্য ভবিষ্যতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কী হতে পারে, সেটা বলা মুশকিল এবং তা যে আশঙ্কাজনক হবে না, তা উড়িয়ে দেয়া যায় না। 

বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় কী- এমন প্রশ্ন করা হলে এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, আক্রান্তদের যথাযথ চিকিৎসার আওতায় নিতে হবে, যে এলাকার মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন সেই এলাকায় এডিস বাহক নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পিতভাবে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। একইসঙ্গে আক্রান্তদের সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে ফেলতে হবে এবং এসব নিয়ে গবেষণা করতে হবে এবং প্রাপ্ত ফল অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কেননা, গবেষণা ছাড়া ভালো কিছু করা অন্ততঃ চিকিৎসা বিজ্ঞানে সম্ভব নয়। ডেঙ্গু নিয়ে আমাদের দেশে ভালো কোনো গবেষণা নেই, চিকিৎসকরা যা মন্তব্য করছেন, তা তার রোগীর উপর ভিত্তি করে বলছেন। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতির উপরে স্বচ্ছ বা আমলযোগ্য মন্তব্য কেউ-ই করতে পারছেন না এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসা করতে পারছেন না।

দৈনিক জাগরণের একটি প্রশ্নে রোগতত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা কেন্দ্রের (আইইডিসিআর) প্রাক্তন পরিচালক অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান বলেন, মহামারী ঘোষণার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো- আক্রান্তদের সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা, রাজধানীর যে এলাকার মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন, সেই এলাকার মশা নিধনে কার্যকর ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা।

তিনি বলেন, এখন অবস্থা এতটাই খারাপ, তারপরও যদি গাফিলতি করা হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।

আরএম/ এফসি

আরও পড়ুন