• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১০, ২০১৮, ১২:০৯ পিএম

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ
জহির রায়হান নির্মিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

 

বাঙালির সবচেয়ে বড় অর্জন ও ত্যাগ মহান মুক্তিযুদ্ধ। আর শিল্প,সাহিত্য ও সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো চলচ্চিত্র। এটি একটি দেশের সবচেয়ে বড় গণমাধ্যমও। তাই এই মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব পড়াটাও ছিল স্বাভাবিক। আমাদের অনেক গুণী নির্মাতাই এই গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধকে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।  অনেকে মুক্তিযুদ্ধের সফল চিত্রায়ন করে আলোচিত হয়েছেন। অনেকে আবার নিছক বাণিজ্যের লোভে মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে সমালোচিত হয়েছেন।

ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের পটভূমিতে ১৯৭০ সালে জহির রায়হান নির্মাণ করেন ‘জীবন থেকে নেয়া’। এ চলচ্চিত্রে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরি ও মিছিল, শহীদ মিনার এবং ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে এই চলচ্চিত্রে। একই বছর নির্মিত ফখরুল আলম পরিচালিত ‘জয়বাংলা’ নামের চলচ্চিত্রটি পাকিস্তানি সেন্সর বোর্ড আটকে রাখে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে এটি মুক্তি পায়।

জহির রায়হান নির্মিত ‘স্টপ জেনোসাইড’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

জহির রায়হান ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে সরাসরি অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ নির্মাণ করেন। এরপর তিনি নির্মাণ করেন ‘এ স্টেইট ইজ বর্ন’। আলমগীর কবির নির্মাণ করেন ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ এবং বাবুল চৌধুরী ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নস’। 

চাষী নজরুল ইসলাম নির্মিত ‘ওরা ১১ জন’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন চাষী নজরুল ইসলাম। সরাসরি ১১ জন মুক্তিযোদ্ধার অংশগ্রহণ নিয়ে তার নির্মিত চলচ্চিত্রটির নাম ‘ওরা ১১ জন’ । এই ১১ জন হলেন- খসরু, মঞ্জু, হেলাল, ওলীন, আবু, আতা, নান্টু, বেবী, আলতাফ, মুরাদ ও ফিরোজ। ১১ দফা ছাত্র আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরকে প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করে এ চলচ্চিত্রের নামকরণ করা হয়।

একই বছর সুভাষ দত্ত নির্মাণ করেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’। হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন, নারী ধর্ষণ এবং প্রতিবাদে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে কেন্দ্র করে এই চলচ্চিত্র নির্মিত। একই বছর আলমগীর কবির ‘ডায়েরিজ অব বাংলাদেশ’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। এ বছরের ডিসেম্বরে মুক্তি পায় মমতাজ আলীর ‘রক্তাক্ত বাংলা’ এবং আনন্দের ‘বাঘা বাঙালি’। এ দুটি চলচ্চিত্রে অ্যাকশন আর নারী ধর্ষণের দৃশ্য সংযোজনের মাধ্যমে ফায়দা লোটার চেষ্টার কারণে ব্যাপক সমালোচিত হয়।

খান আতাউর রহমান নির্মিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

১৯৭৩ সালে ‘ওরা ১১ জন’ চলচ্চিত্রের সিক্যুয়েল হিসাবে খান আতাউর রহমান নির্মাণ করেন ‘আবার তোরা মানুষ হ’। মুক্তিযোদ্ধাদের নেতিবাচক দিকগুলো দেখানোর কারণে এ চলচ্চিত্রটি ব্যাপক সমালোচিত হয়। একই বছর মুক্তি পায় আলমগীর কবির নির্মিত ‘ধীরে বহে মেঘনা’। জহির রায়হান যুদ্ধ চলাকালীন পরিকল্পনা করেন একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের। যুদ্ধের পর জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়ার পর আলমগীর কবির সেটি ‘ধীরে বহে মেঘনা’ নামে নির্মাণ করেন।  এ বছর আলমগীর কুমকুম নির্মিত ‘আমার জন্মভূমি’ চলচ্চিত্রটিও মুক্তি পায়। 

১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় চাষী নজরুল ইসলামের ‘সংগ্রাম’, আনন্দের ‘কার হাসি কে হাসে’ এবং নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’। ‘আলোর মিছিল’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে ববিতা প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।

১৯৭৬ সালে হারুনর রশিদ নির্মাণ করেন ‘মেঘের অনেক রং’। এ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ব্যতিক্রমভাবে ফুটে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি।

১৯৮১ সালে শহীদুল হক খান নির্মাণ করেন ‘কলমীলতা’। এই চলচ্চিত্রে একজন কিশোরের মুক্তিযুদ্ধে দুঃসাহসিকতার পরিচয় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পাকসেনার বিরুদ্ধে অভিযানের গল্প উঠে এসেছে।

১৯৮৪ সালে শুরু হয় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলন। এ বছর মোরশেদুল ইসলাম তৈরি করেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আগামী’।

১৯৮৫ সালে আলমগীর কবীর নির্মাণ করেন ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’। ১৯৮৮ সালে মোরশেদুল ইসলামের ‘সূচনা’ ও ১৯৯২ সালে আবু সায়ীদের ‘ধূসরযাত্রা’ তৈরি হয়।

১৯৯৩ সালে শাহরিয়ার কবিরের উপন্যাস অবলম্বনে নাসির উদ্দিন ইউসুফ নির্মাণ করে ‘একাত্তরের যীশু’। মুক্তিযুদ্ধে এক সময় পাকসেনারা ক্রুশবিদ্ধ করে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা শুরু করে। এ জন্য ঔপন্যাসিক ক্রুশবিদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের যীশুর সঙ্গে তুলনা করেছেন।

বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সরকারি অনুদানে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এই উদ্যোগে হারুনুর রশিদ ১৯৯৩ সালে নির্মাণ করেন ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’, ১৯৯৭ সালে রফিকুল বারী চৌধুরী তৈরি করেন ‘বাংলা মায়ের দামাল ছেলে’ এবং ২০০৮ সালে বাদল রহমান নির্মাণ করেন  ‘ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ’।

১৯৯৪ সালে হুমায়ূন আহমেদ নির্মাণ করেন ‘আগুনের পরশমনি’। তার রচিত উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে যুদ্ধকালীন নানাদিক উঠে এসেছে।

১৯৯৫ সালে মুক্তিযুদ্ধের উপর প্রামাণ্যচিত্র ‘মুক্তির গান’ নির্মাণ করেন তারেক মাসুদ ও ক্যাথেরিন মাসুদ দম্পতি। মুক্তিযুদ্ধকালীন চিত্রায়িত কিছু ফুটেজ নিয়ে নির্মিত হয় ‘মুক্তির গান’। এটি দর্শকের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগায়। 
পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে নির্মাতা এই দম্পতি সিক্যুয়েল হিসেবে নির্মাণ করেন ‘মুক্তির কথা’।

১৯৯৭ সালে সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের গল্প অবলম্বনে চাষী নজরুল ইসলাম নির্মাণ করেন ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। নিজের পুত্রেকে পাকসেনার হাতে তুলে দিয়ে এক মার মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচানোর কাহিনীই এ চলচ্চিত্রে তুলে ধরা হয়েছে। একই বছর খান আতাউর রহমান নির্মাণ করেন ‘এখনো অনেক রাত’। 

২০০০ সালে শিশু একাডেমির উদ্যোগে মোরশেদুল ইসলাম নির্মাণ করেন ‘শরৎ’৭১’। 

২০০২ সালে কুসংস্কার নিয়ে তারেক মাসুদ নির্মাণ করেন মাটির ময়না’। এ চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ উঠে এসেছে ভিন্ন আঙ্গিকে। এ সালেই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয় হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’, তৌকির আহমেদের ‘জয়যাত্রা’ এবং রাবেয়া খাতুনের উপন্যাস অবলম্বনে চাষী নজরুল ইসলামের ‘মেঘের পরে মেঘ’।

২০০৬ সালে রাবেয়া খাতুনের আরেকটি উপন্যাস নিয়ে চাষী নজরুল ইসলাম নির্মাণ করেন ‘ধ্রুবতারা’। 

২০১০ সালে তারেক মাসুদ নির্মাণ করেন ‘নরসুন্দর’ এবং তানভীর মোকাম্মেল ‘রাবেয়া’। 

২০১১ সালে সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাস অবলম্বনে নাসিরউদ্দিন ইউসুফ নির্মাণ করেন ‘গেরিলা’। একই বছর মুহম্মদ জাফর ইকবালের শিশুতোষ উপন্যাস অবলম্বনে মোরশেদুল ইসলাম নির্মাণ করেন ‘আমার বন্ধু রাশেদ’। সরকারি অনুদানে নির্মিত এ দুটি চলচ্চিত্রের কাহিনিতে উঠে আসে ভিন্ন রকম দুটি দুঃসাহসিক গল্প। এ বছর রুবাইয়াত হোসেন নির্মিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘মেহেরজান’ ব্যাপক সমালোচিত হয়। পরে এটি প্রদর্শনে সরকারি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

২০১২ সালে শাহজাহান চৌধুরী নির্মাণ করেন ‘আত্মদান’। এ বছর আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস অবলম্বনে জাহিদুর রাহিম অঞ্জন নির্মাণ করেন ‘মেঘমল্লার’। এ যাবতকালের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলোর আলোচনায় এগিয়ে আছে ‘মেঘমল্লার’। এই সময় কাওসার চৌধুরী নির্মাণ করেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তথ্যচিত্র ‘সেই রাতের কথা বলতে এসেছি’। এটি বেশ সাড়া জাগায় দর্শকের মাঝে। 

২০১৪ সালে ভারতে নির্মিত একটি চলচ্চিত্র বাংলাদেশে মুক্তি পায়। হিন্দিতে নির্মিত ‘চিলড্রেন অফ ওয়ার’ চলিচ্চিত্রের নাম বাংলায় রাখা হয় ‘যুদ্ধশিশু’। এ বছর ইংল্যান্ড প্রবাসী পরিচালক মনসুর আলী নির্মাণ করেন ‘সংগ্রাম’। 

বর্তমান সময় পর্যন্ত আরো কিছু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মিত হলেও সেগুলো তেমন আবেদন তৈরি করতে পারেনি। তাই আলোচনায়ও আসেনি। এ যাবতকালে যে সংখ্যক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মিত হবার কথা ছিল ততটা হয়নি। বিগত সরকারগুলোর আমলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণের চেষ্টাকে অনেকটা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। বর্তমানে স্বাধীনতার সপক্ষের সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুদানের পরিমাণ বাড়িয়ে নির্মাতাদের উৎসাহিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণের যে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন, সেটিও সরকার বিভিন্নভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছে। যে কারণে তরুণ নির্মাতাদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের আগ্রহ তৈরি হয়েছে। তাদের অনেকে বেসরকারি পর্যায়েও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন।

এসজে/আরআই/জেডএস