• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ১, ২০১৯, ০৯:৩৩ এএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ১, ২০১৯, ০৯:৩৩ এএম

ঢাকার পথেঘাটে সর্বত্র ডেঙ্গুজ্বরালাপ

ঢাকার পথেঘাটে সর্বত্র ডেঙ্গুজ্বরালাপ

‘জানোস, আমার দুলাভাইর বড় বোনের ডেঙ্গু হয়েছে, তিনি নাকি আইসিইউতে।’
‘আল্লাকে ডাক, আসলেই এবার ডেঙ্গুজ্বর ঘূর্ণিঝড়ের মতন আঘাত হেনেছে। পুরো দেশেই নাকি ডেঙ্গু ছড়িয়েছে।’

এসব কথোপকথন ঢাকার বনানীস্থ প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীর। ডেঙ্গু হয়েছে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নুসরাতের দুলাভাইয়ের বড় বোনের। তিনি এ কথা বলছিলেন সহপাঠী ফারহানা শ্রাবণীর সাথে। বুধবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে বনানী স্টার কাবাবের সামনে তারা দাঁড়িয়ে এসব কথা বলছিলেন। তাদের পাশ দিয়ে দৈনিক জাগরণ প্রতিবেদক যাবার সময় কথাগুলো শুনতে পান।

এ প্রতিবেদকের প্রশ্নে নুসরাত বলেন, দুলাভাইর বড়বোনের প্ল্যাটিলেট নাকি তিনবার দিয়েছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। জানেন, আমাদের দুই বন্ধুরও ডেঙ্গু।

শ্রাবণী বলে উঠেন- আমার বাসার পাশের বাসার এক পরিবারে তিনজনের ডেঙ্গু।

ঢাকার পথেঘাটে, চা দোকানে, গণপরিবহনে, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতসহ সর্বত্রই ডেঙ্গুর আলোচনায় ভরে গেছে। সরকারি তথ্যমতে- নেত্রকোনা ছাড়া দেশের ৬৩ জেলায় ডেঙ্গুজ্বরের ভয়াল বিস্তার ঘটেছে। ৩০ জুলাই সকাল ৮টা থেকে ৩১ জুলাই সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা শহরসহ দেশের ৬৪টি জেলার হাসপাতালগুলোতে ১ হাজার ৪৭৭ জন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর আগে ২৯ জুলাই সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা শহরসহ দেশের ৬০টি জেলার হাসপাতালগুলোতে ১ হাজার ৩৫ জন, ২৮ জুলাই সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ৫০ জেলায় ১ হাজার ৯৬ জন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরাধীন হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম জানায়, নতুন আক্রান্ত ১৪৭৭ জন নিয়ে এ বছর (৩১ জুলাই পর্যন্ত) সারাদেশে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ালো ১৭ হাজার ১৮৩ জনে। এর মধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৪ হাজার ৯০৩ জন। অন্যদিকে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত ১৪ জনের মারা যাওয়ার তথ্য সরকারিভাবে বলা হলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ নানা সূত্র বলছে ৩০ জন।

এসব কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশ ভয় কাজ করছে। তাছাড়া বিশিষ্টজন, রাজনীতিক, সিনিয়র সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ প্রতিদিনই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডেঙ্গুজ্বরের কথা গুরুত্ব দিয়ে বলছেন। এমন সরগরম আলোচনাও ভয় বাড়িয়ে দিয়েছে সাধারণ মানুষের মাঝে।

বুধবার বিকালে বনানী পোস্ট অফিসের সামনে রুহুলের ভাসমান মুড়ি-চানাচুরের দোকান থেকে মুড়ি অর্ডার করছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী বুলবুল ও তার বন্ধু আশিক। পাশেই ছিলেন দৈনিক জাগরণ প্রতিবেদক। অর্ডার শেষ করেই বুলবুল বলছিলেন আশিককে- কী যে বলব তরে, এই যে মনে কর এখানে দাঁড়ায়ে আছি। তা-ও ভয় লাগে। কোন ফাঁকে জানি ডেঙ্গু মশা কামড় দেয়।

আশিক মৃদু হেসে বলেন, আরে রাস্তায় এসব মশা থাকে না। এসব থাকে বাসাবাড়িতে, বড়লোকের বাসায়। এ কথার সাথে সম্মতি জ্ঞাপন করে বুলবুল যোগ করেন- কিন্তু ভরসা পাই না। রাস্তাতেই যদি কামড় দেয়?

আশিক এ প্রতিবেদকের প্রশ্নে বলেন- আসলে মানুষের মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে। দুপুরে অফিসে থাকতেও ভয় লাগে। অ্যারোসল স্প্রে করি কিছুক্ষণ পরপরই। তবুও ভয় যায় না।

মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) দুপুরে দৈনিক জাগরণ প্রতিবেদক যান মিরপুর শাহ আলী শপিং কমপ্লেক্সে। সেখানে একটি কম্পিউটার এক্সেসরিজের দোকানে বিক্রেতা সুজন তালুকদার মোবাইলে তার স্ত্রীকে বলছিলেন, শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাও। আমি আসতেসি। তাড়াতাড়ি সিএনজি ডাকো।

এটা বলেই মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন সুজন। এ প্রতিবেদক সুজনকে প্রশ্ন করলে উত্তর আসে- ভাই, বড় বিপদে আছি, বড় ছেলেটার (১০ বছর) নাকি জ্বর আসছে হঠাৎ। শিশু হাসপাতালে নিতে বলেছি, আমিও যাচ্ছি দোয়া করবেন।

পান্থপথ হীরা হোটেলের পেছনে আলফাজের চা দোকান। বুধবার দুপুরে সেখানে যেতেই শোনা যায়, তরুণ বয়সী চার ব্যাংকার বন্ধু দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি, ডেঙ্গু আক্রান্ত স্বজনদের নিয়ে এবং নিজ পরিবারকে ডেঙ্গু থেকে সুরক্ষা নিয়ে আলোচনা করছিলেন।

তাদেরই একজন সালেক আহমেদ। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, আগে দেখেছি, ডেঙ্গু ঢাকায় হয়। এখন দেখছি সারাদেশেই ছড়িয়ে গেছে। নাহলে আমার স্ত্রী-সন্তানকে ঢাকার বাইরে পাঠিয়ে দিতাম কটা দিনের জন্য।

চারজনের আরেকজন তামিম হোসেন। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, জানেন, একটু পর পর বাসায় ফোন দেই। বাচ্চাটার খবর নিই। কী করে, ওর মা ঘরে মশার ওষুধ স্প্রে করেছে কি-না জানতে। সারাক্ষণ ভয়ে থাকি। কখন যে কী হয়......

মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে সফলতা না এলে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়বে :

দেশের ৬৩ জেলায় যখন ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১৭ হাজার ছাড়ালো, তখনই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এডিস মশার প্রজননস্থানগুলো ধ্বংসে সফলতা না এলে প্রকোপ আরও বাড়ার আশঙ্কা আছে। বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক সেব্রিনা ফ্লোরা।

সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, আমরা সবাই মিলেই জোরেশোরে অ্যাট সোর্স মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে যাচ্ছি। যদি সোর্স রিডাকশনে সফল হই তাহলে এটাকে থামাতে পারব। যদি কোনো কারণে কার্যকরভাবে এটা নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে প্রতিবছর এটা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যায়। পিক টাইম সেপ্টেম্বরে। সুতরাং এখানে একটাই পদ্ধতি সেটা হচ্ছে সোর্স রিডাকশন। যত রকম ওষুধই ব্যবহার করি না কেন যদি সোর্স রিডাকশন না হয় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। যদি সোর্স রিডাকশনে আমরা সবাই মিলে কাজ না করি তাহলে ট্রেন্ড থামানো যাবে না। সেদিক থেকে প্রত্যেক নাগরিককে সচেতন করার দায়িত্ব আমাদের সবার। সেটা না হলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়বে। পরে আস্তে আস্তে কমে আসবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে বলা হয়েছে, বুধবার (৩১ জুলাই) পর্যন্ত ১৭ হাজার ১৮৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এবং ১৪ জনের মৃত্যুর হয়েছে। তবে গণমাধ্যমে আসা তথ্য অনুযায়ী- মৃতের সংখ্যা ৩০ এরও বেশি।

একটি প্রশ্নে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক সানিয়া তহমিনা বলেন, জরুরি ভিত্তিতে ৫০ হাজার এনএসওয়ান কিট আমদানি করা হচ্ছে। এগুলো যেহেতু দেশে তৈরি হয় না এজন্য এগুলো আনতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগবে না। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরও এক লাখ কিট দেবে যেগুলো আমরা বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠিয়ে দেব। এগুলো বিনা পয়সায় দেয়া হবে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার এম এম আক্তারুজ্জামান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আয়েশা আক্তার।

আরএম/টিএফ
 

আরও পড়ুন