• ঢাকা
  • রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ৩১, ২০১৯, ০৫:০১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ৩১, ২০১৯, ০৫:০৩ পিএম

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরতে না চাওয়ার নেপথ্যে

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরতে না চাওয়ার নেপথ্যে
কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গাদের জন্য তৈরি করা হচ্ছে নতুন বসতঘর  -  ছবি : জাগরণ

মিয়ানমারের রাখাইনে নিজ নিজ পাড়া, গ্রামে বসবাস ও চলাফেরার ন্যূনতম নিশ্চয়তা পেলেই ফিরে যেতে চায় রোহিঙ্গারা। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট যারা রোহিঙ্গাদের ক্ষতি করতে আকস্মিক তাণ্ডব চালিয়েছিল, তাদের হুমকি এখনো সমানতালে বহাল রয়েছে। জানমাল ও নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চয়তার অভাবে সাধারণ রোহিঙ্গারা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মিয়ানমারে ফিরতে পারছে না। এক্ষেত্রে তারা কিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে। যেগুলোর কার্যকর পদক্ষেপ নিলে দ্রুত প্রত্যাবাসন সম্ভব বলে সাধারণ রোহিঙ্গাদের বিশ্বাস।

গত ২২ আগস্ট মিয়ানমারের ছাড়পত্র পাওয়া অনেক রোহিঙ্গা রাখাইনে ফিরে যেতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু মিয়ানমার ও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পাওয়ায় তারা রাজি হয়নি বলে পরিচয় গোপন রাখার শর্তে রোহিঙ্গারা জানায়। গত কয়েক দিন ধরে কেন রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাচ্ছে না, সে ব্যাপারে অনুসন্ধানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও আশাপ্রদ বক্তব্য ও তথ্য মেলে।

ক্যাম্পের পাশে রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রিত কাঁচাবাজার  -  ছবি : জাগরণ

কারা ফিরতে বাধা দিচ্ছে

২২ আগস্ট দ্বিতীয়বার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু ১৯-২২ আগস্ট পর্যন্ত এআরএসপিএইচআর ও আরসার নির্দেশে এআরএসপিএইচআর ও আরসা নেতা মাস্টার কামাল ও ছৈয়দুল্লাহর নেতৃত্বে বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে ৪৫ সদস্যের একটি গ্রুপ পাঠায় নয়াপাড়া, শালবাগান ক্যাম্পে। তারা সেখানে গিয়ে সেখানকার আশপাশের ক্যাম্পের আরসা ও এআরএসপিএইচআর সন্ত্রাসীদের নিয়ে যাদের প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকা এসেছে তাদের ঘরে ঘরে গিয়ে হুমকি দেয়।

তাদেরকে ওরা বলে দেয়, সরকার ও ইউএনএইচসিআরের সাক্ষাৎকারে গিয়ে মিয়ানমারে যাওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি না হওয়ায় ফিরবে না বলে জানিয়ে দেবে। যেহেতু সাক্ষাৎকারে ইউএনএইচসিআর রয়েছে, সেহেতু রোহিঙ্গাদের কেউ চাপ দিতে পারবে না। যদি কোনো রোহিঙ্গা তাদের নির্দেশ অমান্য করে, তাহলে তাদের মেরে ফেলার হুমকিও দেয় বলে জানা যায়।

গত ১৬ আগস্ট ক্যাম্প-৫-এর মৌলভী অলি ও রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের মাস্টার ওসমানের নেতৃত্বে ৭৫ সদস্যের আরসা সন্ত্রাসীদের দুটি গ্রুপ রাখাইনে পাঠায় আরসা ও এআরএসপিএইচআর নেতারা। তাদের নির্দেশ দেয়া ছিল যদি কোনো কারণে ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গারা ২২ আগস্ট রাখাইন ফেরত যায়, তাহলে ক্যাম্প থেকে যাওয়া আরসার বিশেষ সন্ত্রাসী গ্রুপ ফেরত যাওয়াদের খুন করবে অথবা গুলি করে হত্যা করবে।

বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক রোহিঙ্গাদের দেয়া হচ্ছে চুলাসহ গ্যাস সিলিন্ডার। অভিযোগ আছে, নিজের জন্য একটি করে গ্যাস সিলিন্ডার রেখে বাকিগুলো বিক্রি করে দিচ্ছে তারা  -  ছবি জাগরণ

প্রতিটি ক্যাম্পে আরসার ৯টি করে কমিটি কাজ করছে

আরসা যেহেতু প্রকাশ্যে ক্যাম্পগুলোতে তাদের তৎপরতা চালাতে পারে না, সেহেতু আরসা তাদের ছায়া নেতৃত্ব এআরএসপিএইচআরের ব্যানারে ৩২টি ক্যাম্পে বিকল্প হিসেবে তাদের কর্মকাণ্ড বহাল রেখেছে। এআরএসপিএইচআরের যুব কমান্ড ভয়েস অব রোহিঙ্গা বা ভিওআর ক্যাম্পগুলোতে সব দিক তদারক করে থাকে। এআরএসপিএইচআর, ক্যাম্প ম্যানেজমেন্ট কমিটি, উইমেন অ্যাফেয়ার্স কমিটি, ইয়ুথ কমিটি, রিলিজিয়ার্স কমিটি, সমাজ কমিটি, এডুকেশন কমিটি ও ইম্পারমেশন কমিটি প্রতিটি ক্যাম্পের প্রতিটি ব্লকে আরসার হয়ে সক্রিয় রয়েছে। প্রতিটি কমিটির সদস্যসংখ্যা ৫১ জনের বেশি। এদের অত্যাচার, হত্যা, খুন, গুম, অপহরণ, চাঁদা আদায় প্রভৃতির কারণে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে জানের নিরাপত্তার অভাবে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও প্রকাশ করছে না।

বয়স্ক রোহিঙ্গারা জানান, ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর তিন বছর তৎকালীন বার্মা তত্ত্বাধায়ক সরকার জাতিধর্ম-নির্বিশেষে সবাইকে দেশ পুনর্গঠনে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। কিন্তু আরাকানের মৌলভিরা বার্মা সরকারের ডাকে সাড়া না দিয়ে পাকিস্তানের সাথে থাকার জন্য মুসলিমদের চাপ দেয়।

১৯৫৪ সালের ৩ জানুয়ারি বার্মার প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী উ নু আরাকানের মুসলিমদের রোহিঙ্গা ঘোষণা দেন। ১৯৫৫ সালে সমগ্র বার্মায় পারিবারিক নিবন্ধন কাজে আরাকানের মুসলিমদের রোহিঙ্গা হিসেবে নিবন্ধিত হতে বলে। কিন্তু সে সময়ও মৌলভিরা বাধা দিয়ে বার্মা মুসলিম লিপিবদ্ধ করতে প্রচারণা চালান।

সে সময় আরাকানের অধিকাংশ রোহিঙ্গা মৌলভিদের কথামতো বার্মা মুসলিম ও ধর্ম হিসেবে ইসলাম নিবন্ধিত করে। তবে কিছু রোহিঙ্গা মৌলভিদের কথা না মেনে রোহিঙ্গা হিসেবে নিবন্ধিত হয়। তারা জানান, ক্যাম্পে শতকরা ৯০ ভাগ রোহিঙ্গার কাছে যে কাগজপত্র রয়েছে তাতে বার্মা মুসলিম ও ধর্ম হিসেবে ইসলাম উল্লেখ আছে।

ফিরে যাওয়ার সহজ প্রস্তাব

ক্যাম্পগুলোতে বিচ্ছিন্নভাবে প্রত্যাবাসন তালিকার পরিবর্তে পাড়াভিত্তিক তালিকা তৈরি করে সে অনুযায়ী ফেরত নেয়া। কারণ আরসার সিদ্ধান্তের বাইরে ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গারা ফেরত গেলে জানমালের হুমকি রয়েছে। ১৯৭৮ ও ১৯৯৩ সালের মতো ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের ট্রানজিট ক্যাম্পে না নিয়ে সরাসরি অভ্যর্থনা কেন্দ্র থেকে নিজ নিজ পাড়া ও গ্রামে যেতে দিতে হবে।

নিজ উদ্যোগে রোহিঙ্গারা তাদের ঘরবাড়ি নির্মাণ, মেরামত করে নেবে। অভ্যর্থনা কেন্দ্রে এনভিসি কার্ডের জন্য চাপাচাপি না করে কয়েক মাস পর যখন নাগরিকত্বের আবেদন করবে তখন এনভিসি কার্ড দেয়া যাবে। রোহিঙ্গাদের করা খসড়া ফেরত পারিবারিক ফর্ম ব্যবহার করলে কাজ সহজ হবে বলে তাদের ধারণা। ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের সমস্ত দোকানপাট, ব্যবসা, সিএনজি, টমটমসহ সব ধরনের ব্যবসা, এনজিওতে রোহিঙ্গাদের চাকরি বন্ধ করা। মিয়ানমারে চলমান সংবিধান সংশোধনে চীন, জাপান, ভারতসহ মিয়ানমারের বন্ধুদেশগুলোকে সেনাবাহিনীপ্রধানকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা। রাখাইনে ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের নিরাপদ পরিবেশ ফিরে না আসা পর্যন্ত সেখানে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও আসিয়ানের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে পর্যবেক্ষণ টিমকে তদারকির দায়িত্ব দেয়ার প্রস্তাব করেন তারা।

এনআই

আরও পড়ুন