• ঢাকা
  • রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ৯, ২০১৯, ০৯:৩৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ৯, ২০১৯, ০৯:৩৫ পিএম

৫০ বছরে পা দিল গুপী-বাঘা

৫০ বছরে পা দিল গুপী-বাঘা

 

বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ‘পথের পাঁচালী’ যেমন একটি মাইলস্টোন, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-ও তাই। সত্যজিতের সমসাময়িক বাংলা ছবির জগৎ তখনও ছবির ভাষা-ট্রিটমেন্ট ও আঙ্গিকে এতটা উন্নত হয়ে ওঠেনি যে এমন একটি কল্পকাহিনিচিত্র নির্মাণ করতে পারতেন আর কেউ। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর গল্পকে সত্যজিৎ যে মাত্রায় নিয়ে গিয়েছেন এই ছবিতে, তা চিরকাল চলচ্চিত্রের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু এই ছবির প্রযোজক পেতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল সত্যজিৎ রায়কে।

এবছর ছবির পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে সেই বিষয়ে আলোকপাত হয়েছে ফিল্ম কম্পানিয়ন ডট কমের একটি প্রতিবেদনে। উঠে এসেছে এই ছবি শুরু হওয়ার আগের গল্পটি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘পথের পাঁচালী’-র পরে ‘মহানগর’, ‘কালপুরুষ ও মহাপুরুষ’ এবং ‘নায়ক’ বক্স অফিসে খুব একটা ভাল ফল করেনি। তাই ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ প্রযোজনা থেকে পিছিয়ে আসেন সত্যজিতের ছবির ধারাবাহিক প্রযোজক আর ডি বনশল।

কিন্তু ছবিটি করতে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন সত্যজিৎ। তাই সেই সময় মুম্বাইয়ের একাধিক প্রযোজকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। সেই তালিকায় ছিলেন রাজ কাপুরও। সত্যজিতের ছবি নিয়ে তার অনেক আগে থেকেই উচ্ছ্বসিত ছিল মুম্বাই চলচ্চিত্র জগৎ। রাজ কাপুরও স্বাভাবিকভাবেই চেয়েছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতে।

সমস্যা হল অন্য জায়গায়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজ কাপুর সত্যজিতের কাছে একটি শর্ত রাখেন। তিনি বলেন, এই ছবিটি তখনই প্রযোজনা করবেন তিনি যদি গুপীর চরিত্রে শশী কাপুর এবং হাল্লা ও শুণ্ডী রাজার চরিত্রে পৃথ্বীরাজ কাপুরকে নিতে হবে৷ এই শর্তে রাজি হওয়া সম্ভব ছিল না সত্যজিৎ রায়ের পক্ষে। মুম্বাই থেকে খালি হাতেই ফিরতে হয় তাকে। পরে সমাধান সূত্র মেলে কলকাতাতেই।

১৯৬২ সালে ‘অভিযান’ ছবির শুটিং-এর সময়-ই জানা গিয়েছিল সত্যজিৎ রায় ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবি করবেন। তখনই ঠিক হয়েছিল যে বাঘা হবেন রবি ঘোষ। গুপীর চরিত্রে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-র অরুণ মুখোপাধ্যায়। হাল্লা ও শুণ্ডী রাজার দ্বৈত চরিত্রে ছবি বিশ্বাস। হাল্লা মন্ত্রী তুলসী চক্রবর্তী। ছবিটা ক্রমশঃ পিছাতে লাগল মূলতঃ আর্থিক সমস্যায়।  ইতিমধ্যে ছবি বিশ্বাস ও তুলসী চক্রবর্তী মারা গেলেন। ওদের জায়গায় এলেন যথাক্রমে সন্তোষ দত্ত ও জহর রায়। গুপীর ভূমিকায় অরুণ মুখোপাধ্যায়ের বদলে কিশোরকুমারকে ভাবা হল। তারপর ‘দৈনিক সত্যযুগ’ পত্রিকার একসময়ের সম্পাদক জীবনলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কেও গুপীর চরিত্রে ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শেষমেশ তপেন চট্টোপাধ্যায় হলেন গুপী।

‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর চিত্রনাট্য শোনার পর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় গুপীর চরিত্রটি করতে চেয়েছিলেন, আবদারও জানিয়েছিলেন। সত্যজিৎ হেসে বলেন যে ঐ চরিত্রটি সৌমিত্র-র না করাই ভাল। সৌমিত্র ভরসা দেবার চেষ্টা করেছিলেন সত্যজিত্কে এই বলে যে তিনি ভালই করবেন। সত্যজিৎ জানিয়েছিলেন যে তারও বিশ্বাস সৌমিত্র ভালই করবেন, কিন্তু তার কল্পনার গুপীর আরো গ্রাম্য চেহারা হবার দরকার।

অভিনেতা নির্বাচন নিয়ে অত্যন্ত খুঁতখুঁতে ছিলেন তিনি। এমনও হয়েছে যে পছন্দসই অভিনেতা বা অভিনেত্রী পান নি বলে কোনো বিশেষ চরিত্র বাদ গিয়েছে বা কোনো সিনেমার পরিকল্পনা পর্যন্ত বাতিল করে দিয়েছেন তিনি।

১৯৬৭ সালে বড়দিনের আশেপাশেই প্রযোজক নেপাল দত্ত ও অসীম দত্ত এই ছবির প্রযোজনা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। ছবির কাজ শুরু হয়। তবে বাজেট কম থাকায় ছবিটি সাদা-কালোতেই তোলা হয়। ছবির শেষ দৃশ্যটি শুধু ছিল রঙিন।

ভূতের নৃত্যের ব্যাপারে প্রথমে উদয়শঙ্করের সঙ্গে সত্যজিৎ রায় পরামর্শ করেন। কিন্তু দুজনের চিন্তাধারায় বোধহয় ফারাক থেকে যাচ্ছিল। শেষে শম্ভু ভট্টাচার্য সত্যজিতের কল্পনাকে রূপ দেন। প্রথমে ঠিক ছিল গুপীর গলায় গানগুলো গাইবেন কিশোরকুমার। কথাবার্তাও সব ঠিকঠাক। হঠাৎ মুম্বাই থেকে কিশোরকুমার খবর পাঠালেন, অন্য একটা শিডিউলের জন্য একটু মুশকিল হয়েছে। আসতে পারছেন না। সত্যজিৎ যোগাযোগ করলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অনুপ ঘোষালের সঙ্গে। বাকিটা ইতিহাস। 

স্বল্প বাজেটে নির্মিত হলেও এই ছবিটিই এদেশে মুক্তিপ্রাপ্ত সত্যজিতের সব ছবিগুলির মধ্য়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করে। টানা সাড়ে আট মাস ধরে প্রেক্ষাগৃহে চলেছিল এই ছবি। সবদিক থেকেই নজিরবিহীন হয়ে রয়ে গেছে ‘গুগাবাবা’।

গুপী গাইন বাঘা বাইন সিনেমার পোস্টার

ছবি-পরিচয়

সাদা কালো- ১৫ রিল, ৩৫ মিমি
প্রযোজনা- পূর্ণিমা পিকচারস
গল্প- উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
চিত্রনাট্য, পরিচালনা, গানের কথা ও সুর
সত্যজিৎ রায়
চিত্রগ্রহণ- সৌমেন্দু রায়
শিল্প- বংশী চন্দ্রগুপ্ত
সম্পাদনা- দুলাল দত্ত
জনসংযোগ- অনুপকুমার ঘোষাল, জয়কৃষ্ণ সান্যাল
অভিনয়- তপেন চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, সন্তোষ দত্ত, জহর রায়, হারীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (জুনিয়র), প্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হরিধন মুখোপাধ্যায়, তরুণ মিত্র, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, চিন্ময় রায়, কামু মুখোপাধ্যায়, জয়কৃষ্ণ সান্যাল, ইভা বন্দ্যোপাধ্যায়, ভাস্বতী চট্টোপাধ্যায়
পরিবেশনা- পিয়ালি ফিল্মস
মুক্তি- ৮মে, ১৯৬৯৷ মিনার, বিজলী, ছবিঘর, গ্লোবে

পুরস্কার:

শ্রেষ্ঠ ছবির জন্য স্বর্ণপদক, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার, ১৯৬৮
শ্রেষ্ঠ পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রপতি পুরস্কার ১৯৬৮
অ্যাডিলেড ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ১৯৬৯, সিলভার ক্রস পুরস্কার
অকল্যান্ড ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ১৯৬৯, সেরা পরিচালনার পুরস্কার
টোকিও ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ১৯৭০, মেরিট অ্যাওয়ার্ড
মেলবোর্ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ১৯৭০, সেরা ছবির পুরস্কার