• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ২১, ২০১৯, ০৩:৪৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ২১, ২০১৯, ০৪:৩৪ পিএম

ভেনেজুয়েলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও বৈশ্বিক সংকটের আশঙ্কা 

ভেনেজুয়েলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও বৈশ্বিক সংকটের আশঙ্কা 

সাম্প্রতিক বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর একাধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা ও বিশ্ব নেতৃত্বে নিজেদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার তীব্র প্রতিযোগিতা একটি বৈশ্বয়িক সংকট সৃষ্টির জন্য রাষ্ট্রগুলোকে তাতিয়ে রেখেছে। নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে এদের মধ্যে সবচেয়ে জোর প্রতিদ্বন্দ্বীতায় লিপ্ত রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। রাষ্ট্র দুটির এই পরস্পর বিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছে উন্নত বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোও। এদের মধ্যে ইউরোপীয় অঞ্চলের একাধিক দেশসহ মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও কাতারের মত দেশগুলো মার্কিন মিত্রতা গ্রহণ করেছে।

অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যে অসন্তুষ্ট ইরান, চীন, তুরস্কের মত রাষ্ট্রগুলো রাশিয়ার মৈত্রিজোটে পরিনত হয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের বিভিন্ন ইস্যুতে এরইমধ্যে নিজেদের সম্পৃক্ত করে নিয়েছে তারা। যে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র জোট সমর্থন দিচ্ছে তাতে আপত্তি জানাচ্ছে রাশিয়া ও তার মিত্ররা।  অপরদিকে রুশ জোটের সমর্থিত বিষয়গুলোতে নিজেদের বিরোধীতা জানান দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মৈত্রিজোট। আর এতে করেই ক্রমশ ঘণীভূত হচ্ছে বৈশ্বয়িক সংকট সৃষ্টির সম্ভাবনা।

বা থেকে- ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলীয় নেতা হুয়ান গুইদো

বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যুতে পরিণত হয়েছে ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতি সংকট। কারণ, ভেনেজুয়েলা সংকটকে কেন্দ্র করে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে চলমান স্নায়ুযুদ্ধ ক্রমেই সামরিক সংঘাত সৃষ্টির সম্ভাবনাকে উষ্কে দিচ্ছে। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে, সামান্য সুযোগ সৃষ্টি হওয়া মাত্র দেশগুলো যে নূন্যতম কালক্ষেপণ ছাড়াই পরস্পরের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে লড়তে নেমে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এমন একটি সংকট সৃষ্টির সবচেয়ে সম্ভাবনাময় উপলক্ষ হিসেবে বর্তমানে বিবেচিত হচ্ছে ভেনেজুয়েলা ইস্যু। 

দক্ষিণ আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক দেশ ভেনেজুয়েলার ইতিহাসের সবচেয়ে ক্ষমতাধর কম্যুনিস্ট ঘরানার রাজনৈতিক নেতা ছিলেন হুগো শেভেজ। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন শেভেজের হাত ধরে ভেনেজুয়েলা অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠার যে প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিলো তা থমকে যায় বর্ষীয়াণ এই নেতার মৃত্যুতে। দেশটির রাজনৈতিক সংকটের সূত্রপাত হয় যখন শেভেজের মৃত্যুর পর ২০১৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্টিত হন তারই অনুসারী নিকোলাস মাদুরো। পরবর্তীতে, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে যখন দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো শপথ নিতে যান তখনই শুরু হয় মূল বিপত্তি। কেননা, এসময় বিরোধী দলগুলো নিকোলাস মাদুরোর বিরুদ্ধে নির্বাচনে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আনেন এবং তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করেন।

এই সুযোগে, জাতীয় পরিষদের স্পিকার হুয়ান গুইদো সংবিধানের ২৩৩ এবং ৩৩৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিজেকে দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসাবে ঘোষণা করেন। এ সময় গুইদোর এই দাবিকে সমর্থন জানিয়ে বিরোধী দলগুলো তার নেতৃত্বে ডেমোক্রেটিক ইউনিটি রাউন্ডটেনিল (এসইউডি) দল গঠন করে, শুরু হয় রাজনৈতিক সংঘাত। বিরোধী জোট একই সঙ্গে মাদুরোকে অনৈতিক ভাবে ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে এবং ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক সংকট মুক্তির চেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগে ক্ষমতা ছাড়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। অপর দিকে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য প্রেসিডেন্ট মাদুরোও তার অনুগত সামরিক শক্তিকে রক্ষা কবজ হিসেবে ধারণ করতে বাধ্য হন। 

ভেনেজুয়েলার এই আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক সংকটটিকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে টেনে আনে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির রাজনৈতিক জটিলতা নিরসনে নিরপেক্ষ ভূমিকা না নিয়ে সরাসরি বিরোধী দলীয় নেতা হুয়ান গুইদোর প্রতি নিজেদের সমর্থন জানায় ট্রাম্প প্রশাসন। আর যুক্তরাষ্ট্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ব্রিটেন, ফ্রান্স, হল্যান্ড, পর্তুগাল, স্পেনসহ আরও ৫০টি দেশ। গুইদোকে দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে মাদুরোকে ক্ষমতা ছাড়ার জন্য নানামুখী চাপ সৃষ্টি করতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। তার সঙ্গে মাদুরোর উপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখে মার্কিন সমর্থিত ইইউ সদস্য রাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশ। পাশাপাশি মাদুরোর প্রতি জনরোষ উস্কে দিতে এবং গুইদোকে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে শুরু হয় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা। এক পর্যায়ে মাদুরো সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সামরিক হস্তক্ষেপের হুমকিও দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

ভেনেজুয়েলার উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন অয়েল রিজার্ভ ও রিফাইনিং ফিল্ড - ইন্টারনেট

এ অবস্থায় ভেনেজুয়েলার যে পরিস্থিতি, তা দৃশ্যত যেন আরব বিশ্বের সেই সকল রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি যাদের একে একে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে পৌছে দেয়া হয়েছে। আর সেটি কেন এবং কাদের দ্বারা করা হয়েছিলো সে কথা কারো অজানা নয়, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো আরব বিশ্বের তেলের মজুদ কুক্ষিগত করা। ভেনেজুয়েলার ক্ষেত্রেও অনেকটা সেই একই সূত্র প্রয়োগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু কেন? আরবের বুকে না হয় তেলের মজুদ ছিলো ভেনেজুয়েলায় কি আছে? শুনলে অনেকেই হয়তো প্রথমে এ কথা বিশ্বাসই করতে পারবেন না যে প্রায় প্রতিটি আরব বিশ্বের বুকে খনিজ তেলের বড় বড় মজুদ থাকলেও বিশ্বের সবচেয়ে বড় জ্বালানি তেলের মজুদটি ভেনেজুয়েলার। 

যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি বিভাগের মতে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জ্বালানি তেলের মজুদ আছে ভেনেজুয়েলায়। পরিমাণের দিক দিয়ে তা ৩,০০,৮৭৮ মিলিয়ন ব্যারেল। মজুদের দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে সৌদি আরব। জ্বালানি তেলের এই বিশাল মজুদের দিকে অতি আগ্রহের কারণে জুয়ান গুইদোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে তা ষ্পষ্ট।

যুক্তরাষ্ট্র চাইছিলো, মাদুরোর বিরুদ্ধে নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ ও দেশটির অর্থনৈতিক সংকটের দায়বদ্ধতাকে পুঁজি করে হুয়ান গুইদোকে ক্ষমতার কেন্দ্রে আনতে। তবে, সিরিয়া প্রেক্ষাপটকে উদাহরণ হিসাবে ধরে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তা এত সহজ হবে না।  কারণ, সেনা সমর্থিত মাদুরো সরকারের প্রতি দেশটির সেনাবাহিনীর অকুন্ঠ সমর্থন থাকায় বিপত্তিতে পরে যুক্তরাষ্ট্র। সে সঙ্গে মাদুরো সরকারের প্রতি রাশিয়া ও তার মিত্র রাষ্ট্র ইরান, তুরস্ক ও চীনের সমর্থন প্রদানের ফলে পরিস্থিতি মাদুরোর অনুকূলে চলে যায়। 

এদিকে গুইদোর নেতৃত্বে চলমান গণআন্দোলন কিছুটা বেকায়দায় রাখে মাদুরোকে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের একটি ভুল কূটনৈতিক চাল ও গুইদোর রাজনৈতিক অপরিপক্কতার ফলে বাজিমাত করে যেতে পারে মাদুরো। ভেনেজুয়েলার বাণিজ্যিক খাতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে দেশটিতে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে আবার নিজেই ত্রাণ প্রেরণ করে যুক্তরাষ্ট্র।

ভেনেজুয়েলায় মাদুরোর সরকারকে সেদেশের সেনাবাহিনী ও বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রগুলো সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তাই ভেনেজুয়েলায় চলমান সংকটকে আগেভাগেই একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে নিয়ে যেতে এরইমধ্যে রাশিয়ার নেতৃত্বে শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা। বর্তমানে ভেনেজুয়েলা ইস্যুতে শান্তিপূর্ণ সমঝোতা নিশ্চিত করতে এবং অন্যায়ভাবে দেশটির অভ্যন্তরীন ইস্যুতে কারো হস্তক্ষেপ না করতে আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। যার ফলে আশা করা যাচ্ছে শিগগিরই ভেনেজুয়েলায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। এতে করে সম্ভবত বর্তমান শতাব্দীর অন্যতম সংকটাপন্ন পরিস্থিতির নিষ্পত্তি ঘটবে।

তথ্যসূত্র সহায়ক: বিবিসি, আরটি, ওয়াশিংটন পোস্ট