• ঢাকা
  • সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ১০, ২০১৯, ১১:১৫ এএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ১০, ২০১৯, ১২:৪৮ পিএম

মাহাথির মোহাম্মদের জন্মদিন আজ

আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার এক ‘বাঙালি’র কথা

আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার এক ‘বাঙালি’র কথা

বিশ্বময় আধুনিক মালয়েশিয়ার প্রধান রূপকার হিসেবে পরিচিত ডা. মাহাথির মোহাম্মদের ৯৫তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৯২৫ সালের ১০ জুলাই মালয়েশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর এ্যালোর সেটার-এ জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তবে খানিকটা পেছন থেকে যদি দেখে আসা যায় তবে এমন একটি বিষয়ে জানা যায়, যা হয়তো অনেকেরই অজানা।

মালশিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এই বর্ষীয়ান নেতার পূর্ব পুরুষরা ছিলেন বাংলাদেশি।  চট্টগ্রামের কাপ্তাই রাঙ্গুনিয়ার উপজেলাধীন চন্দ্রঘোনা ও কাপ্তাইগামী সড়কের পূর্বে কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত মরিয়ম নগর গ্রামে ছিল তার পিতামহের বাড়ি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে গ্রামটির এক যুবক জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমান মালয়েশিয়ায়। লোকটি ছিলেন জাহাজের একজন নাবিক। দেশটির এ্যালোর সেটর গিয়ে এক মালয় তরুণীর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন তিনি।

পরবর্তীতে তাদের ঘরে জন্ম নেন মুহম্মদ ইস্কান্দার। আর সেই মুহম্মদ ইস্কান্দারের সন্তান হচ্ছেন এই আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি মাহাথির মুহম্মদ। সে হিসেবে চট্টগ্রাম হচ্ছে মাহাথিরের পূর্বপুরুষের দেশ এবং সে অনুযায়ী তার শরীরে বাংলাদেশি রক্ত বইছে। তার পিতা মুহম্মদ বিন ইস্কান্দার ছিলেন দেশটির একটি ইংলিশ স্কুলের ইংরেজি বিষয়ক শিক্ষক। মাহাথির শৈশব কালে প্রথমে মালয় ও পরে শহরের একমাত্র ইংরেজি স্কুলে শিক্ষা অর্জন করেন।

ইসলাম ধর্ম শিক্ষার জন্য বাসায় তাদের একজন ধর্ম বিষয়ক শিক্ষক ছিল, যিনি প্রতিদিন বাড়িতে এসে মাহাথিরকে পবিত্র কুরআন শরীফ, ইসলাম ধর্মের ওপর বিশ্বাস এবং ধর্মীয় বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান শেখাতেন। তার মাও একজন ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। তিনিও মাহাথিরকে বাসায় পবিত্র কুরআন শিক্ষা দিতেন। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি সেনারা মালয়েশিয়ায় আক্রমণ করে। তারা তখন সকল ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বন্ধ করে দেয় এবং জাপানি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে।

সপরিবারে মাহাথির মোহাম্মদ- ছবি: ইন্টারনেট

মাহাথিরের বয়স তখন কেবল মাত্র ষোল। তিনি প্রথমে সেই জাপানি স্কুলে যেতে চাননি। মাহাথির তখন একটি স্থানীয় ছোট বাজারে কলা বিক্রি শুরু করেন। যদিও পরিবারের চাপে পরবর্তীতে তিনি সেই জাপানি স্কুলে যেতে শুরু করেন। মালয়েশিয়ায় প্রায় তিন বছর স্থায়ী ছিল এই জাপানি শাসন। ১৯৪৭ সালে তিনি সিঙ্গাপুরের কিং অ্যাডয়ার্ড মেডিসিন কলেজে ভর্তি হন এবং চিকিৎসা শাস্ত্রে অধ্যয়ন সম্পন্ন করেন। সিঙ্গাপুরে সিথি হাসমার সঙ্গে তার সাক্ষাত হয়।

সিথি হাসমা তখন মালয়ের দ্বিতীয় মহিলা হিসেবে সিঙ্গাপুরে বৃত্তি নিয়ে একই কলেজে চিকিৎসাশাস্ত্র বিভাগে অধ্যয়ন করছিলেন। পরবর্তীতে মাহাথির ও সিথি হাসমা পারিবারিক সম্মতিতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৫৩ সালে তিনি সিঙ্গাপুর থেকে মালয়েশিয়া ফিরে এসে একজন চিকিৎসক হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। মালয়েশিয়ার স্বাধীনতার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে তিনি সরকারি চাকরি বাদ দিয়ে নিজ শহর এ্যালোর সেটরে 'মাহা-ক্লিনিক' নামে একটি বেসরকারি ক্লিনিক স্থাপন করেন।

মাহাথির ধীরে ধীরে স্থানীয়দের মধ্যে 'ডক্টর এম' নামে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তখনও তার রক্তে মিশে ছিল দেশাত্মবোধ আর রাজনীতি। সাধারণ মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠা এই মাহাথির এক সময় নিজেকে পুরোপুরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেন। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে ১৯৬৪ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে প্রথম সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।

পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে তিনি দ্বিতীয়বার নির্বাচনে প্রার্থী হন। এরপরও এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সহযোগিতায় তিনি তার ডাক্তারি প্রাকটিস অব্যাহত রাখেন। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি এই পেশা ধরে রেখেছিলেন। ১৯৭৪ সালে দল নির্বাচনে জয় পায়ে ক্ষমতায় আসলে তাকে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।

নিজেরর কর্মদক্ষতায় মাত্র দুই বছর পর ১৯৭৬ সালে মাহাথির দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যেখানে তিনি পুরোপুরি সফল হন। উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের জন্য অনেক কিছু করার পরিকল্পনা থাকলেও মাহাথির স্বাধীনভাবে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারছিলেন না। তবে ১৯৮১ সালের ১৬ জুলাই ৫৫ বছর বয়সে মালয়েশিয়ার ৪র্থ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকারের সর্বোচ্চ আসনটিতে বসার সুযোগ পান এই রাজনৈতিক। 

মালয় প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার পর 'ডক্টর এম' তার সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সম্পূর্ণ মুক্ত হন এবং দেশ নিয়ে তার চিন্তাগুলো বাস্তবায়ন শুরু করেন। জাপানের পদাঙ্ক অনুসরণে তিনি মালয়েশিয়াকে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, স্টিল ও গাড়ির উৎপাদক দেশে পরিণত করেন।

২০০৩ সালের ৩০ অক্টোবর তিনি স্বেচ্ছায় প্রধানমন্ত্রীর এই পদ থেকে পদত্যাগ করেন। যদিও অবসর গ্রহণের দীর্ঘ ১৫ বছর পর প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের ব্যাপক দুর্নীতি সংশ্লিষ্টতার কারণে মাহাথির আবারও দেশের রাজনীতিতে ফিরে আসেন। যার অংশ হিসেবে গত বছর দেশটিতে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনে জয়ের পর ১০ মে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুনরায় শপথ নেন বর্ষীয়ান এই রাজনৈতিক। যার মাধ্যমে ৯৪ বছর বয়সে বিশ্বের সবচেয়ে প্রবীণতম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইতিহাসও গড়লেন এই রাষ্ট্র নায়ক।

এ দিকে ৯০ এর দশকে যখন বিশ্ব পাঞ্চকার্ডের ব্যবহার নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে ঠিক তখনই তিনি মালয়েশিয়া তার সফল প্রয়োগকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪২তম সমাবর্তনে মাহাথির মোহাম্মদকে সম্মান সূচক 'ডক্টর অব ল'স ডিগ্রি প্রদান করা হয়। তাছাড়া বাংলাদেশের আরও একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি প্রদান করা হয়। 

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাহাথিরের একটি স্কলারশিপও রয়েছে। যার অংশ হিসেবে ২০০৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাবির তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক এস এম ফায়েজের হাত থেকে ডিগ্রি গ্রহণ করেন আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার খ্যাত ড. মাহাথির মোহাম্মদ।

ব্যক্তিগত জীবনে মাহাথির বেশ পরিশ্রমী ও শৃঙ্খলা পরায়ণ। তার শাসনামলে দেশটি অর্থনৈতিক উন্নয়নের শীর্ষে পৌঁছে। ৯৫ বছর বয়সী জীবন্ত কিংবদন্তি এই মানুষটি শুধু দরিদ্র মালয়েশিয়াকে বিশ্বের ১৪তম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেনি, তৃতীয় বিশ্বের মানুষকে আশার আলো দেখিয়ে আত্মনির্ভরশীল জাতীয় চেতনায় উজ্জীবিত করেছেন।

মাহাথিরের মতে, 'জনগণ আমাকে ভুলে গেলেও আমার কোনো দুঃখ নেই।' শেক্সপিয়ারের 'জুলিয়াস সিজার' নাটক উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, 'মন্দটাই মনে রাখে মানুষ। ভালোটা হাড়গোড়ের সঙ্গে মাটিতে মিশে যায়। জনগণ আমাকে মনে রাখল কি রাখল না তাতে আমার কোনো কিছুই আসে যায় না।' আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার এক অনুকরণীয় রাজনৈতিক নেতায় পরিণত হয়েছেন চিকিৎসক থেকে সবচেয়ে বেশি বয়সী প্রধানমন্ত্রী বনে যাওয়া মাহাথির বিন মোহাম্মদ।

ইতিহাস বলছে, মাহাথিরের বয়স যখন কুড়ির কোঠায় তিনি তখন দেশের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। নিজের সহপাঠীদের একত্র করে গোপনে 'মালয়ান ইউনিয়ন' প্রস্তাবের বিরুদ্ধচারণ শুরু করেন। এ দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়ে জাপানি সেনারা বিদায় নেওয়ার পূর্বে তৎকালীন মালয়েশিয়াকে তারা তৎকালীন থাই সরকারের হাতে হস্তান্তর করে। যদিও পরবর্তীতে ব্রিটিশরা অঞ্চলটিতে আবারও ফিরে আসে এবং 'মালয়ান ইউনিয়ন' প্রতিষ্ঠা করে।

মালয়ান ইউনিয়ন সত্যিকার অর্থে সম্পূর্ণ একটি ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। মাহাথির ও তার সহপাঠীরা তখন রাতের আঁধারে গোটা শহরে রাজনৈতিক বাণী সম্বলিত পোস্টার লাগিয়ে দিতেন। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, 'মালয়ান ইউনিয়ন' প্রস্তাবের সমাপ্তি এবং প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা পুনরায় ফিরে পাওয়া। তারা তখন সাইকেলে চেপে সমগ্র প্রদেশ ঘুরে ঘুরে জনগণকে ব্রিটিশ বিরোধী হিসেবে সংঘটিত ও সক্রিয় করার কাজ করতেন।

সহপাঠীদের নিয়ে গঠিত এই সংগঠনে মাহাথির সাধারণত সম্পাদক বা দ্বিতীয় অবস্থানটাই বেছে নেন। কেননা দ্বিতীয় ব্যক্তিকেই সবচেয়ে বেশি সাংগঠনিক কাজ করতে হয়, এমনকি অন্য দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ একমাত্র তাকেই রাখতে হয়। যার অংশ হিসেবে মাহাথির প্রথমে কেদাহ মালয় যুব ইউনিয়ন এবং পরবর্তীতে কেদাহ মালয় ইউনিয়ন নামে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন বা ইউএমএনও হিসেবে পরিচিতি পায়।

এসকে 

আরও পড়ুন